আওয়ামী সরকারের পতনের পরে দেশ পরিচালনা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকারের অন্যতম প্রধান কাজ সুষ্ঠু ও সর্বজন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকেও দ্রুত নির্বাচনের জন্য সরকারকে তাগাদা দিচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিটি এবং নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। নবগঠিত নির্বাচন কমিশন প্রথম বৈঠকও করেছে।
প্রথম বৈঠকেই নির্বাচনী ট্রেনের ইঞ্জিন চালু করা হয়েছে। ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, খসড়া ভোটার তালিকা প্রণয়নে। যা দুই মাসের মধ্যে ভোটার তালিকার খসড়া চূড়ান্ত করে তালিকা প্রকাশ করা হবে বলেও জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল সানাউল্লাহ।
আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে সোমবার (২ ডিসেম্বর) নাসির উদ্দীন কমিশনের প্রথম বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি। এতে সভাপতিত্ব করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এম এম নাসির উদ্দীন। বৈঠকে চার নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার, আবদুর রহমানেল মাসুদ, তহমিদা আহমদ ও আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ অংশগ্রহণ করেন।
নির্বাচন কমিশন (কার্যপ্রণালী) বিধিমালার ৩(২) বিধি অনুযায়ী, কমিশনের বিভিন্ন কার্যক্রম নিষ্পন্নের জন্য চারজন নির্বাচন কমিশনারের নেতৃত্বে পৃথক চারটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া ভোটার তালিকা হালনাগাদ কর্মসূচি প্রণয়ন এবং জাতীয় সংসদের সীমানা নির্ধারণ নিয়ে পাওয়া আপত্তিগুলোর বিষয়ে নতুন কমিশনকে অবহিত করা হয়েছে।
সানাউল্লাহ বলেন, আগামী বছর ২ মার্চের পর থেকে ভোটার তালিকা হালনাগাদে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। হালনাগাদকৃত এসব ভোটার ২০২৬ সালে নতুন ভোটার হিসেবে যুক্ত হবে। এদিকে, ভোটার তালিকা আইন অনুযায়ী নিয়মতান্ত্রিকভাবেই নির্বাচন কমিশনের সংগ্রহে থাকা তথ্যের ভিত্তিতে আগামী জানুয়ারির ২ তারিখ থেকে মার্চের ২ তারিখের মধ্যে ভোটার তালিকার খসড়া ও চ‚ড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে।
আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, নতুন ভোটার হিসেবে যুক্ত হওয়ার জন্য আমাদের কাছে ১৭ লাখ নাগরিকের তথ্য সংগ্রহে রয়েছে। এসব নাগরিক ১ জানুয়ারি ২০২৫-এ ভোটার তালিকায় যুক্ত হবে। এই ১৭ লাখ নাগরিকের মধ্যে ১৩ লাখের তথ্য নির্বাচন কমিশন ২২ সালে সংগ্রহ করেছিল। বাকি নাগরিকরা নিজেরা নিবন্ধিত হয়েছেন।
তবে পরিসংখ্যান বলে ৪৫ লাখের মতো নাগরিকের নতুন ভোটার হিসেবে যুক্ত হওয়ার কথা। সেই হিসেবে ২৭-২৮ লাখ নাগরিক নিবন্ধিত হননি কিন্তু তারা ভোটার হওয়ার যোগ্য। এ কারণে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি এ বছরের হালনাগাদ ২ জানুয়ারি থেকে ২ মার্চের মধ্যে সম্পন্ন হবে। এরপর আমরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করব। বাদ পড়া এসব নাগরিকসহ ২০২৬ সালে ভোটার হওয়ার উপযুক্ত হবেন এমন নাগরিকের তথ্য সংগ্রহ করা হবে। একই সঙ্গে যে সব ভোটার মৃত্যুবরণ করেছে তাদের নাম ভোটার তালিকা থেকে কর্তন করার জন্য তথ্য নেওয়া হবে।
এছাড়া দ্বৈত ভোটার বা অন্য কোনো জটিলতা আছে কিনা সে সব বিষয়েও তথ্য সংগ্রহ করা হবে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের তথ্য সংগ্রহ করা হবে। তারা ২০২৬ সালে নতুন ভোটার হিসেবে যুক্ত হবেন। এর মাধ্যমে আমরা শুদ্ধ এবং পূর্ণাঙ্গ তথ্যের ভিত্তিতে শতভাগ সঠিকতা নিশ্চিত করতে পারব। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহসহ যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করতে ছয় মাসের মতো সময় লাগবে।
সভায় চারজন কমিশনারের অধীনে চারটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিগুলো হলো- ইসি সানাউল্লাহর নেতৃত্বে ‘জাতীয় পরিচয়পত্র, ভোটার তালিকা, নির্বাচন ব্যবস্থাপনা ও তথ্যপ্রযুক্তি কমিটি’, ইসি আব্দুর রহমানেল মাসুদের নেতৃত্বে ‘আইন ও বিধিমালা সংস্কার কমিটি’, ইসি মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকারের নেতৃত্বে ‘সীমানা পুনঃনির্ধারণ, জাতীয় স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন প্রস্তুতি, ভোটকেন্দ্র স্থাপন, ভোট গ্রহণকারী কর্মকর্তাদের প্যানেল প্রস্তুত ও তদারকি কমিটি’ এবং ইসি তহমিদা আহমদের নেতৃত্বে ‘নিয়োগ, পদোন্নতি, প্রশাসনিক সংস্কার ও পুনর্বিন্যাস এবং দক্ষতা উন্নয়ন কমিটি।’
ইসি সানাউল্লাহ বলেন, সংসদীয় আসনের সীমানা নিয়ে কিছু অভিযোগ ছিল। এ নিয়ে তেমন আলোচনা হয়নি। এই অভিযোগগুলো কমিশনের গঠিত সংশ্লিষ্ট কমিটির কাছে প্রেরণ করা হয়েছে। পরবর্তীতে এ নিয়ে আলোচনা করা হবে।
