Logo

জাতীয়

সার্ভারে তথ্য বিভ্রাট

ভূমি অফিসে ভোগান্তি, সেবাবঞ্চিত মানুষ

Icon

তরিকুল ইসলাম সুমন

প্রকাশ: ২৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:০৩

ভূমি অফিসে ভোগান্তি, সেবাবঞ্চিত মানুষ

ঢাকাসহ সারা দেশের ভূমি অফিসগুলোতে চলছে অরাজকতা। পুরনো সার্ভার থেকে নতুন সার্ভারে তথ্য হস্তান্তরের কারণে মিউটেশন, খাজনা বা এলডি ট্যাক্স এবং ই-পর্চা উত্তোলনে জটিলতা তৈরি হয়েছে। ফলে জমি হাত বদল বন্ধ রয়েছে। ৬৪ দিন ধরে ভূমি সেবার অনলাইন সার্ভার জটিলতায় বিপাকে পড়েছেন দেশব্যাপী সেবাপ্রত্যাশী গ্রাহকরা। 

শুধু জনভোগান্তিই নয়, পাশাপাশি সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব। সার্ভারের তথ্য বিভ্রাটের কারণে দেশের একটি বড় অংশই ভূমি সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সহসাই কাটছে না এ সমস্যা। এ জন্য অপেক্ষা করতে হবে মার্চ মাস পর্যন্ত। ভূমি মন্ত্রণালয় ও ভূমি ব্যবস্থাপনা অটোমেশন শীর্ষক প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের যে সার্ভার থেকে এতদিন সেবা নিশ্চিত করা হতো সেই সার্ভার থেকে এখন নতুন সার্ভারে তথ্য হস্তান্তর করা হচ্ছে। পুরনো সার্ভার তিনটি (মিউটেশন, খাজনা বা এলডি ট্যাক্স ও ই-পর্চা) কাজে ব্যবহার করা হতো। এটি এটুআই কর্তৃক সাপোর্ট দেওয়া হতো। 

তখন তারা জানিয়েছিলেন, এটি ৫-৬ বছর ভালো সার্ভিস দেবে। এত দিন কাজ করা হলেও করোনা ও বাজেট ঘাটতির কারণে নতুন সার্ভার ও সফটওয়্যার তৈরির কাজ শুরু হয় ২০২৩ সালে। এই সেক্টরে প্রয়োজনীয় সাপোর্ট দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে একমাত্র বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি)। তাদের সঙ্গেই কাজ করছি। 

সূত্র আরো জানায়, সম্প্রতি আমাদের কাছে নতুন সার্ভার ও সফটওয়্যাট আসায় বিশেষজ্ঞদের মতামত ও পরামর্শ অনুযায়ী ২৬ ডিসেম্বর থেকে আগের সার্ভার বন্ধ রেখে তথ্য নতুন সার্ভারে নিতে কিছুটা সময় লাগছে। কিন্তু তারপরও কিছু সমস্যা থেকে যাচ্ছে। তথ্য মিসিং দেখাচ্ছে। এ কারণে সার্ভারটি সব জায়গায় সমানভাবে দেখা যাচ্ছে না। প্রয়োজনীয় তথ্য না পাওয়ায় ইরর বা নট ইন সার্ভিস দেখাচ্ছে। সারা দেশের ভূমি সেবা পেতে আসা গ্রাহকরা কিছুটা সমস্যা ফেস করছেন। এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এক জায়গা থেকে সব সেবা নিশ্চিত করতে হলে শুরুতে কিছুটা সমস্যা সবাইকে মেনে নিতে হবে। এখন তেজগাঁও ভূমি অফিসে এটি পরীক্ষামূলক কাজ চলছে। সেখানে আইটি কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা কাজ করছেন। যে সমস্যা পাওয়া যাচ্ছে তা দ্রুত সমাধান করা হচ্ছে।

সার্ভার বন্ধ ও ভূমি সেবা ব্যাহত হওয়া প্রসঙ্গে ভূমি ব্যবস্থাপনা অটোমেশন শীর্ষক প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মোহাম্মদ ইফতেখার হোসেন বলেন, সার্ভার বন্ধ নয়, চালু রয়েছে। এটি নিয়ন্ত্রণ করে কম্পিউটার কাউন্সিল। একটি স্বার্থান্বেষী মহল সার্ভার বন্ধের প্রপাগান্ডা ছড়াচ্ছে। দ্রুত এ সমস্যার সমাধান হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, ভূমি ব্যবস্থাপনা অটোমেশন প্রকল্পের আওতায় প্রস্তুতকৃত ভূমি সেবা মানোন্নয়নে (দ্বিতীয় সংস্করণ) চারটি সফটওয়্যার (মিউটেশন সিস্টেম, ভূমি উন্নয়ন কর সিস্টেম, ডিজিটাল রেকর্ড ও ম্যাপ ব্যবস্থাপনা সিস্টেম, ভূমি প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা সিস্টেম) এবং নবসৃষ্ট একটি সফটওয়্যার (ল্যান্ড সার্ভিস গেটওয়ে) বিষয়টি সম্পন্ন করতে কিছুটা সময় বেশি লাগছে। এখন একটি সার্ভার থেকে অন্য সাভারে তথ্য ইনপুট দেওয়া হচ্ছে। এর অর্থ এই নয় যে, সার্ভারটি বন্ধ রয়েছে। 

