Logo

জাতীয়

চিকিৎসা ব্যয়ে পিষ্ট মানুষ

এম এ বাবর

এম এ বাবর

প্রকাশ: ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:৪৬

চিকিৎসা ব্যয়ে পিষ্ট মানুষ

স্বাস্থ্যসেবায় দিন দিন ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে চিকিৎসায় বাংলাদেশে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় ৭৪ শতাংশ। এটি প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে বেশি। এর মধ্যে ওষুধে ব্যয় হয়েছে ৪৪ শতাংশ।

এর মধ্যে গত এক বছরে হাসপাতালগুলোতে রোগ নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন পরীক্ষার ফি, চিকিৎসকের পরামর্শ ফি ও ওষুধের ব্যয় বেড়েছে কমপক্ষে ১৫ শতাংশ। ফলে সার্বিক পরিস্থিতিতে দেশে প্রতি বছর চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে গিয়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যান কয়েক লাখ মানুষ। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে সামগ্রিক অর্থনীতির ২ দশমিক ৫ শতাংশ স্বাস্থ্যে ব্যয় হয়। এতে সরকারি ব্যয় ১ শতাংশেরও কম। সুতরাং স্বাস্থ্য খাতে সরকারের বরাদ্দ বাড়াতে হবে। 

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন আয়ের মানুষের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ব্যয়ের বড় ধরনের প্রভাব রয়েছে। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষের চিকিৎসা ব্যয় নির্দিষ্ট মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে তা পরিবারের জন্য বিপর্যয়কর হয়। যেসব পরিবারের মোট ব্যয়ের ১০ শতাংশ ভোগে ব্যয় হয়, সেই শ্রেণির ১৭ দশমিক ৭২ শতাংশ পরিবার চিকিৎসায় ব্যয় করে বিপর্যয়ের মুখে পড়েন। যেসব পরিবারের মোট ব্যয়ের ২৫ শতাংশ ভোগে ব্যয় হয়, তাদের ৭ দশমিক ০৭ শতাংশ চিকিৎসা ব্যয় করে বিপর্যয়ের মুখে পড়েন। এ ছাড়া যেসব পরিবারের মোট ব্যয়ের ৪০ শতাংশ খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় হয়, তাদের মধ্যে ৪০ শতাংশ পরিবার চিকিৎসার ব্যয় করে বিপর্যয়ের মুখে পড়ে থাকেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২২ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশিরা তাদের মোট স্বাস্থ্যসেবা ব্যয়ের ৭২ দশমিক ৫ শতাংশই নিজেরা বহন করেন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস)-এর তথ্যানুসারে, চিকিৎসার এই ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে সে বছর প্রায় ৬১ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের মুখে পড়েছেন।

এদিকে স্বাস্থ্যসেবাকে জনমুখী, সহজলভ্য ও সর্বজনীন করতে প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রস্তাবের লক্ষ্যে গত ১৭ অক্টোবর ১২ সদস্যের একটি হেলথ সেক্টর রিফর্ম কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই সংস্কার কমিশনের সদস্যরা এখন স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে কথা বলছেন। ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে বলে জানা গেছে। সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক এ কে আজাদ খান বলেন, প্রয়োজনীয় সংস্কারের বিষয়ে সরকারকে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পলিসি ইস্যু করার ব্যাপারে সুপারিশ করবে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন। স্বাস্থ্যসেবাকে সহজলভ্য করতে হলে 'আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচার' (নিজের পকেট থেকে করা খরচ) কমিয়ে আনতে হবে।

কমিশনের সদস্য ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা ডা. মুজাহেরুল হক বলেন, আউট অব দ্য পকেট এক্সপেন্ডিচার কমিয়ে আনতে পারলে মানুষের চিকিৎসা ব্যয় কমবে এবং তারা পুষ্টিতে ব্যয় করতে পারবে যা সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজন। এটি নিয়ে আমরা আলোচনা করছি, চিন্তা করছি।

তিনি বলেন, চিকিৎসা ব্যয় কমানোর জন্য প্রয়োজন জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা। প্রথম কথা হলো- রোগ প্রতিরোধ করা, দ্বিতীয়ত প্রাথমিক অবস্থায় প্রতিকারের ব্যবস্থা করা, এগুলো করা গেলে মানুষ অসুস্থ হবে না এবং চিকিৎসা ব্যয় অনেক কমে আসবে।

ডা. মুজাহেরুল হক আরও বলেন, আমাদের আরেকটি চিন্তা হলো রেফারেল সিস্টেম। গরিব থেকে ধনী; যে কেউ চিকিৎসা নিতে যাতে উপজেলা থেকে জেলা, বিভাগীয় পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায়ে আসতে পারেন। কেউ যাতে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত না হন, এটার ওপর আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি। রেফারেল সিস্টেম চালু করা গেলে চিকিৎসা ব্যয় কমে আসবে।

এছাড়া পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ওষুধে ব্যয় কমাতে চিকিৎসকরা যাতে নৈতিকতা বজায় রাখেন এবং ওষুধ কোম্পানিগুলো যাতে নৈতিকভাবে ব্যবসা করে সে জন্য জবাবদিহিতার ব্যবস্থা করতে হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। মনিটরিং ও সুপারভিশন শক্তিশালী করার পাশাপাশি রেফারেল সিস্টেম এবং প্রতিটি পর্যায়ে জবাবদিহিতা ও তিরস্কার-পুরস্কার নিশ্চিত করার বিষয়েও সুপারিশ করা হবে জানান ডা. মুজাহেরুল হক।

দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারি হাসপাতালে ফ্রি আউটডোর, ইনডোর সার্ভিস ও ডায়াগনস্টিক সার্ভিস রাখার সুপারিশ করা হতে পারে বলে জানিয়েছেন কমিশনের আরেক সদস্য অধ্যাপক ডা. মুহাম্মদ জাকির হোসেন।

তিনি বলেন, বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে দরিদ্র রোগীদের জন্য ৯ শতাংশ ইনডোর ও ১ শতাংশ মেডিসিন ও ডায়াগনস্টিক টেস্ট ফ্রিতে দেওয়ার সুপারিশ করার কথা ভাবা হচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে রোগীরা ফ্রিতে চিকিৎসা পাচ্ছেন কিনা; উপজেলা থেকে শুরু করে জেলা, বিভাগ ও জাতীয় সব পর্যায়ে মনিটরিং ও রিভিউ অ্যাসেসমেন্টের ব্যবস্থা থাকবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংস্কার কমিশনের আরেক সদস্য বলেন, আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচারের প্রধান হলো ওষুধ। মানুষ ওষুধ কিনতে গেলে সবচেয়ে বেশি খরচ হয়। তাই ওষুধের দাম কমানো, বিশেষ করে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের দাম নির্ধারিত হওয়া উচিত। তিনি বলেন, ইমার্জেন্সি প্রসিডিউর ও ক্রনিক প্রসিডিউর যেমন; ডায়ালাইসিস; এসব সাবসিডাইজ করা গেলে চিকিৎসার ব্যয়ভার অনেকাংশেই কমে যাবে। আমাদের দেশে সামগ্রিক অর্থনীতির ২.৫ শতাংশ স্বাস্থ্যে ব্যয় হয়, এতে সরকারি ব্যয় ১ শতাংশের কম; সুতরাং সরকারের বরাদ্দ বাড়াতে হবে।

গত ৮ জানুয়ারি খুলনা মেডিকেল কলেজে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের মতবিনিময় সভায় স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের সদস্য এম এম রেজা বলেন, স্বাস্থ্য খাতকে জনমুখী ও সর্বজনগ্রাহ্য করতে দুটি বিষয়ে ভাবতে হবে। প্রথমটি হলো সেবার পরিমাণ বাড়ানো, যাতে করে সবাই সেবাটি পায়; আরেকটি হলো ব্যক্তির আর্থিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তাকে হেলথ কাভারেজের আওতায় নিয়ে আসা। এটা না করতে পারলে কিছু লোক হয়তো উন্নত চিকিৎসাসেবা পাবেন, কিন্তু একটি বড় সংখ্যক মানুষ এই সেবা পাবেন না। কমিশনের প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য খাতের এসব সমস্যা ও সমাধানের বিষয়ে সুপারিশ করা হবে বলে জানা গেছে।

স্বাস্থ্যসেবা বিশেষজ্ঞরাও এই সংস্কারের বিষয়ে একমত হয়েছেন এবং এ খাতের উন্নতির জন্য বেশ কয়েকটি পদক্ষেপের পরামর্শ দিয়েছেন। 

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. এমএইচ চৌধুরী লেলিন বলেন, দেশে প্রতি বছর চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে গিয়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যান কয়েক লাখ মানুষ। আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচারের একটি বড় অংশ ব্যয় হয় ওষুধে। সরকার যদি দরিদ্র রোগীদের জন্য ওষুধে রেশনিং চালু করে তাহলে থাইরয়েড, ডায়বেটিসের মতো যেসব রোগের ওষুধ সারা জীবন খেতে হয় দরিদ্র রোগীরা উৎপাদন মূল্যের কাছাকাছি দামে সেগুলো কিনতে পারবে। এ জন্য কার্ডের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানির কাছ থেকে কার্ড দেখিয়ে কম দামে দরিদ্র রোগীরা ওষুধ কিনতে পারবেন। এছাড়া, দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করা ২০ শতাংশ মানুষের জন্য মেডিকেল সেফটি নেটওয়ার্ক তৈরি করতে হবে যাতে চিকিৎসা, ওষুধ, বিনামূল্যে পরীক্ষা বা কম দামে এসব সুবিধা পাওয়া যায়।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচার কমাতে সংস্কার কমিশন যে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছে; সেগুলোর পাশাপাশি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও পুষ্টি নিশ্চিতে এবং হেথল লিটারেসি বাড়াতে এসব খাতে বিনিয়োগ করতে হবে।

তিনি বলেন, পুষ্টি ঠিকভাবে পেলে রোগ এমনিতেই কমবে। একই সঙ্গে মানুষের মধ্যে হেলথ লিটারেসি বা স্বাস্থ্য সচেতনতা গড়ে উঠলে, তারা অপ্রয়োজনীয় ওষুধ কম কিনবেন, এতে খরচ কমবে। আর মানুষের মধ্যে এই আচরণগত পরিবর্তন আনতে হলে স্কুল পর্যায় থেকেই স্বাস্থ্যবিষয়ক সচেতনতা শেখাতে হবে।

এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, বর্তমানে পুষ্টি এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় বিনিয়োগ খুবই কম। এটা না বাড়ালে আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচার কমবে না। এগুলো না করে, অসুস্থ হলে শুধু ওষুধ খাওয়া বা হাসপাতাল তৈরি করেই এই খরচ কমানো যাবে না। রোগ প্রতিরোধের ওপর আমাদের বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

বিকেপি/এমএইচএস

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর