বই আলোচনা
নন্দনময় অনুভবের জারিত রূপ ‘স্মৃতির আকাশে ধ্রুবতারা’

সাঈফ ফাতেউর রহমান
প্রকাশ: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২১:৩১

‘স্মৃতির আকাশে ধ্রুবতারা’ মহান মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউল হকের নবতর কাব্যগ্রন্থ। জিয়াউল হক সাহিত্যাঙ্গনে নতুন মুখ নন। ইতোমধ্যেই তার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর আগ্রাসন এবং পাকি দোসরদের অমানবীয় পাশব তাণ্ডবের প্রতিপক্ষে প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রণাঙ্গনের সম্মুখযোদ্ধা তিনি। মুক্তিযুদ্ধ দিনের উন্মাতাল স্বদেশ, রক্ত-অশ্রু নদী অতিক্রান্ত স্বাধীন স্বদেশ পুনর্গঠনের অন্যতম অগ্রণী যোদ্ধা তিনি, অভয় চেতনা প্রভায় দেশমাতৃকার প্রতি নিষ্ঠ দায়বোধ সুসম্পাদন করার জন্য নিবেদিত থেকেছেন আজীবন।
ব্যস্ত কর্মজীবনের মাঝেও দেশ মাটি আর জনতার প্রতি কর্তব্যবোধ বিস্মৃত হননি তিনি। তাঁর মানস গঠনে পলিমাটি বিধৌত বাংলাদেশ সদাই বাঙ্ময়। পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি কলমচর্চা অব্যাহত রেখেছেন। অবসর গ্রহণের পরও পূর্ণ সক্রিয়তায় সৃজনী অভিযাত্রা অব্যাহত রেখেছেন তিনি। ইতোমধ্যেই গবেষণাধর্মী গ্রন্থ, উপন্যাস, কবিতার বেশ কয়েকটি গ্রন্থের প্রকাশনা তাঁকে ব্যাপক পরিচিতি এনে দিয়েছে। শৈলীগত সারল্য আর নিরাভরণতা পাঠককে আকৃষ্ট করে তাঁর লেখার প্রতি।
জনাব জিয়াউল হকের সৃজন প্রয়াসের বৃহদাংশ জুড়ে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অবিস্মরণীয় অবদান। কয়েকখণ্ডে কয়েকশত মুক্তিযোদ্ধার জীবনচিত্র এবং মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের প্রামাণ্য তথ্য তুলে ধরেছেন তিনি। এদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের এই অসামান্য দালিলিকতা ভবিষ্যৎ গবেষণার জন্য সমৃদ্ধ নির্দেশিকা হতে পারবে।
পাহাড় শুমারি এবং হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উপর গবেষণামূলক গ্রন্থ তাঁর ইতিহাস ঐতিহ্য মনস্কতার সাক্ষ্য বহন করে। বাংলাদেশের চা বাগানের ওপর তাঁর চলমান গবেষণামূলক কাজ একটি মাইল ফলক হিসেবে গণ্য হওয়ার যোগ্য।
বর্তমান কাব্যগ্রন্থ ‘স্মৃতির আকাশে ধ্রুবতারা’ দীর্ঘ জীবনের সঙ্গিনী প্রয়াত স্ত্রীর প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ, জীবনের পর্যায়ক্রমিক উত্তরণে চড়াই উতরাই, আনন্দ বেদনা, স্মৃতিময় যাপন পথ, অতিক্রমণের পর্যায় সারণি। স্ত্রীর দীর্ঘ অসুস্থতা, মানবিক বোধের স্ফুরণ, পারিবারিক সংহতি-সেবা-যৌথ পরিবারের মানবিক শুদ্ধতা ইত্যাকার বিষয়াবলি সরল স্বচ্ছন্দ অনাভরণতায় উদ্ভাসিত হয়েছে। গ্রন্থভুক্ত কয়েকটি কবিতা ব্যতীত ব্যাপক সংখ্যার নির্মিতিতেই এই আর্তি-স্মৃতি নানারূপে সুপ্রকাশিত।
সমগ্র কাব্যগ্রন্থটির কবিতার পর কবিতা পাঠকালে পাঠক তাই নিজ জীবন ও পারিবারিক আবহ, মায়া মমতা সুধাঞ্জন মাখা চিরায়ত বাঙালি পারিবারিক জীবনের স্বাদ আস্বাদন করবেন। কবিতাগুলি পাঠকালে পাঠকের মনে কবিতাগুলির কাব্যমানের বিবেচনা প্রাধান্য পাবে না। আত্মদর্শনে পাঠক নিজ জীবন ও পরিবারকে প্রত্যক্ষণ করবেন এবং একই সাথে বোধিক সত্তায় এমনই একটি মানবিক বোধ সম্পন্ন পারিবারিক আবহের স্বপ্নচারী হবেন।
কাব্যগ্রন্থটির প্রথম কবিতা ‘প্রার্থনা’ প্রয়াত সহধর্মিনীর প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগ এবং তার বিয়োগব্যথা সঞ্জাত অন্তঃকরণের সুনিবিড় বহিঃপ্রকাশ।
‘চোখের আড়ালে চলে গেছ তুমি
হৃদয়ের গভীরে গড়েছ দৃঢ় আবাস
দূর থেকে আরও কাছে এসেছ
সারাক্ষণ পাই তোমার চেনা সুবাস।...
... দুই হাত তুলে প্রার্থনা করি
হে খোদা পরওয়ারদেগার
তোমার বান্দিকে ক্ষমা করে দিও
খুলে দিও তার জান্নাতের দুয়ার।’
‘জীবন থেকে ছুটি’ কবিতায় প্রয়াত স্ত্রীকে সমাহিত করে ফেরার পর কবির অন্তর্যন্ত্রণা ও হাহাকার বিধৃত।
‘...গতকাল তোমাকে কবরে রেখে এসেছি,
তোমাকে ছাড়া আমার একটা রাত কেটে গেল;
তুইও একটা রাত কাটালে অন্ধকার কবরে।----------
তোমার সব কাজ থেকে আমাদের ছুটি দিয়ে দিয়েছ।
কিন্তু আমরা তো ছুটি চাইনি।
তবে তুমি কেন অভিমান করে চলে গেলে?...।’
যুগল জীবনের স্মৃতিচারণ আর নন্দনময় অনুভবের জারিত রূপ ‘স্মৃতির আকাশে ধ্রুবতারা’ কবিতায়। এই কবিতাটিই কাব্যগ্রন্থের শিরোনাম কবিতা। করোনাক্রান্ত স্ত্রী রোগমুক্ত হলেও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার অবক্ষয় তাঁকে সুদীর্ঘ কষ্টসাধ্য অবস্থায় ফেলে দেয় এবং পরপারে যাত্রার মাধ্যমেই যার অবসান ঘটে।
‘তোমার সাথে মোর কত শত স্মৃতি
বলো, কেমন করে তোমায় ভুলি?
তুমি ছিলে আমার স্বপ্ন সাধনা
মনের প্রশান্তি হৃদয়ের পুষ্পকলি।...
...তুমি করোনায় আক্রান্ত হয়ে রোগমুক্ত হলেও
অ্যাজমার রোগী হওয়ায় পুরোপুরি সুস্থ হলে না
... অভিমান করে চলে গেছ হয়েছ স্মৃতির আকাশে ধ্রুবতারা
তোমার সাজানো সংসার সামলাতে আমি হয়ে গেছি দিশেহারা।’
‘বেদনার নদী’ কবিতায় প্রিয়তমা স্ত্রীর বিয়োগজনিত বাস্তবতায় কবি এবং তার পরিবারের সকল সদস্যের শূন্যানুভবের বেদনা প্রমূর্ত হয়ে উঠেছে।
‘...তোমাকে ছাড়া আমরা সবাই অনেক কষ্টে আছি
সবসময় সবার বুকে গহিনে বাজে ব্যথার রাগিণী।
প্রকৃতির নিয়মে জগৎ সংসার সবই চলছে চলবে
কিন্তু তুমি আর কোনোদিন ফিরে আসবে না,
তোমাকে হারানোর বেদনা কোনোদিন মুছে যাবে না
তোমার স্মৃতিগুলো বেদনার নদী হয়ে প্রবাহিত হবে যুগে যুগে।’
স্ত্রীর অবর্তমানে ব্যথাতুর কবির একান্ত নিঃসঙ্গতা বোধের চিত্রায়ণ ‘একাকী জীবন’ কবিতাটি।
‘এখন আমি একা একা নিশ্চিন্তে পথ চলি
মন খারাপ হলে নিজের সাথেই কথা বলি
খাঁ খাঁ দুপুরের গরমে শালিক ডানা ঝাপটায়
আমার মনের ভেতর তখন বেদনার গান গায়।...।’
‘শান্তি সুখের ঠিকানা’ কবিতাটি সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি শুদ্ধ পারিবারিক আবহের প্রার্থিত আখ্যান।
‘...ভালোবাসা হলো একটি অদৃশ্য মায়ার বাঁধন
ইচ্ছে করলেই যে বাঁধন সহজে যায় না ছেঁড়া
ভালোবাসা হলো হৃদয়ের গভীর ধুকধুকানি
প্রতিক্ষার দীর্ঘ সময় সাধনা করে পাওয়া।“
‘দুই সহচরী’ কবিতাটি কিঞ্চিৎ ব্যতিক্রমী পরিবেশনা। নদী ও নারীর প্রতীকী ব্যাঞ্জনায় নান্দনিক সুরম্যতায় গীতল এই কবিতাটি।
‘... নদী হলো প্রকৃতির সৌন্দর্য জীবন চলার অনুপ্রেরণ
তার ছোঁয়ায় পৃথিবী সতেজ হয় মাটিতে ফলে শস্যদানা
নারীর মতো সেপো ব্যথাতুরা সাগরসঙ্গমে মিলতে চায়
চলার পথে কোনও মরুর বুকে হয়ত তা হারিয়ে যায়।...।’
পক্ষান্তরে ‘চাওয়া পাওয়া’ কবিতাটি চাহিদা আর প্রাপ্তির লভ্যতা অলভ্যতার দ্বান্দ্বিকতায় সুমিত।
‘... ভালোবাসা হলো স্বর্গের পবিত্র মেওয়া ফল।
দুনিয়াতে তাকে ধরতে গেলেই নানা বিপত্তি,
বরং দূর থেকে হৃদয়ে চিনচিনে ব্যথা নিয়ে
অনুভব করেই তার প্রকৃত মূল্য বোঝা যায়।’
‘ঝরো ঝরো মুখর বাদল ধারা’ বর্ষণমুখর অমাবস্যা রাতে মানবানুভবের চিত্রল উপস্থাপনা।
‘... হয়ত বা কোনো এক অমাবস্যার রাতে
আকাশ ভালোবেসেছিলো কোন এক উজ্জ্বল তারকাকে
প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে অনাদরে অবহেলায়
কত তারাই না ঝরে পড়ে আকাশ থেকে।
তাই বলে তার প্রিয়তমাও?...।’
‘গোলাপের জন্য প্রতীক্ষা’ রোমান্টিক আবহের সুখপাঠ্য গীতিময় কবিতা।
“অনেক সাধনার পর যেদিন তুমি প্রথম
মিষ্টি হেসে আমার দিকে ফিরে তাকালে
সেদিনও আমার দক্ষিণা বারান্দায় লাগালাম
একটা ছোট্ট লাল গোলাপের চারা।’
‘দূরে বহু দূরে’ প্রিয়জন হারানোর বেদনার ফল্গুধারার বহমানতায় ক্রন্দনবিধুর।
‘... তুমি প্রায়ই বলতে তোমার জন্য আমার বুকে অনেক মায়া।
অথচ সেই তুমিই আমার মায়া ভুলে
অস্থির সময়ে গা ভাসিয়ে হারিয়ে গেলে
ঢাকা শহরের ঘোর অন্ধকারে।
তোমাকে আলোর পথে ধরে রাখতে না পারার ব্যর্থতা আমার।’
ভিন্নস্বাদের কবিতা ‘নারী ও নদী’। নারী ও নদীর ভাঙ্গা গড়ার চিরায়ত প্রবাহে অভিন্ন সাযুস্যের অনবদ্য কাব্যিক প্রয়াস এই কবিতাটি।
‘... কীর্তিনাশা পদ্মা যেমন
ভেঙেচুরে তছনছ করে দেয়
সবুজ গ্রাম, গঞ্জ, শহর, সভ্যতা,
তেমনি তুমি ভেঙেচুরে
তছনছ করে দাও
আমার হৃদয়ের নরম ভূমি,
হৃদয়-মন সর্বস্ব হারিয়ে
আমি হয়ে যাই সর্বহারা।...।’
জলপ্রবাহের ঘাটতি ও শীর্ণ স্রোতোপ্রবাহের মন্দাক্রান্তা বাস্তবতার চিত্রায়ণ ‘নদী ও ঘাটের মাঝি’ কবিতাটি।
‘...আমার জল শুকিয়ে গেছে
যৌবনে পড়েছে টান
শীর্ণ শরীরে এগিয়ে চলেছি
বুকে নেই স্রোতের গান।...’
কাব্যগ্রন্থ ‘স্মৃতির আকাশে ধ্রুবতারা’ নিজ স্ত্রীর বিয়োগব্যথা জনিত স্মৃতিময়তা প্রধান কাব্যগ্রন্থ হলেও সামগ্রিকভাবে তা ব্যক্তিজীবনের সীমিত পরিসর পেরিয়ে বৃহত্তর জনজীবনের মানবীয়তার অনুভবে উচ্চকিত। পারিবারিক বন্ধন, ত্রি প্রজন্মের হার্দ্যিক সহাবস্থান, ক্রমভঙ্গুর যৌথ পরিবারের বাস্তবতার বিপরীতে মানবিক আখ্যান সমৃদ্ধ এই কাব্যগ্রন্থ পাঠকের কাছে একটি মানবিক শুভানুভবের বার্তা পৌঁছে দেয়।
একই সাথে কাব্যগ্রন্থ বাংলাদেশের বনানী, নদী, সাগর,পাহা্ড়, পর্যটন কেন্দ্র ইত্যাকার বিষয়াবলির সুরক্ষার প্রতিও দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। কবির মনোযোগী কলম প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতিও উদাসীন থাকেনি। সচেতন পাঠক অবশ্যই তা খেয়াল করবেন।
কাব্যগ্রন্থ ‘স্মৃতির আকাশে ধ্রুবতারা’ মুক্তিযোদ্ধা কবি জিয়াউল হককে কবিতা ভুবনে স্বচ্ছন্দ্যতর পথযাত্রায় উৎসাহিত করবে। আমরাও তাঁকে নবতর সৃজনে স্বাগত জানাতে চাই।
কাব্যগ্রন্থটির প্রকাশনার মান ভালো। প্রচ্ছদ রুচিসম্মত। মূল্য যৌক্তিক। ‘স্মৃতির আকাশে ধ্রুবতারা’র সার্বিক সাফল্য কামনা করি।
গ্রন্থের নাম : স্মৃতির আকাশে ধ্রুবতারা
গ্রন্থকার : জিয়াউল হক
গ্রন্থের প্রকৃতি : কাব্যগ্রন্থ
প্রথম প্রকাশ : অমর একুশে বইমেলা ২০২৫
স্বত্ব : লেখক
প্রকাশক : আরশিনগর
প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ
পরিবেশক : পাললিক সৌরভ;
মূল্য : ২০০ টাকা
- লেখক : শিক্ষাবিদ, কবি, অনুবাদক, গ্রন্থ সমালোচক ও পরিবেশ বিজ্ঞানী
এমএইচএস