দেশে এইচএমপিভি ভাইরাস শনাক্ত
আতঙ্ক নয়, প্রয়োজন সতর্কতা
তরিকুল ইসলাম সুমন
প্রকাশ: ১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১৪:০৫
করোনা মহামারির পর বিশ্বে নতুন করে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে মেটানিউমো ভাইরাস (এইচএমপিডি)। এ বছর চলতি মাসের শুরুতে চীনে প্রথম এর সংক্রমণ ধরা পড়ে। এরপর জাপানে ভাইরাসটি শনাক্ত হয়। এখন এইচএমপিডির প্রাদুর্ভাব মালয়েশিয়া ও ভারতেও ছড়িয়েছে। সবশেষ গতকাল আমাদের দেশেও একজনের দেহে শনাক্ত হয়েছে ভাইরাসটি। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ভাইরাস নিয়ে এখনই আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। এটি নতুন কোনো ভাইরাসও নয়। তবে একে অবহেলা করলে চলবে না। সরকারি বিভিন্ন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
গতকাল রোববার (১২ জানুয়ারি) দেশে একজন নারীর শরীরে এইচএমপিভি ভাইরাস শনাক্তের বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ শাখার লাইন ডিরেক্টর ডা. হালিমুর রহমান জানিয়েছেন, একজন নারীর শরীরে এইচএমপিডি ভাইরাস পাওয়া গেছে। তবে তিনি ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত। যার মাঝে ভাইরাস হচ্ছে এইচএমপিডি ও ব্যাকটেরিয়া হচ্ছে ক্লেবসিয়েলা নিউমোনিয়া। নিউমোনিয়ার ব্যাকটেরিয়ায় ওনার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। তবে এইচএমপিডির কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত না। আক্রান্ত নারী ভৈরবের বাসিন্দা। বর্তমানে তিনি রাজধানীর মহাখালী সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই ঘাবড়ানোর কিছু নেই। কেননা চীনের সরকার বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডব্লিউএইচও কেউই এখনো আনুষ্ঠানিক সতর্কতা জারি করেনি। এই ভাইরাস ভয়াবহ আকার ধারণ করবে কী-না সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞরাও কোনো সতর্ক বার্তা দেননি। তবে, রোগটি যাতে না হয় সে বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। এইচএমপিডি সংক্রমিত হলে সাধারণ জ্বর বা ফুর মতো উপসর্গ দেখা যায়। সঙ্গে কাশি, জ্বর, নাক বন্ধ এবং শ্বাসকষ্ট হতে পারে। সঙ্গে চামড়ায় র্যাশ বা দানা দানা দেখা দিতে পারে। তবে, কারও কারও জন্য এসব উপসর্গ মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে।
এইচএমপিভি ভাইরাস প্রতিরোধে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাত নির্দেশনা
হিউম্যান মেটানিউমো ভাইরাস (এইচএমপিভি) সংক্রমণ রোধে সাত নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এগুলো হলো- শীতকালীন শ্বাসতন্ত্রের রোগসমূহ থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য মাস্ক ব্যবহার, হাঁচি কাশি সময়/বাহু/টিস্যু দিয়ে নাক মুখ ঢেকে রাখা, ব্যবহৃত টিস্যুটি অবিলম্বে ঢাকনাযুক্ত ময়লা ফেলার ঝুড়িতে ফেলুন এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার অথবা সাবান পানি দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলা, আক্রান্ত হয়েছেন এমন ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন এবং কমপক্ষে তিন ফুট দুরত্ব বজায় রাখা, ঘনঘন সাবান ও পানি কিংবা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধোয়া (অন্তত ২০ সেকেন্ড), অপরিষ্কার হাতে চোখ, নাক, মুখ না ধরা এবং জ্বর, কাশি এবং শ্বাসকষ্ট আক্রান্ত হলে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত বাড়িতে অবস্থান করার নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।
সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, চীনসহ উপমহাদেশে বিভিন্ন দেশে এইচএমপিড়ি ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব এবং ভাইরাসের তীব্রতা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে ১৪ বছরের কম বয়সী শিশু এবং ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সী ব্যক্তিদের মধ্যে এই রোগের সংক্রমণ বেশি দেখা যায়। সেই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন- হাঁপানি বা ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ, গর্ভবর্তী মহিলা এবং দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য উচ্চ ঝুঁকি সৃষ্টি হতে পারে। পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও এই রোগের সংক্রমণ দেখা যায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আরও জানিয়েছে, হিউম্যান মেটানিউমো ভাইরাস অন্যান্য শ্বাসতন্ত্রের রোগের মতো ফু'র উপসর্গ সৃষ্টি করে। যা সাধারণত ২ থেকে ৫ দিনের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। তাই আতঙ্কিত হওয়ার দরকার নেই। সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য অনুরোধ করা হলো।
বাংলাদেশের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ড. তাহমিনা শিরীন বলেন, এটা নতুন কোনো ভাইরাস নয়। এমনকি এ নিয়ে বাংলাদেশে উদ্বেগের কোনো কারণ নেই। কোভিড-১৯ একেবারে ভিন্ন ও নতুন আবহের ভাইরাস হওয়ায় এর প্রাদুর্ভাব বা মহামারির রেশ এতটা বিস্তর হয়েছিল। শ্বাসতন্ত্রে ছড়ায় এমন অন্যান্য ভাইরাসের মতোই এটি। অনেকটা ইনফ্লুয়েঞ্জা ধরনের ভাইরাসের আক্রমণের মতোই, যার উপসর্গ হিসেবে জ্বর-সর্দি-কাশি-ঠান্ডা হয়ে থাকে। সাধারণ ঠান্ডাজনিত সমস্যা দিয়ে শুরু হলেও পরবর্তী সময় এই ভাইরাসের সংক্রমণে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। অনেক সময় সংক্রমণের তীব্রতা ব্রঙ্কাইটিস, নিউমোনিয়া, অ্যাজমা বা কানে ইনফেকশনের মতো সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
তাহমিনা শিরীন আরো বলেন, ভাইরাসটি তেমন ক্ষতিকারক নয়। এর লক্ষণ সাধারণ নিউমোনিয়ার মতো; জ্বর-সর্দি-কাশি হয়। শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা হয়। মৃত্যুর আশঙ্কা কম। মৃত্যু হার নেই বললেই চলে। তাই আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, এইচএমপিভি ২০০১ সাল থেকেই বাংলাদেশে আছে। এমনকি এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে মানুষের মধ্যে যথেষ্ট অ্যান্টিবডিও তৈরি হয়েছে। যে কারণে করোনাভাইরাসের মতো এই ভাইরাস নিয়ে এতো ভয়ের কিছু নেই। সংশ্লিষ্টদের মতে, বর্তমানে এইচএমপিভির চিকিৎসার জন্য কোনো নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল থেরাপি নেই এবং এইচএমপিভি প্রতিরোধ করার জন্য কোনো ভ্যাকসিন নেই। তাই রোগের উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) বলছে, ২০০১ সালে বিশ্বে প্রথম এই ভাইরাস শনাক্ত হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হয়তো আরো অনেক যুগ আগে থেকেই এই ভাইরাসের অস্তিত্ব ছিল পৃথিবীতে। এ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে যে কোনো বয়সী মানুষের ব্রংকাইটিস বা নিউমোনিয়ার মতো অসুখ হতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত এটি শিশু, বয়স্ক মানুষ এবং যাদের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল তাদের মধ্যেই বেশি দেখা গেছে।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) সূত্র জানায়, ২০১৭ সালে এইচএমপিভি প্রথম শনাক্ত হয় বাংলাদেশে। এরপর কমবেশি প্রতিবছরই শনাক্ত হয়ে আসছে। এ পর্যন্ত অনেকের শরীরে ভাইরাসটি শনাক্ত হলেও জটিলতার ইতিহাস নেই। এ কারণে এইচএমপিভি ভাইরাস নিয়ে এই মুহূর্তে আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু নেই।