Logo
Logo

জাতীয়

ভারতের অর্ধশত গণমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে মিথ্যা সংবাদ

Icon

বাসস

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩:২২

ভারতের অর্ধশত গণমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে মিথ্যা সংবাদ

রিউমার স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা গেছে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ১২ আগস্ট থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রচারিত অন্তত ১৩টি ভুয়া খবর পাওয়া গেছে।

এমন ভুয়া খবর প্রচারের তালিকায় ভারতের অন্তত ৪৯টি গণমাধ্যমের নাম উঠে এসেছে। এর মধ্যে রিপাবলিক বাংলা সর্বাধিক পাঁচটি গুজব প্রচার করেছে। পরবর্তী অবস্থানে রয়েছে হিন্দুস্তান টাইমস, জি নিউজ ও লাইভ মিন্ট, যারা প্রত্যেকে অন্তত তিনটি করে গুজব প্রকাশ করেছে। এছাড়া রিপাবলিক, ইন্ডিয়া টুডে, এবিপি আনন্দ ও আজতক অন্তত দুটি করে গুজব প্রচার করেছে।

এসব গুজবের মধ্যে ছিল- শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর তার নামে ভুয়া খোলা চিঠি, মুসলিম ব্যক্তির নিখোঁজ পুত্রের সন্ধানে মানববন্ধন করার ভিডিওকে হিন্দু ব্যক্তির দাবিতে প্রচার, ড. মুহাম্মদ ইউনূস আইসিইউতে ভর্তি হওয়ার ভুয়া খবর, বাংলাদেশে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ভিত্তিহীন দাবি, ট্রাম্পের বিজয়ের পর ড. ইউনূস ফ্রান্সে পালিয়ে যাওয়ার ভুয়া দাবি, পাকিস্তানি জাহাজের মাধ্যমে অস্ত্র আনার মিথ্যা দাবি, নিহত আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে চিন্ময় কৃষ্ণের আইনজীবী হিসেবে প্রচার, বাংলাদেশে ভারতীয় চ্যানেল বন্ধ হওয়া গুজব, বাংলাদেশে মুসলিমদের হামলায় হিন্দু মন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুরের দাবিতে ভারতের প্রতিমা বিসর্জনের ভিডিও প্রচার, শ্যামলী পরিবহনের বাসে হামলার মিথ্যা তথ্য, চিন্ময় কৃষ্ণের আইনজীবীর ওপর হামলার ভুয়া দাবি এবং বাংলাদেশে জঙ্গি হামলা হতে পারে জানিয়ে যুক্তরাজ্য ভ্রমণ সতর্কতা জারির বিভ্রান্তিকর খবর।

৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর শেখ হাসিনা দিল্লি থেকে জনগণের উদ্দেশে একটি খোলা চিঠি দিয়েছেন এবং ওই চিঠিতে তার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেছেন দাবিতে ভারতীয় গণমাধ্যমে একটি তথ্য ছড়িয়ে পড়ে।

যদিও জানা যায়, শেখ হাসিনা এমন কোনো চিঠি দেননি। রিউমার স্ক্যানারের অনুসন্ধানে উঠে আসে, এই চিঠিটি প্রথমে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে এবং পরবর্তীতে ভারতের আগরতলা ভিত্তিক দৈনিক ‘ত্রিপুরা ভবিষ্যত’ পত্রিকার প্রিন্ট সংস্করণে তারিখসহ প্রকাশিত হয়। এরপর, ওই পত্রিকার স্ক্রিনশটটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে শেয়ার হতে থাকে এবং পরবর্তীতে ভারতের ও বাংলাদেশের কয়েকটি গণমাধ্যমেও এটি প্রচারিত হয়।

৫ আগস্টের পর ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমে একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে দাবি করা হয়, একজন হিন্দু ব্যক্তি তার নিখোঁজ পুত্রের সন্ধান দাবিতে মানববন্ধন করছেন। তবে রিউমার স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, ওই ব্যক্তি আসলে মুসলিম ও তার নাম বাবুল হাওলাদার। ২০১৩ সালে নিখোঁজ হওয়া ছেলের সন্ধানে মানববন্ধন করেছিলেন তিনি।