তিনি বলেন, ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তেজগাঁওয়ে পাইলটিংয়ের কাজ হবে, ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে মতিঝিল, ধামরাই ও নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে কাজ শুরু হবে। ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে দেশের আটটি বিভাগের নারায়ণগঞ্জ, ফেনী, ঢাকা, হবিগঞ্জ, শেরপুর, জয়পুরহাট, গাইবান্ধা, ঝালকাঠি ও চুয়াডাঙ্গায় পাইলটিংয়ের কাজ শুরু হবে। ১ মার্চ দেশের ৬১টি জেলায় (তিন পার্বত্য জেলা ব্যতীত) ভূমি সেবার কাজ উদ্বোধন করবেন প্রধান উপদেষ্টা। 

তিনি আশা করেন, এ সময় থেকেই এ সমস্যার সমাধান হবে। তারপরও কিছু সমস্যা থাকলে তা প্রথমবার তহশিলদারদের কাছ থেকে সম্পন্ন করার পরে সার্ভারে যুক্ত হয়ে যাবে।

এর আগে, গত বছরের ২৫ নভেম্বর ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতে (২৬ নভেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বর) পর্যন্ত ই-মিউটেশন সিস্টেম, ই-পর্চা সিস্টেম ও ভূমি উন্নয়ন কর সিস্টেম বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছিল। তবে জটিলতার কারণে নতুন সার্ভারটির তথ্য ট্রান্সফারে কাজ শুরু হয় ৮ ডিসেম্বর। 

ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, নতুন চালুকৃত সফটওয়্যারগুলোর কিছু কারিগরি ত্রুটি ও আন্তঃসমন্বয় সংক্রান্ত জটিলতা, ডেটা সেন্টারের সার্ভার ও মাঠ পর্যায়ে সেবা প্রদানের জন্য ব্যবহৃত কম্পিউটারে সংযোগকৃত ইন্টারনেটের শ্লথগতির কারণে সাধারণ জনগণ সেবা পেতে প্রায়শই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। ভূমি সেবার উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে ভূমি ব্যবস্থাপনা অটোমেশন প্রকল্প ও ভূমি মন্ত্রণালয় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়াও জনগণ যেন দ্রুত ও নিরবচ্ছিন্ন সেবা পেতে পারেন সে লক্ষ্যে সারা দেশের উপজেলা, সার্কেল, মেট্রো, ভূমি অফিস ও ইউনিয়ন, পৌর, ভূমি অফিসের সেবা প্রদানকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নতুন চালুকৃত সফটওয়্যারগুলোর বিষয়ে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে।

ভূমি অফিসে হাঁটতে হাঁটতে নিরাশ হয়ে যাওয়া সাতক্ষীরার আশাশুনির কুল্যা ইউনিয়নের কচুয়া গ্রামের সজল জানান, বুধহাটা ইউনিয়ন ভূমি অফিসে তিনি এক মাসের বেশি সময় ধরে আসছেন। কিন্তু সার্ভার কাজ করছে না শুনতে হচ্ছে। মেয়ের বিয়ের খরচ মেটাতে নামজারি কাজ করতে পারছেন না। নামজারি হচ্ছে না, দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। 

যদুয়ারডাঙ্গা গ্রামের উত্তম সরকার, কচুয়া গ্রামের আজীজ, কাদাকাটি গ্রামের আজাদ রহমান বাচ্চু ও মুজিবর জানান, অনলাইন সমস্যায় তারা নামজারি ও ভূমি উন্নয়ন কর দিতে পারছেন না। বিল্লাল হোসেন বলেন, তিনি জমি বিক্রয় করার জন্য নামজারি করাতে হাঁটছেন। কিন্তু কবে কাজ হবে তাও জানাচ্ছেন না।

ভূমি অফিসের ডিড রাইটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নামজারি ও চেক দাখিলা কাটতে না পারায় জমি রেজিস্ট্রি কাজ ব্যাহত হচ্ছে। সপ্তাহে যেখানে ১৫০-২০০টি দলিল রেজিস্ট্রি হতো এখন সেখানে ৪০-৫০টিও হচ্ছে না। কেউ জরুরি প্রয়োজনে দলিল করতে আসছেন, কেউ চিকিৎসা, বিয়ে বা অন্য কোনো কাজে টাকার প্রয়োজন মেটাতে জমি বিক্রয় করতে আসছেন, কিন্তু রেজিস্ট্রি করতে না পেরে বারবার ফিরে যেতে হচ্ছে তাদের। এতে ক্রেতা-বিক্রেতারা নাজেহাল ও সমস্যায় পড়েছেন। রেজিস্ট্রি অফিসের সঙ্গে জড়িতরা বিপত্তিতে রয়েছেন। অপরদিকে ভূমি উন্নয়ন কর (খাজনা দাখিলা) পরিশোধ করতে না পারা, নামজারি ও জমি রেজিস্ট্রি করতে না পারায় সরকারও হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব।

নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে নিরবচ্ছিন্ন ভূমি সেবা নিশ্চিত করতে জাতীয় স্বার্থে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সার্ভারে ভূমি উন্নয়ন করের ডিমান্ড নির্ধারণ ও নামজারির সার্ভার আপডেট নিশ্চিত করা জরুরি মনে করছেন সংশ্লিষ্ট সেবাবঞ্চিতরা। ভূমি উন্নয়ন কর প্রদান ও নামজারির প্রক্রিয়া সহজ করার জন্য ভূমি উপদেষ্টা এবং প্রধান উপদেষ্টারও দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তারা।

  • ওএফ
Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর