প্রতিবেদন হস্তান্তর
গুমের সঙ্গে হাসিনার সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে কমিশন
বাংলাদেশের প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০:১৬
জোরপূর্বক গুমের ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততা খুঁজে পেয়েছে গুম সংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারি। একই সঙ্গে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী অভিযুক্ত করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে (র্যাব) বিলুপ্তিরও সুপারিশ করেছে কমিশন।
শনিবার (১৪ ডিসেম্বর) বিকেলে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে গুম সংক্রান্ত কমিশন তাদের প্রথম অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের কমিশন ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার কাছে ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ’ শীর্ষক প্রতিবেদন হস্তান্তর করে।
‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ’ শিরোনামে জমা দেওয়া রিপোর্টে কমিশন সদস্যরা এ পর্যন্ত প্রাপ্ত এক হাজার ৬৭৬টি অভিযোগের মধ্যে ৭৫৮ জনের অভিযোগ যাচাই-বাছাই করেন বলে জানানো হয়।
গুমের ঘটনায় নির্দেশদাতা হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছে কমিশন। এ ছাড়াও হাসিনা প্রশাসনের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারও সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।
যাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান এবং পুলিশ কর্মকর্তা মো. মনিরুল ইসলাম ও মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।
গুমের শিকার ব্যক্তিদের বিচারিক প্রক্রিয়া শুরুসহ র্যাব বিলুপ্তির সুপারিশ করেছে কমিশন।
কমিশন প্রধান মইনুল ইসলাম চৌধুরী জানান, গুমের সাথে জড়িত কর্মকর্তারা কাজটি এমনভাবে করেছেন যাতে এগুলো শনাক্ত করা কঠিন হয়ে যায়। বিভিন্ন ফোর্স নিজেদের মধ্যে ভিকটিম বিনিময় করেছে এবং পরিকল্পনা ভিন্ন ভিন্নভাবে বাস্তবায়ন করেছে।
তিনি আরও জানান, গুমের শিকার অনেকে এখনো শঙ্কামুক্ত হতে পারছেন না। তাদের ওপর এতটাই ভয়াবহ নির্যাতন চালানো হয়েছে যে তারা এখনো ট্রমায় ভুগছেন।
প্রধান উপদেষ্টা তার সর্বশেষ বক্তব্যে গুমের শিকার ব্যক্তিদের সুরক্ষা ও সঠিক বিচারের আশ্বাস দেওয়ার পর রিপোর্টের সংখ্যা অনেক বেড়েছে উল্লেখ করে কমিশনের সদস্যরা অধ্যাপক ইউনূসকে আয়নাঘর পরিদর্শনের অনুরোধ জানান।
তারা বলেন, ‘আপনি আয়নাঘর পরিদর্শন করলে ভিক্টিমরা অভয় পেতে পারেন।’
প্রধান উপদেষ্টা তাদের এ অনুরোধে সম্মতি দিয়ে জানান, স্বল্প সময়ের মধ্যেই তিনি জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেল যা আয়নাঘর নামে পরিচিতি পেয়েছে সেগুলো দেখতে যাবেন।
তিনি কমিশন সদস্যদের তাদের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনের জন্য ধন্যবাদ জানান এবং কাজটি এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সব সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
কমিশন প্রধান মইনুল ইসলাম চৌধুরী জানান, তারা তিন মাস পর মার্চে আরও একটি ইন্টেরিম রিপোর্ট দেবেন। কাজটি শেষ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে কমপক্ষে আরও এক বছর সময় প্রয়োজন বলে জানান তিনি।
কমিশনের সদস্য হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. ফরিদ আহমেদ শিবলী, মানবাধিকারকর্মী নূর খান, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নাবিলা ইদ্রিস ও মানবাধিকার কর্মী সাজ্জাদ হোসেন এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
আরও উপস্থিত ছিলেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, সমাজকল্যাণ এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গুমের ঘটনা তদন্তে হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলামের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট এই কমিশন গঠন করে সরকার। গত ২৭ আগস্ট কমিশন গঠন করা হয়।
কমিশন গঠন সম্পর্কে গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে গত ৫ আগস্ট পর্যন্ত দেশের আইনশৃঙ্খলা প্রয়োগকারী সংস্থার (পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, সিআইডি, বিশেষ শাখা, গোয়েন্দা শাখা, আনসার ব্যাটালিয়ন, এনএসআই, ডিজিএফআই, কোস্টগার্ড) কোনো সদস্য দ্বারা গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানে সরকার এই কমিশন গঠন করে।
গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গুমের ঘটনায় ভুক্তভোগী নিজে অথবা পরিবারের কোনো সদস্য বা আত্মীয়স্বজন বা গুমের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী যেকোনো ব্যক্তি অভিযোগ দাখিল করতে পারবেন। সশরীর কমিশনের কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে, ডাকের মাধ্যমে অথবা কমিশনের ই-মেইলে লিখিতভাবে অভিযোগ করতে পারবেন। সে অনুযায়ী অভিযোগ দাখিল করেন ভিকটিম ও তাদের স্বজনরা।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পদত্যাগ করে ৫ আগস্ট দেশ থেকে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে টানা প্রায় ১৬ বছরের শাসনের পতন হয়। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সংস্কারে উদ্যোগ নেয়। গঠিত হয় বিভিন্ন সংস্কার কমিশন। এরই ধারাবাহিকতায় গুম কমিশন গঠিত হয়।
এমএম/ওএফ