মোহাম্মদ নাসির আলী
অমূল্য রত্নসম শিশুসাহিত্যিক এক
প্রকাশ: ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ১৯:২৯
সাহিত্যের যত শাখা আছে তারমধ্যে বোধকরি কঠিনতম অধ্যায় শিশুসাহিত্য। শিশুমনের অধিকারী না হলে শিশুদের জন্য লেখা যায় না। কেননা, শিশুমনে আনন্দের দোলা দিতে পারা খুব সহজ কথা তো নয়। একজন শিশুসাহিত্যিককে তাই আজীবন নিজের ভেতরের শিশুমনকে লালন করতে হয় সযত্নে, সচেতনভাবে। বাংলা শিশুসাহিত্যের জগতে যেসব মহান সাহিত্যিক উল্লেখযোগ্য মোহাম্মদ নাসির আলী তাদের মধ্যে অন্যতম। তার লেখাগুলো একইসাথে শিক্ষণীয় ও আনন্দদায়ক। সহজ ভাষায় জীবনের নানা দিকের গল্প বলেছেন তিনি। তার লেখায় মিষ্টি হাস্যরস, বন্ধুত্বের গল্প, ভালোবাসা শিক্ষা মিলে এক অনন্য মিশ্রণ তৈরি হয়েছে। বাংলা শিশুসাহিত্যের জগতে তার অবদান অমূল্য রত্নসম।
১৯১০ সালের ১০ জানুয়ারি, বিক্রমপুরের ধাইদা গ্রামে জন্ম নেন মোহাম্মদ নাসির আলী। জন্মের সময় তার গায়ের রং ছিল খুব ফরসা। এ জন্য বাবা-মা আদর করে তাকে ডাকতেন কফুর অর্থাৎ কর্পূর। তার শৈশবের অনেকটা সময় কেটেছিল রাজবাড়ী শহরে, যেখানে তার বাবা ব্যবসা করতেন। রাজবাড়ীতে তার স্কুলে পড়াশোনার শুরু হয়। তবে কিছুদিন পর তিনি আবার গ্রামে ফিরে এসে লেখাপড়া চালিয়ে যান।
মোহাম্মদ নাসির আলী ১৯২৬ সালে তেলিরবাগ কালীমোহন-দুর্গামোহন ইনস্টিটিউশন থেকে প্রথম পরীক্ষা দেন এবং ১৯৩১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিকম ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর কলকাতা হাইকোর্টে কাজ শুরু করেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি ঢাকায় চলে আসেন এবং হাইকোর্টে কাজ করতে থাকেন। তবে তার মন সবসময় সাহিত্য ও প্রকাশনার প্রতি ছিল। ১৯৪৯ সালে তিনি ‘নওরোজ কিতাবিস্তান’ নামক একটি প্রকাশনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন, যা আজও বই প্রকাশ করছে।
মোহাম্মদ নাসির আলী বিশেষভাবে পরিচিত হয়েছেন তার শিশুসাহিত্য নিয়ে। ছোটদের জন্য লেখা তার গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধের মধ্যে রয়েছে আনন্দময়তার এক সমৃদ্ধ ভাণ্ডার। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৪০টিরও বেশি। হাস্যরস সৃষ্টিতে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। তার লেখা কয়েকটি বই হলো :
- লেবু মামার সপ্তকাণ্ড (১৯৬৮)
- বোকা বকাই (১৯৬৬)
- সাত পাঁচ গল্প (১৯৬৫)
- তিমির পেটে কয়েক ঘণ্টা
- মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা (১৯৭৬)
- শাহী দিনের কাহিনী (১৯৪৯)
- আকাশ যারা করলো জয় (১৯৫৭)
- আলবার্ট আইনস্টাইন (১৯৭৬)
মোহাম্মদ নাসির আলীর লেখায় মিষ্টি হাস্যরস, ছোটদের উপযোগী চিন্তা-ভাবনা এবং সাহসিকতার বার্তা থাকে। তিনি বিশ্বসাহিত্যের বিখ্যাত গল্পগুলোকে সহজ ভাষায় অনুবাদ করে শিশুদের জন্য উপস্থাপন করেছেন।
নাসির আলী ছিলেন সাহিত্য অন্তপ্রাণ মানুষ। দিন-রাত কাজের পর তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা লিখতেন। পড়তেন আরও বেশি। তিনি বিশ্বসাহিত্যের ক্লাসিক বইগুলো পড়ে বাংলায় সেসবের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। সে অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি ছোটদের জন্য লেখেন নতুন নতুন বই।
১৯৪৯ সালে ‘নওরোজ কিতাবিস্তান’ প্রতিষ্ঠা তার লেখালেখিকে আরও উজ্জ্বল করে তোলে। ১৯৫২ সালে তিনি ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকায় শিশু-কিশোর বিভাগের দায়িত্ব নেন এবং সেখানে ‘মুকুলের মহফিল’ নামক একটি বিশেষ বিভাগ চালাতেন। এখানে তিনি ছদ্মনাম ‘বাগবান’ ব্যবহার করতেন এবং ২৩ বছর এই বিভাগ পরিচালনা করেন।
মোহাম্মদ নাসির আলী তার সাহিত্যকর্মের জন্য বেশ কিছু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো :
- বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৭)
- ইউনেস্কো পুরস্কার (১৯৬৮)
- ইউনাইটেড ব্যাংক অব পাকিস্তান পুরস্কার
- মরণোত্তর জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র স্বর্ণপদক (১৯৭৮)
- ইসলামিক ফাউন্ডেশন স্বর্ণপদক (১৯৮৫)
মোহাম্মদ নাসির আলীর লেখায় মিশে আছে শিশুদের জন্য থাকে ভালোবাসা। হাস্যরসের মধ্য দিয়ে নানারকম শিক্ষা এবং মানবিকতার বীজ তিনি বুনে দেন শিশুমনের নরম বীজতলায়।
১৯৭৫ সালের ৩০ জানুয়ারি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মোহাম্মদ নাসির আলী ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুতে বাংলা শিশুসাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হারিয়ে যায়। তবে তার সাহিত্যকর্ম দিয়ে তিনি চিরকাল বেঁচে থাকবেন বাংলা শিশুসাহিত্যের পাঠকদের হৃদয়ে।
এমএইচএস