Logo
Logo

জীবনানন্দ

হাবীবুল্লাহ সিরাজী : শক্তিমান কবি হয়েও কম-চেনা কেন

মেহেদী হাসান শোয়েব

মেহেদী হাসান শোয়েব

প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৬:২৭

হাবীবুল্লাহ সিরাজী : শক্তিমান কবি হয়েও কম-চেনা কেন

জীবনানন্দ দাশকে আমরা আধুনিক কবিতার সবচেয়ে শক্তিমান কবিদের অন্যতম, বা কখনো অগ্রগামী হিসেবে বলে থাকি। কিন্তু কেনো বলি? কী সেই বৈশিষ্ট্য যা তাঁর কবিতাকে অন্যদের চেয়ে আধুনিক বা আলাদা করে, বড় করে, বা বলা যেতে পারে মহৎ করে আমাদের মনে জায়গা দিলো? আমার মনে হয়, জীবন বাবুর কবিতার ভাষা, যা তার একান্ত নিজের, তাই তাকে আলাদা করেছে। প্রথমদিকে তাঁর লেখায় যখন নজরুলের ছাপ, সেইসব কবিতা নিয়ে পরবর্তীতেও পাঠক বোদ্ধাদের তেমন উচ্ছ্বাস নেই তেমন। কিন্তু যখনই তিনি নিজের ভাষা, নিজের স্বর খুঁজে নিয়ে কবিতা লিখলেন, সেইসব কবিতায় কবিতার পাঠক মাত্রই বিস্ময়-মুগ্ধ হতে থাকলো। প্রত্যেক সফল কবিই এই নিজস্ব স্বর খুঁজে পেয়ে কবিতা লেখেন। সেই স্বর কখনো সমকাল ছাপিয়ে যাওয়া আধুনিক হয়ে ওঠে। যেমনটা জীবনানন্দের বেলায়ও ঘটেছিল। তাঁর সমকালে অনেকেই তাঁর কবিতাকে না বুঝে অবমূল্যায়ন করেছিলেন। কিন্তু এখন তিনি সবচেয়ে আদরণীয় কবি। কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর বেলায়ও বিষয়টা অনেকখানি তেমন বলেই আমার মনে হয়। সিরাজীর সমসাময়িক অন্য অনেক কবির কবিতার সাথে পাঠক, আবৃত্তিশিল্পী বা সমালোচকদের যতটা চেনাজানা, সিরাজীর কবিতার সাথে ততখানি সম্পর্ক বোধ হয় নেই। এই সম্পর্ক না থাকা সিরাজীর কবিতা বা সিরাজীর দুর্বলতা নয়, বরং পাঠক হিসেবে আমাদের পরিণত হয়ে উঠতে না পারা বা অনগ্রসরতা এর কারণ বলে মনে করি। 

হাবীবুল্লাহ সিরাজী কী এমন লিখেছেন যার জন্য তাঁকে চিনতে হবে, বা না চিনলে নিজেকে অনগ্রসর মনে করতে হবে! সিরাজী নতুন কবিতা লিখছেন, মানে তাঁর নিজের কবিতা লিখেছেন। আর ক্রমাগত নিজেকে বদলেছেন। এই বদলানোটা জরুরি। রবীন্দ্রনাথ মন দিয়ে পড়লেও আমরা দেখবো কতবার কতরকমভাবে নিজেকে ভেঙেছেন। নতুন নতুন কবিতা লিখেছেন। কবি যদি নিজেকে না ভাঙেন, নিজেকে ছাড়িয়ে না যান, সারাজীবন যদি এক-ভাষাতেই লিখতে থাকেন তবে জীবন্মৃত হয়ে যান-- সমালোচকরা এমনটাই বলেন। হাবীবুল্লাহ সিরাজীর নতুন শব্দের সন্ধান তাঁর সক্রিয়তা ও সজীবতারই প্রমাণ বহন করে। কবিতার পাঠককে তো এরকম নিজেকে ছাপিয়ে এগিয়ে যাওয়া কবির কবিতার সাথে পরিচিত হতে হবে। তা না হলে আর কবিতার পাঠক কেনো? 

