ওষুধের দাম নিয়ে নৈরাজ্য বেড়েই চলছে। ওষুধের দাম কমানোর দাবি জানিয়ে আসছিলেন সাধারণ ভোক্তারা। কিন্তু সম্প্রতি সরকার শতাধিক পণ্যে ভ্যাট বা মূল্য সংযোগ কর বৃদ্ধি করেছে। যেখানে রয়েছে ওষুধের মত জরুরি জীবন রক্ষাকারী পণ্য। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী স্থানীয় ব্যবসায়ী পর্যায়ে ওষুধের উপর ভ্যাট ২ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। এই বর্ধিত ভ্যাট স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আদায় করার কথা বলা হয়েছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সাথে ভোক্তার সম্পর্ক। স্বাভাবিকভাবেই বর্ধিত ভ্যাট যাবে ভোক্তার কাছ থেকে।
গত বছরের শেষ দিকে প্রকার ভেদে বিভিন্ন ওষুধের দাম বেড়েছে ১০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। এরপর ওষুধের উপর এমন ভ্যাট বৃদ্ধিকে ভোক্তা ও স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদরা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা বলছেন। ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্তে ওষুধের দাম আরেক দফা প্রকার ভেদে ১০ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। যদিও ওষুধের উপর ভ্যাট আরোপের বিষয়টি রিভিউ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
কী বলছেন সাধারণ ভোক্তা ও খুচরা ব্যবসায়ীরা
রাজধানীর মালিবাগের বাসিন্দা আবুল কালাম। পেশায় একজন বেসরকারি চাকুরিজীবী। প্রতি মাসে তার বাবার জন্য ছয় হাজার টাকার ওষুধের প্রয়োজন হয়। একই ওষুধ তিনি গত বছরের মাঝামাঝি ক্রয় করতেন চার হাজার পাঁচশত টাকায়। ছয় মাসের ব্যবধানে বেড়ে গেছে এক হাজার পাঁচশ টাকা। তিনি বলেন, এখন আবার সরকার ভ্যাট বাড়িয়েছে। এমন সিদ্ধান্ত তার জন্য বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে।
দীর্ঘদিন কিডনি রোগে আক্রান্ত ছোট ছেলেকে চিকিৎসা করাচ্ছেন শিহাব আহমেদ। তিনি জানালেন ওষুধ দাম নিয়ে তার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা। তিনি বলেন, গত এক বছরে একই ওষুধের দাম তিনি চার বার বৃদ্ধি পেতে দেখেছেন। নতুন করে ভ্যাট আরোপের বিষয়ে তিনি বলেন, বাজারে সকল পণ্যের দামই ঊর্ধ্বমুখী। ওষুধের উপর আবার নতুন করে ভ্যাট বৃদ্ধি জীবন ব্যয় আরও অসহনীয় করে তুলবে।
শাহবাগে পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে ব্যবসা করছেন ইউনাইটেড ড্রাগ হাউজের স্বত্বাধিকারী মাহবুবুর রহমান। ওষুধ ব্যবসায়ে তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ওষুধের দাম বৃদ্ধির এমন হার তিনি এর আগে কখনও দেখেননি। কোম্পানি ভেদে একই ওষুধের দামে তারতম্য অনেক বেশি। কিছুদিন পরপরই ওষুধের দাম বাড়ছে। এক সময় ওষুধে শতকরা ৫ থেকে ১০ শতাংশ লাভ হলেও সময়ের ব্যবধানে এখন ২ থেকে ৩ শতাংশ লাভ করাও দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ নিরুপায় হয়ে বেশি দামে ওষুধ কিনছে, কিন্তু বাজারে অসম প্রতিযোগিতায় আমরা অসহায়। ভ্যাট বাড়ানোর বিষয়ে তিনি বললেন, মানুষের কষ্ট বাড়বে। দিনশেষে মানুষের পকেট থেকেই যাবে ভ্যাটের টাকা।
ভ্যাটের নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সব স্থানীয় ব্যবসায়ীকে সরকার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর্তৃক ব্যবসা শনাক্তকরণ নম্বরের (বিন) আওতায় নিয়ে আসার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এ পর্যায় স্থানীয় ওষুধ ব্যবসায়ীরা তাদের বিক্রির হিসাব রাখবেন ডিজিটাল পদ্ধতি বা কম্পিউটার পদ্ধতিতে। যেখানে তাদের পণ্য বিক্রির সকল তথ্য থাকবে। প্রাথমিকভাবে দেশের সকল স্তরের স্থানীয় ব্যবসায়ীদের ওপর ভ্যাট বাস্তবায়ন সম্ভব না হলেও দেশের মডেল ফার্মেসি ও চেইন মেডিসিন বিক্রয়কেন্দ্রগুলোতে ইতোমধ্যে নতুন ভ্যাট হার কার্যকর হয়েছে। কারণ এসব বিক্রয় কেন্দ্রের সকল হিসাব ডিজিটাইজেশন পদ্ধতিতে রাখা হয়। এক্ষেত্রে নতুন ভ্যাট হার অনুযায়ী ওষুধ বিক্রয়কেন্দ্রগুলো পণ্য বিক্রি করছে। নতুন ভ্যাট হারও আদায় হচ্ছে ভোক্তার কাছ থেকে।
যা বলছেন ওষুধ শিল্প সংশ্লিষ্টরা ও স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদরা
ওষুধের উপর বর্ধিত ভ্যাট কীভাবে আদায় করা হবে এ বিষয় ওষুধ প্রশাসনের উপর নির্ভর করছে। কিন্তু ওষুধ প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই বিষয়ে এখনও কোন সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। বিষয়টি নিয়ে ওষুধ প্রশাসনের একাধিক পরিচালক ও উপপরিচালকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা কোন কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তবে এক উপ-পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ভ্যাট প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মানুষের ওপরই যাবে। সেটা যেভাবেই হউক। ভ্যাটের সাথে ভোক্তার সম্পর্ক। ওষুধ প্রশাসনের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনার বিষয়ে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি। খুব শীঘ্রই নির্দেশনা জারি করা হবে।
ওষুধের দাম বৃদ্ধি ও বর্ধিত ভ্যাটের বিষয়ে বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব এসএম শফিউজ্জামান বলেন, বিশ্ববাজারে ওষুধের কাঁচামালের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। দেশে ডলার ও জ্বালানি সংকটে দীর্ঘদিন থেকেই ধুঁকছে ওষুধ শিল্প। উৎপাদনের সাথে সমন্বয় করেই ওষুধের দাম নির্ধারণ করা হয়। বর্ধিত ভ্যাটের বিষয়টি সরকারি সিদ্ধান্ত বলে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
বর্ধিত ভ্যাট ও ওষুধের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, ওষুধ জীবনরক্ষাকারী পণ্য। ওষুধের ওপর ভ্যাট বৃদ্ধি সাধারণত উচিত না, যদি সরকারের কাছে অন্যকোনো উপায় থাকে রাজস্ব আয় বাড়ানোর।
কিন্তু পট পরিবর্তনের পর যে সরকার গঠিত হয়েছে তাদের সামনে মানুষের দাবি দাওয়ার কোন শেষ নেই। সে দাবি পূরণ করতে সরকারের অর্থের প্রয়োজন। সরকার রাজস্ব আয় বাড়িয়ে সে অর্থ আদায় করতে চায়।
এমএইচএস