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বেসিক সায়েন্স ও প্যারা ক্লিনিক্যাল সায়েন্স অনুষদের ডিন ও বঙ্গবন্ধু সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সী বলেন, এই ভাইরাসটি আমাদের দেশে অনেক আগে থেকেই আছে। এটা তেমন ক্ষতিকর না। এটা শুধু শিশু এবং বয়স্কদের সংক্রমিত করে। মূলত শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা করে থাকে। অনেক সময় গায়ে ব্যথা, বমি ও নিউমোনিয়া হয়। এতে মৃত্যুর শঙ্কা যে খুব একটা বেশি, তা নয়। মৃত্যুহার নেই বললেই চলে। এতে আতঙ্কগ্রস্ত হওয়ার কিছু নেই।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিসম্পদ বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, এইচএমপিভি একটি এনভেলপড আরএনএ ভাইরাস, যার অর্থ হলো ভাইরাসটির বাইরের অংশে একটি লিপিড বাইলেয়ার থাকে। এটি কোষের মেমব্রেনের মতো, যা ভাইরাসটিকে শ্বাসযন্ত্রের কোষে প্রবেশ করতে সহায়তা করে। ভাইরাসটির জেনেটিক ম্যাটেরিয়াল আরএনএ আকারে থাকে এবং এটি অল্প সময়ের মধ্যে কোষের ভিতরে প্রবেশ করে এবং কোষের মেটাবলিজম ব্যবহার করে নিজেকে রেপ্লিকেট করে। এইচএমপিডি প্রধানত শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমে ছড়ায় এবং সাধারণত বাতাসে ভেসে থাকা ভাইরাসের কণা বা একটি সংক্রমিত ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির শ্বাসতন্ত্রে প্রবেশ করে। ভাইরাসটি আক্রান্ত ব্যক্তির কাশি, হাঁচি বা শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে ছড়াতে পারে। ভাইরাসটি মানুষের হাতের সংস্পর্শে আসতে পারে এবং তারপর সেই হাতের মাধ্যমে মুখ, নাক বা চোখে প্রবেশ করতে পারে।
তিনি আরো বলেন, শিশু, বয়স্ক বা দূর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন রোগীদের মধ্যে এইচএমপিভি গুরুতর শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে যারা এ গ্রুপের মধ্যে আছেন তাদের জন্য ভাইরাসটি মৃত্যুর ঝুঁকিও সৃষ্টি করতে পারে। এদের ক্ষেত্রে শ্বাসতন্ত্রের গভীরে সংক্রমণ তৈরি হয় এবং ফুসফুসে প্রদাহ সৃষ্টি হয়। এমনকি শ্বাসনালি বা ব্রঙ্কিওলগুলোর প্রদাহ সৃষ্টি হয়, যা শ্বাসপ্রশ্বাসে বাধা সৃষ্টি করে। গুরুতর সংক্রমণের ক্ষেত্রে শ্বাসপ্রশ্বাসে বিপত্তি ঘটতে পারে, যার ফলে অক্সিজেনের অভাব দেখা দিতে পারে। সর্দি (রাইনাইটিস), কাশি (প্রাথমিকভাবে শুন্তু, পরবর্তী সময়ে সর্দি ও শ্লেন্নাসহ), গলাব্যথা, জ্বর (এটি সাধারণত মাঝারি থেকে উচ্চমাত্রার হতে পারে), শ্বাসকষ্ট (বিশেষত শিশুদের মধ্যে), শ্বাসে অবরোধ। এইচএমপিভির সংক্রমণ সাধারণত এক-দুই সপ্তাহের মধ্যে সম্পূর্ণভাবে নিরাময় হয়ে যায়, তবে কারো কারো ক্ষেত্রে এটি গুরুতর শ্বাসতন্ত্রের রোগ সৃষ্টি করতে পারে, যেমন নিউমোনিয়া বা ব্রঙ্কিওলাইটিস, যা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।। তিনি আরো বলেন, এখনই এটি নিয়ে আতঙ্কিত হওযার কারণ নেই প্রয়োজন সতর্কতা অবলম্বন করা।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ডা. মো. শাহ আলম বলেন, হিউম্যান মেটানিউমো ভাইরাস বা এইচএমপিভি বাংলাদেশে নতুন কোনো ভাইরাস নয়, তবে এই ভাইরাসটি করোনার মতোই ভয়াবহতা তৈরি করতে পারে। এ জন্য সরকারকে এখনই আমাদের বিভিন্ন এন্ট্রি পয়েন্টে জানার বসাতে হবে। যাতে করে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে না পারে। তিনি মনে করেন, করোনা থেকে মানুষ অনেক শিক্ষা নিয়েছে। ফলে এটি এটি মোকাবিলা করা সহজ হবে। তবে এর নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই রোগীর উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা চলবে। করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির ডায়েরিয়া ও শ্বাসকষ্ট হলেও এইচএমপিভি আক্রান্তদের শুধু শ্বাসকষ্ট হতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তি এবং সংস্পর্শে আসাদের দ্রুত আলাদা করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের করোন্টাইনে নিতে হবে। মেনে চলতে হবে সরকারি বিধিবিধান। সর্বোপরি হলো আমাদের সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
এমএইচএস