ছবি : সংগৃহীত
বাংলাদেশের পুরান ঢাকায় মঙ্গলবার নানা আয়োজনে পালিত হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী সাকরাইন উৎসব। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব বয়সী মানুষ এই উৎসবে অংশ নিয়ে থাকে।
এই উৎসবকে সামনে রেখে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরেই চলে প্রস্তুতি। উৎসবের দিন সকাল থেকেই পুরান ঢাকার প্রায় প্রতিটি বাড়ির ছাদই থাকে ঘুড়িওয়ালাদের দখলে।
রঙ-বেরঙের ঘুড়িতে ছেয়ে যায় নীলাকাশ। এর মধ্যেই চলে ঘুড়ির সুতা কাটার তুমুল প্রতিযোগিতা। কানে ভেসে আসতে থাকে ‘বাকাট্টা..বাকাট্টা..ধর ধর..’ চিৎকার।
ঘুড়ি উড়ানোর পাশাপাশি অনেক বাড়িতে তৈরি হয় পিঠা-পুলিসহ খাবারের বাহারি পদ। সেই সঙ্গে চলে গান-বাজনা। আলোকসজ্জাও করেন কেউ কেউ।
এই আয়োজনে অংশ নিতে অন্যান্য এলাকার বাসিন্দারাও উৎসবের দিন পুরান ঢাকায় ভিড় করেন।
যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উৎসব উদযাপনে বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে, সেটা নিয়ে পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়াও রয়েছে।
কয়েক বছর ধরে এই উৎসবে আতশবাজি ফাটানো ও উচ্চ শব্দে নাচ-গানের প্রচলন হয়েছে, যা নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনাও হতে দেখা যাচ্ছে।
কিন্তু সাকরাইন উৎসব আসলে কী? কবে, কীভাবে পুরান ঢাকায় উৎসবটি পালন শুরু হয়েছিল?
সাকরাইন উৎসব
গবেষকরা বলছেন, সাকরাইন মূলত ঘুড়ি উড়ানোর উৎসব।
পঞ্জিকা অনুযায়ী, প্রতি বছর পৌষ মাসের শেষ দিন তথা পৌষ সংক্রান্তিতে পুরান ঢাকায় এই উৎসবের আয়োজন হয়ে থাকে।
‘পৌষ সংক্রান্তি আর সাকরাইন বলা যায় একই জিনিস। পার্থক্য এতটুকুই যে, পৌষ সংক্রান্তিতে হিন্দুরা পূজা করে, মুসলমানরা করে না,’ বলছিলেন ঢাকার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন ‘ঢাকা কেন্দ্র’র চেয়ারম্যান আজিম বখশ।
ঠিক কবে থেকে এই উৎসব পালন হয়ে আসছে, সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনও তথ্য পাওয়া যায় না। তবে উৎসবটি শত বছরের পুরনো বলে ধারণা করেন গবেষকরা।
‘ব্রিটিশ আমলে খান বাহাদুর আহসানউল্লাহর সময়েও উৎসবটি পালিত হতো বলে জানা যায়,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন বাংলা লোক সংস্কৃতির গবেষক সাইমন জাকারিয়া।
যদিও কেউ কেউ দাবি করেন যে, মুঘল আমল থেকেই ঢাকায় এই উৎসব পালিত হয়ে আসছে।
‘তবে যতটুকু জানি, এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট দলিল এখনও পাওয়া যায়নি,’ বলছিলেন সাইমন জাকারিয়া।
ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই এই উৎসবে অংশ নিয়ে থাকে।