সিরাজীর কবিতা কী বলে? বলে মানুষের কথা। বলে মানুষের ভেতরের অমানুষের কথা। তার কবিতা জাগাতে চায় মানুষের ভেতরের সংবেদনশীল মানুষটাকে। আর এসব কথা বলেন তিনি কবিতার ছন্দ-রূপক-অলঙ্কারের ভেতর দিয়ে। যা ভাবনার গভীরে নিয়ে যায় পাঠক-শ্রোতাকে। 

সিরাজীর ‘টোপ’ কবিতাটি পড়ে নেই চলুন।

         টোপ একটি দ্বিপাক্ষিক ক্রিয়া
         যাতে একপক্ষের ইচ্ছা
         না বুঝেই অন্যপক্ষ সামলায়
         টোপের মধ্যে গোঁজা থাকে ছল
         যার বলে বৃত্তের বাইরে আসে বিন্দু
         টোপ একটি জয়-পরাজয়ের ঝাঁপ
         যার মাপ নির্ণয় করে পিচ্ছিল ধাপ
         টোপ নানা অবস্থানে

         জলে
         স্থলে
         অন্তরীক্ষে
         টোপ নানা প্রকারে

         মাছে
         বাঘে
        পাখিতে
        টোপ লোভে ও ক্ষুধায়
        টোপ মানুষের মজ্জায়

এই কবিতার ভাষা অত্যন্ত সহজ। কিন্তু কবিতার শেষ লাইনে এসে কী ঝাঁকুনিই না দেয়। ‘টোপ মানুষের মজ্জায়’- তিনটি মাত্র শব্দ দিয়ে কী আঘাতটাই না করলেন কবি ব্যক্তি মানুষ থেকে সমাজ, রাষ্ট্র, এমনকি পুরো বিশ্ব সভ্যতাকেই! সত্যিই তো সবখানে কেবল জয়-পরাজয়ের জন্য এক লড়াইয়ের নেশা মজ্জায় ঢুকে গেছে। তার জন্য দরকারে যত ছল করার তা করছে। বুঝে না বুঝে যেন এই ক্ষুধা আর লোভের এক টোপ-চক্রেরই ভেতরে আমাদের সকলের বসবাস। 

হাবীবুল্লাহ সিরাজী কবিতায় করেছেন প্রতিবাদ। বৈষম্যের বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা তাঁর কবিতা। কবি লিখেছেন

                #

         সিঁড়ি তুলে ফেলো
         নচেৎ ভাঙো
         বললেই তো হবে না
         তার জন্য শক্তি চাইউদয়-অস্তের

                  #

         কালো এবং শাদা
         অভিধান থেকে
         বাদ দাও
         অভিধান ছিঁড়ে ফেলা
         তোমারই এক্তিয়ার

                   #

         বদলের সময় এসেছে
         শুরু থেকেই তো বাহাদুরি
         উৎস পাল্টে গেলে
         বোঝা যাবে মানুষের মানে।

                       (মুহূর্ত, হাবীবুল্লাহ সিরাজী)

কবিদেরকে দশক ধরে ডাকার একটা প্রচলন আছে। সেই হিসেবে হাবীবুল্লাহ সিরাজীকে ষাটের কবি বলা হয়। কিন্তু ষাটের দশকের কবি হয়েও হাবীবুল্লাহ সিরাজী এই ২০২৪-এর কবিদের ভাষার চেয়ে কম আধুনিক নন। বরং কখনো হয়ত এই দশকের কবিদেরকেও পেছনে ফেলার শক্তি আর বৈচিত্র্য তাঁর কবিতায় রয়েছে। উদাহরণ দেখি- 

কার্তিকের জোতে জেলা 
        হাঁসফাঁস গাল পেতে ভোর শেখা হলে 
পাগল চেনার জন্য জোর তালি লাগে— 
কুমির যে হরিণ দেখে, তার দাঁতে নক্ষত্রের ফাঁদ 
অচেনা পাতাল এবং ন্যুব্জ হাসপাতাল 
পঙ্গপাল চিনেছিল এঁটো কুয়াশায়— 
মোহনায় তিন বিঘা জমি জাগিয়াছে...

                             (‘কার্তিক-অঘ্রাণ, সহোদর’, হাবীবুল্লাহ সিরাজী) 

এই যে ‘পাগল চেনার তালি’, ‘এঁটো কুয়াশা’ কিংবা ‘মোহনায় তিন বিঘা জমি’ জেগে-ওঠার কথা বললেন, তার আড়ালে যে রূপক লুকানো রয়েছে, তা খুঁজে-বুঝে নেয়া খুব সহজ কাজ তো নয়। এর জন্য চাই জীবন ঘনিষ্ঠ জ্ঞান আর বহু পঠনপাঠনের অভিজ্ঞতা। এই ভাষায় রহস্যের ঘেরাটোপ আছে। লালনের অনেক গানের অর্থ যেমন আমরা এখনো খুঁজে পাই না, কিন্তু তার রস থেকে তো বঞ্চিত হই না। এই কবিতা পাঠে যদি বুঝতে একটু সময় লাগেও, একরকম স্বাদ আস্বাদন করতে বেগ পেতে হয় না। তবু হয়ত ঐ বুঝতে সময় লাগে বলেই আজকের সময়ের তাড়াহুড়া প্রবণতার পাঠক আমরা সিরাজী-পাঠে তেমন আগ্রহী হই না। 

একই কবিতায় আছে

অঘ্রাণ তো গলা পেতে থাকে 
তেলজমা পেট আর তার ঘুমভাঙা ডানা 
পালং-এর পাতায় তোলে ঋতুঢেউ 
যেন উম, এলোমেলো চুম্বনের দ্বিধা 
ভেঙে দেয় কাঁকড়ার পিঠ 
নয়া চরে শিশু ফুটিয়াছে...

অঘ্রাণের গলা পেতে থাকা, ঋতুঢেউ, চুম্বনের দ্বিধা, কাঁকড়ার পিঠ, নয়াচরে শিশু ফোটা- এই যে শব্দানুষঙ্গ নির্মাণ, এসব সিরাজীর কবিতার স্বকীয়তা তৈরি করেছে। এই নির্মাণ তাঁর নিজের। 

হাবীবুল্লাহ সিরাজীর শৈশব কেটেছে গ্রামে। আবার তিনি দেশের সবচেয়ে মেধাবীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে প্রকৌশলী শিক্ষা নিয়েছেন। প্রকৌশলী হিসেবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন সুনামের সাথে কাজ করেছেন। ফলে গ্রাম এবং শহরের মিশ্রণ তাঁর মনের ভেতরে ঘটেছে স্বাভাবিকভাবেই। তাই তিনি যখন লেখেন- ‘হেমন্ত যে ঘাই মারে আমাদের ছাদে’ তখন গ্রাম-শহরের এক বিমিশ্র অনুভূতি তৈরি হয়। হেমন্তের এক নতুন চিত্রকল্প তৈরি করেন কবি, যা এর আগে কোনো কবি এভাবে আমাদের বোধে এঁকে দেননি। হেমন্ত মানেই আমাদের কাছে নতুন ধান, গ্রামের নবান্ন উৎসব। যুগে যুগে সব কবিরা এরকমটাই আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। কিন্তু সিরাজীই যেন আমাদেরকে বললেন, শহুরের মানুষেরও তো হেমন্ত আছে। তারও একটা রূপ-সৌন্দর্য আছে। এই সৌন্দর্যকে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই আমাদের। কিন্তু হয়ত চিরকেলে প্রকৃতির গ্রামীণ রূপ-কাঠামোর বাইরের এক বাস্তব একেলে রূপ সিরাজী যে এঁকেছেন, তাকে গ্রহণ করার সাহসের ঘাটতি আমাদের আছে বলেই সিরাজী এখনো আমাদের কাছে অতখানি আদরণীয় হয়ে ওঠেননি। 

হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতায় ভাষার কারুকাজ লক্ষণীয়। তিনি যেমন কবিতায় নতুন কথা বলেছেন, নিজের কথা বলেছেন, আবার অনেক পুরোনো কথা যা সমকালেও প্রাসঙ্গিক তাকে নতুন করে নিজের ভাষার মোড়কে উপস্থাপন করেছেন। সুকান্তের ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়’ কবিতাটিই যেন হাবীবুল্লাহ সিরাজী নতুন করে লেখেন এভাবে-

‘একখানা চাঁদ এঁকে দাও
এই ফুরসতে সাবাড় করি
যা খিদে!
চাঁদ খাবে গাছ, পাখি, পাথর ও জল
তুমি আঁকো
ওরাও সারারাত উপোস!’

হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবি পরিচয় প্রধান হলেও উপন্যাস, অনুবাদ, সমালোচনা ও শিশুসাহিত্যও রচনা করেছেন তিনি। সিরাজী ১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর ফরিদপুর জেলার রসুলপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা আবুল হোসেন সিরাজী ও মা জাহানারা বেগম। ১৯৬৪ সালে তিনি ফরিদপুর জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক, ১৯৬৬ সালে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ১৯৭০ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন তিনি। 

গদ্য-পদ্য মিলিয়ে হাবীবুল্লাহ সিরাজীর বইয়ের সংখ্যা পঞ্চাশের বেশি। তার প্রথম কবিতার বই ‘দাও বৃক্ষ দাও দিন’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালে। হাবীবুল্লাহ সিরাজীর সাহিত্যকর্ম ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, সুইডিশ, ফার্সি, হিন্দি, উর্দুসহ বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ ‘দাও বৃক্ষ দাও দিন’, ‘মোমশিল্পের ক্ষয়ক্ষতি’, ‘হাওয়া কলে জোড়াগাড়ি’, ‘নোনা জলে বুনো সংসার’, ‘স্বপ্নহীনতার পক্ষে’, ‘আমার একজনই বন্ধু’, ‘পোশাক বদলের পালা’, ‘প্রেমের কবিতা’, ‘কৃষ্ণ কৃপাণ ও অন্যান্য কবিতা’, ‘সিংহদরজা’, ‘বেদনার চল্লিশ আঙুল’, ‘বিপ্লব বসত করে ঘরে’, ‘ছিন্নভিন্ন অপরাহ্ণ’, ‘জয় বাংলা বলো রে ভাই’, ‘সারিবদ্ধ জ্যোৎস্না’, ‘সুগন্ধ ময়ূর লো’, ‘নির্বাচিত কবিতা’, ‘মুখোমুখি : তুচ্ছ’, ‘স্বনির্বাচিত প্রেমের কবিতা’, ‘হ্রী’, ‘কতো আছে জলছত্র’, ‘কতোদূর চেরাপুঞ্জি’, ‘কাদামাখা পা’, ‘ভুলের কোনো শুদ্ধ বানান নেই’, ‘একা ও করুণা’, ‘যমজ প্রণালী’, ‘আমার জ্যামিতি’, ‘পশ্চিমের গুপ্তচর’ ও ‘কবিতাসমগ্র’। তার উপন্যাস, ‘কৃষ্ণপক্ষে অগ্নিকাণ্ড’, ‘পরাজয়’, অনুবাদ ‘মৌলানার মন : রুমীর কবিতা’, আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘আমার কুমার’, গদ্যগ্রন্থ ‘দ্বিতীয় পাঠ’, ‘মিশ্রমিল’, ‘গদ্যের গন্ধগোকুল’, শিশুসাহিত্য ‘ইল্লিবিল্লি’, ‘নাইপাই’, ‘রাজা হটপট’, ‘ফুঁ’, ‘ফ্রুত’, ‘মেঘভ্রমণ’, ‘ছয় লাইনের ভূত’ ও ‘ছড়াপদ্য’। 

হাবীবুল্লাহ সিরাজী ২০১৬ সালে একুশে পদক, ২০১০ সালে রূপসী বাংলা পুরস্কার এবং কবিতালাপ সাহিত্য পুরস্কার, ২০০৭ সালে বিষ্ণু দে পুরস্কার, ১৯৯১ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৯ সালে আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৭ সালে যশোর সাহিত্য পরিষদ পুরস্কারসহ দেশি-বিদেশি নানা পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। 

২০১৮ সালের ২০ ডিসেম্বর বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব নেন হাবীবুল্লাহ সিরাজী। সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন এই প্রতিষ্ঠানের সর্বাঙ্গীণ উন্নয়নে কাজ করতে। ২০২১ সালের ২৪ মে মারা যাওয়ার আগপর্যন্ত বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। 

জন্মদিনে বাংলাসাহিত্যের শক্তিমান কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীকে জানাই শ্রদ্ধা।

মেহেদী হাসান শোয়েব : লেখক, প্রকাশক, বিতার্কিক; শিফট ইনচার্জ, বাংলাদেশের খবর 

এমএইচএস

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর