শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলতি বছর থেকে সমন্বিত বা গুচ্ছ ভিত্তিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও এর বাস্তবায়নে কোনো গতি নেই। অথচ এই উদ্দেশ্যে কার্যপত্র তৈরি করতে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নানকে প্রধান করে সাত সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছিল। এ ছাড়া একই বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের সংগঠন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের এক বৈঠকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশীদকে আহ্বায়ক করে ৯ সদস্যের আরেকটি কমিটি করা হয়। দুই কমিটিকেই ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল। উল্লেখ্য, চলমান এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরাই আগামী অক্টোবর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য তৈরি হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি প্রক্রিয়া নিয়ে ইউজিসি একটি ও বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের পক্ষে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশীদ আরেকটি প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। কিন্তু এরপর আর কাজ এগোয়নি। এ পরিস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাফ বলেছে, তারা গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি করবে না। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্য এ পদ্ধতিতে রাজি আছে। তবে প্রতিবেদন প্রণয়নের মধ্যেই ইউজিসি দেশের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ে এক বৈঠকে জানিয়ে দেয় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ করার জন্য। কিন্তু তারা এখনো এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। ফলে এটিও ঝুলে আছে।
জানতে চাইলে ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. এম শাহ নেওয়াজ আলী বাংলাদেশের খবরকে বলেন, গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি বিষয়ে ইউজিসি একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এখন এ নিয়ে একটি বৈঠক হবে। কবে নাগাদ এ বৈঠক হবে, সেটি ইউজিসি চেয়ারম্যান বলতে পারবেন। ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেছেন, বিষয়গুলো নিয়ে বসা হয়েছে। আরো বসতে হবে। রাতারাতি তো আমরা বিপ্লব ঘটাতে পারব না। তবু আমরা লেগে রয়েছি। রাষ্ট্রপতি চাচ্ছেন, বেশিরভাগ ভিসি চাচ্ছেন, শুধু কয়েকটি বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনীহার কারণে এর বাস্তবায়ন হতে দেরি হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের সভাপতি এবং পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মো. হারুন-অর-রশীদ বলেন, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের বৈঠকেই নির্ধারিত হয়েছিল এবার গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি প্রক্রিয়া চলবে। এ লক্ষ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশীদকে আহ্বায়ক করে প্রতিবেদন তৈরি করতেও বলা হয়। সেটি তৈরি হয়ে গেলেও এ নিয়ে কোনো বৈঠক হয়নি। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া সবাই এ প্রক্রিয়ায় ভর্তিতে মত দিয়েছে। বুয়েট এখনো স্পষ্টভাবে কিছু জানায়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বাংলাদেশের খবরকে বলেন, নিজস্ব স্বকীয়তা ও ঐতিহ্যে উজ্জ্বল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রয়োজনে অন্যভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সহায়তা করা হবে। তবু তারা গুচ্ছ পদ্ধতিতে যাবেন না। রাষ্ট্রপতিকেও এ সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে বলে তিনি দাবি করেছেন।
বর্তমানে দেশে ৪২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এর মধ্যে ৩৭টি কার্যকর। একেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা একেক সময় হওয়ায় শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ ও অতিরিক্ত অর্থ খরচ হয়। এজন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় দীর্ঘদিন ধরেই মেডিকেলের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও গুচ্ছ ভিত্তিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার চেষ্টা করে আসছে। কিন্তু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের আপত্তিতে তা চালু করা যায়নি। মূলত আবেদন বাবদ বিপুল অঙ্কের ভাতা না পাওয়ার আশঙ্কা থেকে কিছু বিশ্ববিদ্যালয় এই পদ্ধতিতে যেতে চায় না বলে অভিযোগ রয়েছে। গুচ্ছ ভিত্তিতে একই ধারার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একটি গুচ্ছে এনে একসঙ্গে পরীক্ষা নেওয়া হবে। এরপর শিক্ষার্থীদের মেধাক্রম ও পছন্দ অনুযায়ী ভর্তি করা হবে। যেমন : বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একটি গুচ্ছে আবার কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একসঙ্গে করে পরীক্ষা নেওয়া হবে। একই ভাবে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য একটি এবং প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য আরেকটি গুচ্ছ পরীক্ষা নেওয়া হবে। সব মিলিয়ে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তিন ভাগে ভাগ হয়ে এই গুচ্ছ পদ্ধতি চালুর প্রস্তাব ছিল।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, বর্তমানে শিক্ষার্থীদের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলাদাভাবে ফরম কিনতে হয়। এতে বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভালো আয় হয়। যদিও ইউজিসির নির্দেশনা অনুযায়ী, ভর্তি পরীক্ষার আয়ের ৪০ শতাংশ টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা রেখে তা উন্নয়নমূলক কাজে ব্যয় করার কথা। কিন্তু অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় তা করে না। আবার সমন্বিত বা গুচ্ছ ভর্তিতে এই আয় কমে যায়। এ ছাড়া ভর্তি বাণিজ্য আর কোচিং-গাইড বাণিজ্যের জন্যই অনেকে এ পদ্ধতির বিরোধিতা করেন। গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষার বিষয়ে আলোচনা শুরু হয় ২০০৮ সালে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালের ৭ জুলাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এক সভায় বেশিরভাগ উপাচার্য সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার বিষয়ে নীতিগতভাবে একমত হয়েছিলেন।
জানতে চাইলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান বাংলাদেশের খবরকে বলেন, আগামী বছর যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেবে তাদের ভোগান্তি লাঘবে করণীয় নির্ধারণে পরিষদ একটি কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটিই একটি খসড়া বানিয়েছে। আমরা চাই এ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা হোক।
শিক্ষার্থীদের কষ্ট লাগবের জন্য গুচ্ছ পদ্ধতিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ নিজেও। তারপরও বিষয়টি বাস্তবায়নে কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। ইউজিসি এক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ভর্তি পরীক্ষা নিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের একেকজন শিক্ষককে গড়ে ১৭ থেকে ২৬২ ঘণ্টা ব্যয় করতে হয়। অন্যদিকে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি, ফরম কেনা ও পরীক্ষা দিতে দূর-দূরান্তে যাওয়া-আসা বাবদ একজন শিক্ষার্থীকে প্রায় ৫০ হাজার টাকা খরচ করতে হয়। ভর্তিচ্ছু ৭৬ শতাংশ শিক্ষার্থীই চায় গুচ্ছভিত্তিক পরীক্ষা হোক।