উৎসব ঘিরে কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই পুরান ঢাকায় ঘুড়ি তৈরি ও বিক্রি বেড়ে যায়।
ওই এলাকার অধিকাংশ গলি আর খোলা ছাদে চলে সুতায় মাঞ্জা দেওয়া ও রোদে সেটি শুকানোর ধূম।
উৎসবে যা যা হয়
ঘুড়ি উড়ানোই সাকরাইন উৎসবের প্রধান অনুষঙ্গ।
মূলত উৎসবের দিন সকাল থেকেই ঘুড়ি উড়ানো শুরু করেন অনেকে। এরপর যতই বেলা বাড়ে ততই বাড়তে থাকে ঘুড়ির সংখ্যা। আকাশ ভরে ওঠে রঙ-বেরঙের ঘুড়িতে।
‘ঘুড়িগুলোর মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতা হয়। চলে সুতা কাটাকাটি। ফলে কার ঘুড়ি কতক্ষণ টিঁকে থাকতে পারে এবং কত ওপরে উঠতে পারে, সেটিই ঘুড়ি উড়ানোর প্রধান আকর্ষণ,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন ঢাকা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান বখশ।
আটাত্তর বছর বয়সী বখশের জন্ম পুরান ঢাকাতে এবং এখনো তিনি সেখানেই বসবাস করেন।
তিনি বলছিলেন, পুরান ঢাকার বাসিন্দারা খোলা মাঠ ও বাসার ছাদে ঘুড়ি উৎসবের আয়োজন করে থাকেন।
‘প্রথম দিকে যেহেতু অনেক খালি মাঠ ছিল, সেজন্য সেখানেই এর আয়োজন হতো। আমরাও ছোটবেলায় তেমনটা দেখেছি। কিন্তু এখন মাঠ কমে আসায় বাসিন্দারা বাড়ির ছাদেই ঘুড়ি উড়ান,’ বলেন বখশ।
সকালে শুরু হলেও ঘুড়ি উৎসব মূলত জমে উঠতে থাকে দুপুরের পর, যা চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত।
‘এরপর অনেকে ফানুস উড়ান, আতশবাজি ফাটান। কেউ কেউ আগুন খেলা করেন। সেই সঙ্গে চলে গান-বাজনা, এমনকি ডিজে পার্টিও,’ বলছিলেন পুরান ঢাকার আরেক বাসিন্দা মাসুদুল হাসান।
‘আগে পারিবারিকভাবেই এগুলো আয়োজন করা হতো। কিন্তু এখন আতশবাজি, ডিজে - এসবের কারণে খরচ বেড়ে যাওয়ায় পরিবার, বন্ধু-বান্ধব-পরিচিতজনেরা মিলে চাঁদা দিয়ে আয়োজন করা হয়ে থাকে,’ বলেন হাসান।
সাকরাইন উৎসবের দিনে পুরান ঢাকার অনেক বাড়িতে পিঠা-পুলি বানানো হয়।
‘অনেকে পোলাও-বিরিয়ানি, তেহারি-খিচুড়িও রান্না করেন,’ বলেন ওই এলাকার বাসিন্দা ফারিহা ইসলাম।
উৎসব দেখতে অন্য এলাকা থেকে আত্মীয়-স্বজনরাও অনেকে ওইদিন পুরান ঢাকায় আসেন বলেও জানিয়েছেন বাসিন্দারা।
‘এটা অনেকটা পারিবারিক মিলন মেলার মতো। সবাই একসঙ্গে ঘুড়ি উড়ায়, খাবার খায়, খুব আনন্দ হয়,’ বলছিলেন ফারিহা ইসলাম।
তবে আত্মীয়-স্বজনের বাইরে বিভিন্ন এলাকা থেকেও মানুষজন উৎসব দেখতে পুরান ঢাকা যান।
এদিকে, উৎসব উপলক্ষে কেউ কেউ বাড়িতে আলোকসজ্জাও করেন।
‘অনেকে মনে করেন এটা করলে উৎসবের ভাবটা আসে। সেজন্যই লাইটিং করে,’ বলছিলেন মাসুদুল হাসান।
উদযাপনে পরিবর্তনের ছোঁয়া
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পুরান ঢাকার সাকরাইন উৎসবের উদযাপনে পরিবর্তন এসেছে বলে জানাচ্ছেন গবেষক ও স্থানীয় বাসিন্দারা।