শেখ হাসিনা ক্ষমতা হারানোর পর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়। ভারতীয় গণমাধ্যমে দাবি করে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস অসুস্থ হয়ে আইসিইউতে ভর্তি হয়েছেন। এ দাবির সঙ্গে একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ব্যক্তির ছবিও প্রকাশিত হয়। তবে রিউমার স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, ছবিটি ড. ইউনূসের নয়। ছবিটি সাম্প্রতিক সময়ের কিংবা বাংলাদেশেরও কোনো ছবি নয়। প্রকৃতপক্ষে ড. ইউনূস সুস্থ রয়েছেন।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বাংলাদেশে বেশ কিছু নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করে ভারতীয় গণমাধ্যম। তবে, রিউমার স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে এই দাবির কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। কোনো প্রকার নির্ভরযোগ্য তথ্য ও প্রমাণ ছাড়া ভারতীয় গণমাধ্যমে এই মিথ্যা দাবি প্রচারিত হয়।

৫ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ী হন। ট্রাম্পের বিজয়ের পর, ভারতীয় গণমাধ্যমে একটি দাবি ছড়িয়ে পড়ে যে, ড. মুহাম্মদ ইউনূস ফ্রান্সে পালিয়ে গেছেন। তবে রিউমার স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, এই দাবি মিথ্যা। পালানোর প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত বিমানের ছবিটি ৮ আগস্ট ড. ইউনূসের ফ্রান্স থেকে বাংলাদেশে ফেরার সময়ের।

স্বাধীনতার পর গত ১৩ নভেম্বর প্রথমবারের মতো সরাসরি পাকিস্তানের করাচি থেকে কনটেইনার বহনকারী একটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করে। এ নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে দাবি করা হয়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের ‘সোয়াত’ নামের যে সামরিক জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে এসেছিল, সেই জাহাজ আবারও চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছেছে। আরও দাবি করা হয়, ওই জাহাজে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে অস্ত্র আনা হচ্ছে। তবে, রিউমার স্ক্যানারের অনুসন্ধানে এসব দাবির কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। জাহাজটির নাম ‘এমভি ইউয়ান জিয়ান ফা ঝং’। এটি একটি বাণিজ্যিক জাহাজ। এর মাধ্যমে শিল্পের কাঁচামাল ও ভোগ্যপণ্য আনা হয়েছে।

২৫ নভেম্বর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগে বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। 

পরদিন ২৬ নভেম্বর তাকে চট্টগ্রাম আদালতে হাজির করা হলে জামিন নামঞ্জুর করা হয়। এর পর আদালত প্রাঙ্গণে উত্তেজনা সৃষ্টি হলে চিন্ময়কে প্রিজন ভ্যানে তুলে কারাগারে পাঠানোর চেষ্টা করা হয়। এসময় তার অনুসারীরা বিক্ষোভ শুরু করলে পুলিশ ও বিজিবি লাঠিপেটা এবং সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে। সংঘর্ষের মধ্যে চট্টগ্রাম জেলা আদালতের আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ নিহত হন। ভারতীয় গণমাধ্যমে দাবি করা হয় যে, সাইফুল ইসলাম চিন্ময়ের আইনজীবী হওয়ায় তাকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু এই দাবি সঠিক নয়। চিন্ময়ের আইনজীবী শুভাশীষ শর্মা, সাইফুল ইসলাম নন।

ভারতীয় কিছু গণমাধ্যমে দাবি করা হয়, বাংলাদেশে ভারতীয় স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর সম্প্রচার বন্ধ করা হয়েছে। তবে রিউমার স্ক্যানারের অনুসন্ধানে চ্যানেলগুলো এখনও সচল থাকতে দেখা যায়। একই সঙ্গে, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এবং ক্যাবল অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বিষয়টি গুজব বলে রিউমার স্ক্যানারকে নিশ্চিত করে।

ভারতীয় কতিপয় গণমাধ্যমে দাবি করা হয়, বাংলাদেশ বিমান বাহিনী চীনের প্রযুক্তিগত সহায়তায় চিকেন নেকের কাছে এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম বিমানঘাঁটি নির্মাণ করবে। তবে রিউমার স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, এই দাবি পুরোপুরি মিথ্যা। 

লালমনিরহাটের বিমানবন্দর দীর্ঘ ছয় দশক ধরে বন্ধ রয়েছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে এর কার্যক্রম পুনরায় চালুর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

সম্প্রতি, বাংলাদেশে মুসলিমদের দ্বারা হিন্দু মন্দিরে হামলা করে প্রতিমা ভাঙচুরের অভিযোগে একটি ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে। এই দাবি ভারতের কিছু গণমাধ্যমেও প্রচারিত হয়। তবে রিউমার স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, ভিডিওটি বাংলাদেশে নয়, বরং ভারতের পূর্ব বর্ধমান জেলার খণ্ডঘোষ সুলতানপুর গ্রামে প্রতিমা বিসর্জনের দৃশ্য। ভিডিওটি বাংলাদেশের হিন্দু মন্দিরে হামলার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।

বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ঢাকা-আগরতলা-ঢাকা রুটে শ্যামলী পরিবহনের একটি বাসের সাথে বাংলাদেশি ট্রাকের সংঘর্ষ ঘটানোর দাবিতে ভারতের কিছু গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচারিত হয়। আরও দাবি করা হয়, শ্যামলী পরিবহনের বাসে থাকা ভারতীয় যাত্রীদের স্থানীয়রা প্রাণনাশের হুমকি দেয় এবং ভারতবিরোধী স্লোগান দেয়। 

তবে, রিউমার স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, এই দাবিগুলোর কোনো সত্যতা নেই। ইচ্ছাকৃতভাবে নয়, দুর্ঘটনাটি মূলত ওভারটেকিংয়ের কারণে ঘটেছিল।

চিন্ময় দাসের গ্রেপ্তারকে কেন্দ্র করে হাসপাতালের চিকিৎসাধীন এক ব্যক্তির ছবি নিয়ে বিভিন্ন গুজব ছড়ানো হয়। দাবি করা হয়, ওই ব্যক্তি রমেন রায়, যিনি চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের আইনজীবী। আরও বলা হয়, মুসলিমরা তার বাড়ি ভাঙচুর করে এবং হামলা চালিয়ে তাকে আইসিইউতে ভর্তি করেছে। তবে রিউমার স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা গেছে, রমেন রায় চিন্ময় দাসের আইনজীবী নন এবং তার মামলার সঙ্গেও কোনো সম্পর্ক নেই।

প্রকৃতপক্ষে, ২৫ নভেম্বর শাহবাগে চিন্ময় দাসের গ্রেপ্তার বিরোধী সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কর্মসূচিতে দুর্বৃত্তদের হামলায় রমেন রায় আহত হন। তবে তার বাড়ি ভাঙচুরের খবর বা কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

বাংলাদেশে যেকোনো সময় জঙ্গি হামলা হতে পারে জানিয়ে যুক্তরাজ্য ভ্রমণ সতর্কতা দিয়েছে দাবিতে একটি তথ্য ভারতীয় কিছু গণমাধ্যম প্রচারিত হয়েছে।

তবে যুক্তরাজ্যের ভ্রমণ সতর্কতা কেবলমাত্র বাংলাদেশে নয় বরং ভারত, ইন্দোনেশিয়া, জার্মানি, স্পেন, শ্রীলঙ্কা, ফ্রান্সসহ বিশ্বের অনেক দেশ অন্তর্ভুক্ত ছিল।

ওএফ

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর