ফিরল তত্ত্বাবধায়ক
বিগত তিন নির্বাচনে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন হয়নি
বাংলাদেশের প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২:০৫
বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলসহ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে আনা কয়েকটি বিষয় অবৈধ ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে সংবিধানে গণভোটের বিধান ফিরিয়ে এনেছেন উচ্চ আদালত। তবে পঞ্চদশ সংশোধনী পুরোটা বাতিল করা হয়নি। রিটকারীদের আইনজীবীরা পঞ্চদশ সংশোধনী সম্পূর্ণ বাতিল চেয়েছিলেন। আদালত সংবিধানে জাতির জনক, সাতই মার্চসহ কয়েকটি ধারা সংসদের জন্য ‘রেখে দিয়েছেন’।
আদালত বলেছেন, বাকিগুলোর বৈধতাও তিনি দিচ্ছেন না। সেগুলো ভবিষ্যৎ সংসদের জন্য রেখে দিয়েছেন। ভবিষ্যৎ সংসদ জাতির প্রয়োজন অনুযায়ী সেগুলো রাখতে পারে অথবা বাতিল করতে পারে। এরই মধ্যে দিয়ে বহাল হলো নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। এদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুরনায় বহাল হওয়ায় খুশি বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। তাদের ভাষ্য, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে আনা কয়েকটি বিষয় অবৈধ ঘোষণায় জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন হয়েছে।
আদালত পর্যবেক্ষণে বলেছেন, গণতন্ত্র আমাদের সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ। এই গণতন্ত্র বিকশিত হয় অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপক্ষে এবং প্রভাবমুক্ত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে বিগত তিনটি সংসদ নির্বাচনে জনগণের ইচ্ছার কোনো প্রতিফলন হয়নি। দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের আত্মবিশ্বাস জনগণের মধ্যে জন্ম নেয়নি। যার ফলশ্রুতিতে হয়েছে জুলাই গণঅভ্যুত্থান।
রায়ে হাইকোর্ট বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা জনগণের অভিপ্রায় অনুযায়ী সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল এবং এটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশে পরিণত হয়েছে। মঙ্গলবার বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্তিসংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ২০ ও ২১ অনুচ্ছেদ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করে এ রায় দেন হাইকোর্ট।
রায়ে আদালত বলেন, অনুচ্ছেদ দুটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে ধ্বংস করেছে, যেটি হচ্ছে গণতন্ত্র। পঞ্চদশ সংশোধনী মাধ্যমে সংবিধানে যুক্ত ৭ক, ৭খ, ৪৪ (২) অনুচ্ছেদ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করেছেন আদালত। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৫৪টি ক্ষেত্রে সংযোজন, পরিমার্জন ও প্রতিস্থাপন আনা হয়েছিল।
রায়ে আদালত আরও বলেছেন, পঞ্চদশ সংশোধনী আইন পুরোটা বাতিল হচ্ছে না। বাকি বিধানগুলোর বিষয়ে আগামী জাতীয় সংসদ আইন অনুসারে জনগণের মতামত নিয়ে সংশোধন, পরিমার্জন ও পরিবর্তন করতে পারবে। এর মধ্যে জাতির পিতার স্বীকৃতির বিষয়, ২৬ মার্চের ভাষণের বিষয়গুলোও রয়েছে।
রায়ের বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে বাংলাদেশের খবরকে তিনি বলেন, জনগণ আবার সঠিকভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন। বিএনপি ও জনগণের পক্ষ থেকে আমরা উচ্চ আদালতকে ধন্যবাদ জানাই। এই রায়ের মাধ্যমে জনগণের মতামত প্রতিফলিত হয়েছে। জনগণ এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিয়ে তিনবার প্রমাণ করেছে, তারা ভোটের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন করতে পারে।
তিনি বলেন, আমাদের নেত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করেছিলেন; যাতে জনগণ সঠিকভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। আমরা গত ১৫ বছর সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করেছি। ফলে উচ্চ আদালতের এ রায়ে আমরা খুশি, জনগণও খুশি। এ রায়ে জনগণ তাদের অধিকার ফিরে পাবেন, তারা দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি ও সাবির্ক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে সহায়ক হবে।
এদিকে আদালতের এই রায়ে জনগণের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে উল্লেখ করে দেশের জনগণকে অভিনন্দন জানিয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার।
তিনি বলেন, ২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয়। এই সংশোধনীর মাধ্যমে জনগণের ভোট ও নির্বাচন ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা হয়েছিল। এই সংশোধনীর মাধ্যমে বিনা ভোটে ক্ষমতা দখলের প্রবণতা তৈরি হয়। ফলে গত ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। নির্বাচনের নামে তামাশা হয়েছে মাত্র।
তিনি আরো বলেন, ‘মূলত পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হয়েছে। ১৭ ডিসেম্বর দেশের উচ্চ আদালতের রায়ে জনগণের অধিকার পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হলো। এটি জনগণের আরেকটি বিজয়। আমরা দেশবাসীকে এই আইনি লড়াইয়ে জনগণের ভোটাধিকার পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় আন্তরিক অভিনন্দন ও মোবারকবাদ জানাচ্ছি।
উচ্চ আদালতের এই রায়ের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফেরার দ্বার উন্মোচিত হওয়ায় সন্তষ্টি প্রকাশ করে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, আমি খুব উৎফুল্ল, আনন্দিত। আমি মনে করি এটা ঐতিহাসিক রায়, সেমিনাল জাজমেন্ট। পুরো দেশবাসীর জন্য আজ আমি আনন্দিত।
তিনি বলেন, এই রায়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরে আসার একটা গুরুত্বপূর্ণ দ্বার উন্মোচিত হলো। তবে এটা নির্ভর করবে ভবিষ্যতে কীভাবে আচরণ করা হয়। গণতন্ত্র ফিরে আসা, গণতান্ত্রিক উত্তরণ মানে একটা পরিবর্তন। সবাই যদি আচরণে পরিবর্তন আনে, রাজনীতিবিদেরা যদি তাদের আচরণে পরিবর্তন আনেন, সবাই নিজেদের করণীয় করেন, তাহলে গণতন্ত্র ফিরে আসবে। আর তা না হলে ফিরবে না।
প্রসঙ্গত, ২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয়। এই সংশোধনীর মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির জনক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এই সংশোধনীর দ্বারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। এছাড়া জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন সংখ্যা বিদ্যমান ৪৫-এর স্থলে ৫০ করা হয়। এছাড়া আরও বেশকিছু বিষয়ে সংশোধনী আনা হয়।
এমএম/ওএফ