‘ছোটবেলায় আমরা যেভাবে সাকরাইন উদযাপন করেছি, এখন সেটার অনেক কিছু বদলে গেছে,’ বলছিলেন গবেষক বখশ।
সাকরাইন উৎসবে এখন যেভাবে আতশবাজি ফোটানো ও উচ্চশব্দে গান বাজানো হয়, কয়েক দশক আগেও সেটি ছিল না বলে জানান তিনি।
‘আগে ঘুড়ি উড়ানোটাই ছিল প্রধান উৎসব। আর এখন সেটার সঙ্গে সন্ধ্যায় আতশবাজি ফোটানো, গান বাজানো- এগুলো যোগ হয়েছে,’ বলেন বখশ।
এমনকি ঘুড়ি উড়ানোর রীতি একই থাকলেও ঘুড়ির চেহারাও পাল্টে গেছে বলে জানাচ্ছেন বাসিন্দারা।
‘আগে এখানে যে জমিদার বাড়িগুলো ছিল, সেই বাড়িগুলোতে ঘুড়ি উৎসব হতো। তাদের ঘুড়ি ছিল বড়, নাটাইগুলো ছিল চান্দির বানানো। আর সাধারণ মানুষ বাঁশ দিয়ে বানানো নাটাই দিয়েই ঘুড়ি উড়াতো। সেইরকম ঘুড়ি খুব একটা দেখি না,’ বলেন গবেষক বখশ।
একই কথা বলছিলেন পুরান ঢাকার আরেক বাসিন্দা ফাহিম আল ফারুকী।
‘আগে উৎসবের কয়েক মাস আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেত। আমরা নিজেরাই ঘুড়ি বানাতাম, মাঞ্জা দিতাম। এখন বেশির ভাগ মানুষ রেডিমেড ঘুড়ি কেনে। ফলে সাকরাইন এখন একদিনের উৎসব হয়ে গেছে বলা যায়,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন পঞ্চাশ বছর বয়সী আল ফারুকী।
তিনি আরও বলেন, আগে বিনোদনের এতো মাধ্যম ছিল না। মোবাইল বা ইন্টারনেটও ছিল না। ফলে ছোট-বড় সবাই এই দিনটার জন্য অপেক্ষা করতো। সেটা ছিল অন্যরকম এক অনুভূতি।
উৎসব উদযাপনের এই পরিবর্তন নিয়ে পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
‘সাকরাইন মূলত ঘুড়ি উৎসব। কিন্তু এখন সেটি ছাপিয়ে আতশবাজি ফাটানো, শব্দ করে ডিজে পার্টি করা এসবই মুখ্য হয়ে উঠছে। এগুলো সাকরাইনের ঐতিহ্যের সঙ্গে যায় না এবং সাধারণ মানুষও বিরক্ত বোধ করে,’ বলছিলেন ঢাকার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন ঢাকা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান বখশ।
তবে আরেক বাসিন্দা মাসুদুল হাসান অবশ্য উৎসব উদযাপনের পরিবর্তনকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন।
‘উৎসব এখন আগের চেয়ে কালারফুল হয়েছে,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন ৪৩ বছর বয়সী মাসুদুল হাসান।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি আরও বলেন, আগে আমরা নিজেরাই নিজেদের রিসোর্স দিয়ে ছোট পরিসরে আয়োজন করতাম। এখন সেটা বড় হয়েছে। লাইটিং, সাউন্ড সিস্টেম, আতশবাজি- এগুলো যোগ হয়েছে। এতে উৎসব আরও প্রাণ পেয়েছে।
‘চেঞ্জ তো হবেই। তবে আমাদের কালচারটা যে ধরে রাখতে পেরেছি, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ,’ বলছিলেন মাসুদুল হাসান।
বিএইচ/