বৈঠক শেষে ইসির অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী নেওয়াজ বলেন, জানুয়ারির ২ তারিখে আইন অনুযায়ী প্রতিবছর ভোটার তালিকা হালনাগাদের খসড়া প্রস্তুত করে প্রকাশ করা হয়। এ খসড়া তালিকা প্রকাশ করার পর কেউ যদি মনে করে সে খসড়া তালিকার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়নি, তখন তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ভোটার হওয়ার যোগ্য হলে ভোটার হিসেবে গণ্য করা হয়।
তিনি বলেন, এ কাজ শেষ করতে হয় মার্চের ২ তারিখের মধ্যে বা তার আগে। কারণ ২ তারিখে এ সংশোধনী বা আমাদের ডাটাবেজে আগের যে তথ্য থাকে তার আলোকে তারা (যাদের প্রতি বছর ১ জানুয়ারিতে ১৮ বছর পূর্ণ হয়) ওই বছরেই ভোটার তালিকায় যুক্ত হয়। এ কাজটা আমাদের সামনে করতে হবে। এ বিষয়ে কমিশনের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। এর বাইরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্য কি কি প্রস্তুতি প্রয়োজন সে প্রস্তুতি সম্পর্কে আমরা কমিশনকে অবহিত করেছি।
ভোটার তালিকা হালনাগাদ করতে ইসি সচিবালয়ের কি প্রস্তুতি আছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কমিশন যদি আমাদের বলে তাহলে আমাদের সেটা করতে হবে। তবে, আমাদের প্রস্তুতির কথা যদি বলেন তাহলে ঠিক এ মূহূর্তে নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না যে প্রস্তুতি আছে কি না। কমিশন যেভাবে চাইবে সেভাবে আমাদের শেষ করতে হবে এবং সে প্রস্তুতি আমাদের গ্রহণ করতে হবে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে হালনাগাদ করতে হয় তাহলে আমাদের কী করতে হবে এ বিষয়ে আমরা আলোচনা করেছি।
আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মো. শাহ আলম এক বক্তব্যে বলেন, জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠা হলেও এখনো নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা হয়নি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। দেশকে নৈরাজ্যমুক্ত করতে হলে দ্রুত প্রয়োজনীয় সংস্কার করে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার বিকল্প নেই।
সম্প্রতি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, জরুরি সংস্কার শেষে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করবে সরকার। তবে সেটি সব রাজনৈতিক দল ও অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করা হবে। সংস্কার কমিশন থেকে প্রস্তাব আসবে, জনগণ কথা বলবে। চ‚ড়ান্ত সংস্কার প্রস্তাবনা হবে। সেই মোতাবেক যে পদক্ষেপ নেওয়ার তা নেব। আমরা বারবার বলেছি যত দ্রুত সম্ভব জরুরি সংস্কারগুলো শেষে নির্বাচনের তারিখ জানিয়ে দেব।
সম্প্রতি নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, নির্বাচনসংশ্লিষ্ট অন্য জরুরি সংস্কারের বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে এবং সংস্কারের জন্য যৌক্তিক সময় দেওয়া উচিত। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে ভোটার তালিকা সংশোধন ও হালনাগাদ করা জরুরি। জাতীয় পরিচয়পত্রকে ভিত্তি করে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা যেতে পারে। অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের স্বার্থে দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান মনোনয়ন বাণিজ্য বন্ধের উপায় বের করতে হবে। আগামী নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের ওপর কোনো রাজনৈতিক চাপ থাকবে না। তাই কমিশন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করবে বলে আশা করা যায়।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে গঠিত কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গত ৫ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করে। এরপর নতুন কমিশন গঠনে আইন অনুযায়ী সার্চ কমিটি গঠন করা হয়। সার্চ কমিটি প্রস্তাবিত তালিকা থেকে পাঁচজনকে বেছে নিয়ে গত ২১ নভেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের আদেশক্রমে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারি করা পৃথক প্রজ্ঞাপনে নির্বাচন কমিশনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ অন্যান্য নির্বাচন এ কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে। ২৪ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট জাজেজ লাউঞ্জে নাসির উদ্দীন নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনকে শপথ পড়ান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ।