Logo
Logo

জীবনানন্দ

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন

রুচির দুর্ভিক্ষের বিপরীতে তুলির যোদ্ধা এক

মেহেদী হাসান শোয়েব

মেহেদী হাসান শোয়েব

প্রকাশ: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৫:৪৮

রুচির দুর্ভিক্ষের বিপরীতে তুলির যোদ্ধা এক

বাংলাদেশের চিত্রকলার ইতিহাসে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন এক আলোকবর্তিকার নাম। তাঁর আলো থেকে উৎসারিত হয়েছে দেশের শিল্প আন্দোলনের নতুন দিশা। শিল্পের প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসা ও দৃঢ় অঙ্গীকার তাঁকে দেশ ও সমাজের নানা দুর্দশার ছবি আঁকতে অনুপ্রাণিত করেছে। তাঁর আঁকা ছবিগুলো কেবল শিল্পকর্ম নয় যেন, বরং মানুষের সংগ্রাম ও জীবনযুদ্ধের চিত্রায়ণ।

১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জের কেন্দুয়ায় জন্ম নেওয়া এই মহান শিল্পীর ছেলেবেলা থেকেই ছিল ছবি আঁকার নেশা। রংতুলির সাথে ছিল তাঁর গভীর সম্পর্ক। ফুল, ফল, বৃক্ষ, মাছ, পাখি—প্রকৃতির এসব দৃশ্য তাঁকে বিমোহিত করতো। আঁকার শুরুর বিষয় হিসেবে তাই প্রাকৃতিক দৃশ্যই বেছে নিয়েছিলেন। তবে, ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় চিত্রকলার মাধ্যমে তিনি যেভাবে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে গেছেন, তা আজও আমাদের মনকে সংবেদনশীল করে তোলে। 

কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুলে ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণ করেন। সেখানে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন তিনি। তবে তার এই শিক্ষাজীবন-পর্ব সহজ ছিল না। ১৯৩৩ সালে কলকাতার আর্ট স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য তিনি শুরুতে একবার বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন। পরে মায়ের গয়না বেচা টাকায় ভর্তি হলেও অর্থনৈতিক সংকট ও দারিদ্র্য ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘পার্কে থাকতে হতো। কিন্তু সবচেয়ে কষ্টকর ছিল পার্কে ভোর হওয়ার পর শতরঞ্জি বাঁধা তোশকটা বগলে নিয়ে কোথায় রাখব কোথায় রাখব করে নিত্যনতুন জায়গার সন্ধান।’ তখন জয়নুলের মাথায় এল দারুণ এক বুদ্ধি। এক-একটি করে মসজিদের বারান্দায় কয়েকটি করে রাত কাটাতে শুরু করলেন। এভাবেই অনেকগুলো দিন চলেছিল।  

দেশভাগের পর ঢাকায় এসে তিনি চিত্রকলার এক নতুন যুগের সূচনা করেন। ১৯৪৮ সালে চিত্রশিল্পী আনোয়ারুল হক, কামরুল হাসান, খাজা শফিক আহমেদ, সফিউদ্দীন আহমেদ ও হাবিবুর রহমানের সাথে মিলে ঢাকা শহরের জনসন রোডে একটি আর্ট ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরে সেগুনবাগিচায় স্থানান্তরিত হয়ে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সরকারের দেওয়া জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬৩ সালে এটি পূর্ব পাকিস্তান চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃত হয় এবং পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশে তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে রূপান্তরিত হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে খ্যাতিমান শিল্পী রফিকুন নবী বলেন, ‘তিনি ১৯৪৮ সালে দেশভাগের সময় যখন দেশে চলে এলেন, এসে আর্ট কলেজ তৈরি করলেন। এটা শুধু যে নিজেদের চাকরির সুবিধার জন্য, তা নয়। এ অঞ্চলে চারুকলা ইনস্টিটিউটের প্রয়োজন ছিল। তখন পশ্চিম পাকিস্তানে লাহোরে অনেক পুরোনো ন্যাশনাল আর্ট কলেজ ছিল। কিন্তু ঢাকায় কোনো আর্ট কলেজ ছিল না। শিল্পকলা নিয়ে পড়াশোনা করতে হলে আমাদের এখানকার ছাত্রছাত্রীদের কলকাতা, মাদ্রাজ, বোম্বে, দিল্লী যেতে হতো। সেকারণেই তিনি অন্যান্য সহযোগী শিল্পীদের নিয়ে এই ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। এদেশে ঢাকা এবং চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে শিল্পচর্চার ক্ষেত্র তৈরি করছেন তিনি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সাবেক অধ্যাপক চিত্রশিল্পী মামুন কায়সার বলেন, ‘শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সে সময় আর্ট ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন বলেই আজকে সেখান থেকে অনেক শিল্পী তৈরি হয়েছেন। যার যার ক্ষেত্র থেকে বাংলাদেশের চিত্রকলাকে সমৃদ্ধ করেছেন। আবেদিন স্যার না থাকলে আমরা যারা শিল্পী আছি, আমাদের কারোরই জন্ম হতো না। তিনি যদি শিল্পচর্চার একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি না করতেন আমরা কেউই আজকে এ জায়গায় আসতে পারতাম না।’ আর্ট ইনস্টিটিউট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আবেদিন স্যার চিন্তা করেছিলেন, আমি যদি একা আবেদিন হই অর্থাৎ আঁকিয়ে হই তাতে বাংলাদেশের কী লাভ হবে? আমার মতো আরও অনেক আঁকিয়ের যদি সৃষ্টি হয় সেটাই বাংলাদেশের জন্য সম্মানের হবে। সেই চিন্তা থেকে তিনি আর্ট ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার কথা ভাবেন।’

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সবচেয়ে স্মরণীয় চিত্রকর্মগুলোর মধ্যে ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ চিত্রমালা অন্যতম। এই চিত্রকর্ম তাঁর অনন্য শিল্পবোধের পরিচয়ের প্রকাশ। তাঁর আঁকা দুর্ভিক্ষের দুর্দশায় ক্ষতবিক্ষত মানুষ, কঙ্কালসার দেহ, কাক ও ডাস্টবিন—এ সবই পরিণত হয়েছে বাংলার ঐতিহাসিক শোকের চিত্রে। এ শুধু এক শিল্পকর্ম নয়, বরং একটি জাতির সংগ্রামের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। ১৯৭০ সালে ‘নবান্ন’ ছবিটি তাঁর জীবনের অন্যতম বড় কীর্তি ছিল, যেখানে গ্রামবাংলার উৎসব, মানুষের কষ্ট এবং সংগ্রামের এক অন্যরকম চিত্র ফুটে উঠেছে।

জয়নুল আবেদিনের চিত্রকর্মে অনন্য বৈশিষ্ট্য হল—কেবল দেখার ছবি নয়, বরং মানুষের গভীরতম সত্য অনুভূতির প্রকাশ যেন তা। তিনি তুলির আঁচরে দেশের জনজীবন, সংগ্রাম, দুঃখ-দুর্দশা এবং মানবিক মূল্যবোধ তুলে ধরেছেন শৈল্পিক দক্ষতায়। 

একবার সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ জয়নুলকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনি দুর্ভিক্ষের উপর ছবি আঁকলেন অথচ বন্যার ছবি আঁকলেন না কেন?’ উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘বন্যা প্রকৃতির। তাই এর বিরুদ্ধে করবার কিছুই নেই। দুর্ভিক্ষ মানুষের সৃষ্টি। মানবতার অপমান আমাকে ব্যথিত করেছিল। তাই দুর্ভিক্ষের ছবি এঁকেছি।’

এসব ছবি কেবল মানবিক দুঃখের দৃশ্যই নয়, বরং সে সময়ের রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার এক নিখুঁত প্রকাশ। 

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের শিল্পের পথ ছিল সংগ্রাম ও প্রতিজ্ঞায় অবিচল। তিনি একাধারে ছিলেন চিত্রশিল্পী, শিক্ষক এবং সংগঠক। ঢাকা আর্ট গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে শিল্পীসমাজে একটি নতুন ধারণার জন্ম দেন। তার অবদান শুধু চিত্রকলায় সীমাবদ্ধ ছিল না, তিনি লোকশিল্প ও কারুশিল্পের উন্নতিতেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। ময়মনসিংহে তাঁর প্রতিষ্ঠিত জয়নুল সংগ্রহশালা এবং সোনারগাঁ লোকশিল্প জাদুঘর তার উজ্জ্বল উদাহরণ। 

পাকিস্তান আমলে তিনি শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ারকে বলেছিলেন, ‘মনোয়ার, দুর্ভিক্ষ হলে সে ছবি আঁকা যায়, নিরন্ন মানুষের হাহাকার ছবিতে দেখানো যায়। কিন্তু পাকিস্তানি শোষণের সময় মনের দুর্ভিক্ষ চলছে—এটা তো কোনো ছবিতে আঁকা যায় না।’

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেরণায় তিনি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া, ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমির সভাপতি হন এবং ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর অবদান শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক স্তরেও প্রশংসিত।  

জয়নুল আবেদিন বলতেন, ‘এখনতো চারিদিকে রুচির দুর্ভিক্ষ! একটা স্বাধীন দেশে সুচিন্তা আর সুরুচির দুর্ভিক্ষ! এই দুর্ভিক্ষের কোনো ছবি হয় না।’। তিনি নিজের রং-তুলিকে অস্ত্র করে মানুষের মন, বোধ আর রুচির উন্নয়নে সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন আজীবন। যেন রুচির দুর্ভিক্ষের বিপরীতে তুলির যোদ্ধা এক!

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ১৯৭৬ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ৬১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু তাঁর চিত্রকর্ম এবং শিক্ষা বাংলাদেশের শিল্পকলায় এক অমূল্য ধন হয়ে রয়ে গেছে। জন্মদিনে শিল্পাচার্যকে প্রণতি জানাই।

মেহেদী হাসান শোয়েব : লেখক, প্রকাশক, বিতার্কিক; শিফট ইনচার্জ, বাংলাদেশের খবর

এমএইচএস

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর