Logo

জাতীয়

ক্যান্সারের চিকিৎসা সরকারিতে অপ্রতুল, বেসরকারিতে ব্যয়বহুল

সাহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া

সাহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া

প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০১:৫২

ক্যান্সারের চিকিৎসা সরকারিতে অপ্রতুল, বেসরকারিতে ব্যয়বহুল

ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত ১৫ বছরের কিশোর আতিক ইসলাম রাজধানীর জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী তার রেডিওথেরাপি প্রয়োজন। কিন্তু হাসপাতালের রেডিওথেরাপি মেশিন নষ্ট। দুই মাসের বেশি অপেক্ষা করতে বলেছেন চিকিৎসক। এ নিয়ে আতিকের বাবা আবিদ হাসানের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। তিনি জানালেন, বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু চিকিৎসার ব্যয় তার পক্ষে বহন করা সম্ভব না। 

একই হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন ব্রেস্ট ক্যান্সারের রোগী মনোয়ারা বেগম। কেমোথেরাপির জন্য দেড় মাসের বেশি সময় অপেক্ষা করছেন। এদিকে চিকিৎসক দ্রুতই তাকে কেমোথেরাপি দেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। মনোয়ারা বেগমের কৃষক স্বামী হোসেন আলী স্ত্রীর চিকিৎসা ব্যয় নিয়ে নিরুপায়। 

রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত ২০ বছর বয়সী মেয়েকে গত একবছর চিকিৎসা করাচ্ছেন মনি হায়দার। তার সাথে কথা বলতেই দেশে বেসরকারি হাসপাতালে ক্যান্সার চিকিৎসার ব্যয় সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেল। তিনি জানালেন, গত এক বছরে তার মেয়ের চিকিৎসায় ব্যয় হয়েছে ২৫ লাখ টাকার বেশি।

দেশে ক্যান্সার চিকিৎসার এমন বাস্তবতায় আজ মঙ্গলবার (৪ ফেব্রুয়ারি) বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও পালিত হতে যাচ্ছে ‘বিশ্ব ক্যান্সার দিবস’। এবারের প্রতিপাদ্য ‘ইউনাইটেড বাই ইউনিক অথাৎ অনন্যতায় ঐক্যতান’।

দেশে ক্যান্সার রোগের বর্তমান চিত্র

সম্প্রতি প্রকাশিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) জনসংখ্যা ভিত্তিক ক্যান্সার পরিস্থিতি নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে ৩৮ ধরণের ক্যান্সারের রোগী পাওয়া গেছে। প্রতি লাখে ১০৬ জন ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। ৯৩ শতাংশ রোগীর বয়স ১৮ থেকে ৭৫ বছর। ক্যান্সার রোগীদের মধ্যে ২ দশমিক ৪ শতাংশ শিশু। আর ৫ দশমিক ১ শতাংশ রোগীর বয়স ৭৫ বছরের বেশি।

গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রধান পাঁচটি ক্যান্সার হলো- স্তন, মুখ, পাকস্থলী, শ্বাসনালী ও জরায়ুমুখের ক্যান্সার। পুরুষদের পাঁচটি প্রধান ক্যান্সার হলো- শ্বাসনালী, পাকস্থলী, ফুসফুস, মুখ ও খাদ্যনালীর ক্যান্সার। আর নারীদের ক্ষেত্রে স্তন, জরায়ুমুখ, মুখ, থাইরয়েড ও ওভারির ক্যান্সার। 

পুরুষ ক্যান্সার রোগীদের ৭৫ দশমিক ৮ শতাংশ ধুমপায়ী এবং পান, জর্দ্দা, তামাক সেবনকারী ৪০ দশমিক ৫ শতাংশ। ক্যান্সার রোগীদের মধ্যে ৬০ দশমিক ৬ শতাংশ নারী পান, জর্দ্দা ও তামাক সেবনকারী। ৪৬ শতাংশ রোগীর ক্যান্সারের সাথে তামাক সেবনের সম্পর্ক রয়েছে। 

গবেষণায় আরও উল্লেখ করা হয়, ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ৬০ শতাংশ কমবাইন্ড চিকিৎসা নিয়েছে আর ৭ দশমিক ৪ শতাংশ রোগী কোনো চিকিৎসাই নেয়নি। দেশে মোট মৃত্যুর ১২ শতাংশ ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী। মৃত রোগীদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে ফুসফুস, শ্বাসনালী ও পাকস্থলীর ক্যান্সার। প্রতি বছর নতুন করে প্রতি লাখে ৫৩ জন রোগী ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ফুসফুস, লিভার ও শ্বাসনালীর ক্যান্সারের রোগীর সংখ্যা বেশি।

সরকারি হাসপাতালে ক্যান্সার চিকিৎসা

দেশের একমাত্র ক্যান্সার চিকিৎসা গবেষণা কেন্দ্র জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল। হাসপাতালটি ৩০০ বেড নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও কোনো রকম প্রস্তুতি ছাড়াই ২০১৯ সালে হাসপাতাটিকে ৫০০ বেডে উন্নীত করা হয়। হাসপাতালটিতে পর্যাপ্ত চিকিৎসক থেকে চিকিৎসা সরঞ্জাম সব কিছুরই সংকট চরমে।

হাসপাতালটি ঘুরে দেখা যায়, টিউমার বোর্ড, ড্রেসিং রুম, ব্রেস্ট ইউনিট,এন্ডোস্কোপি, ক্যামোথেরাপি, রেডিওথেরাপিসহ সব বিভাগের বর্হিবিভাগে রোগীদের দীর্ঘ সারি। 

বর্হিবিভাগে দায়িত্বরত একজন চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ৩০০ বেডের হাসপাতাল জনবল ছাড়াই ৫০০ বেডে উন্নীত করা হয়েছে। এখানে পর্যাপ্ত জনবল নেই। রোগী দেখতে রীতিমত হিমশিম খেতে হয়। বর্হিবিভাগে প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ রোগী আসে। 

তিনি বলেন, হাসপাতালে যেসব পরীক্ষার সুযোগ আছে সেগুলো এখানেই করেন রোগীরা। নইলে বাইরে থেকে পরীক্ষা করে ক্যান্সার হাসপাতালের মেডিকেল বোর্ডকে রিপোর্ট দেখান রোগীরা। রিপোর্ট দেখে মেডিকেল বোর্ড সিদ্ধান্ত নেয় সার্জারি হবে নাকি রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপি দেওয়া হবে নাকি সবগুলো করা হবে। সার্জারি বা কেমোথেরাপি হলে একটি দিন নির্ধারণ করে দেয় বোর্ড। কিন্তু রেডিওথেরাপি হলেই বোর্ড জানিয়ে দেয় মেশিন স্বল্পতার কারণে এখানে এখন চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। সম্ভাব্য তারিখ দেওয়া হয় ২ থেকে ৩ মাস পরের। কিন্তু বর্তমানে হাসপাতালে থাকা ছয়টি রেডিওথেরাপি মেশিনের একটিও সচল নেই।

দেশের একমাত্র এই ক্যান্সার হাসপাতালের পাশাপাশি অন্যান্য সরকারি হাসপাতালেও ক্যান্সার চিকিৎসা ব্যবস্থা নাজুক। ক্যান্সার চিকিৎসার অপরিহার্য রেডিওথেরাপি যন্ত্রটির অবস্থা তুলে ধরলেই দেশে ক্যান্সার চিকিৎসার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। রাজধানীর কোনো সরকারি হাসপাতালেই রেডিওথেরাপি যন্ত্র সচল নেই। 

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে থাকা দুটি যন্ত্র অচল ছয় মাসের বেশি সময় ধরে। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ক্যান্সার বিভাগ থাকলেও নেই রেডিওথেরাপি যন্ত্র। অথচ ক্যান্সার আক্রান্ত ৭০ শতাংশ রোগীকে রেডিওথেরাপি দিতে হয়। 

ঢাকার বাইরে যে সাতটি সরকারি হাসপাতালে থাকা রেডিওথেরাপি যন্ত্রের মাত্র তিনটি সচল। বাকি চারটিও অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। 

ভোক্তভোগীরা জানান, সামর্থ্যবানরা বেসরকারি হাসপাতালে ২০ থেকে ২৫ গুণ বেশি টাকা দিয়ে রেডিওথেরাপি সেবা নিচ্ছেন। কিন্তু মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষের পক্ষে এই সেবা নেওয়া সম্ভব হয় না। তাদের ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।

দেশে ক্যান্সার সংকট নিয়ে গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক ক্যান্সার হাসপাতালের অধ্যাপক ও প্রকল্প সমন্বয়কারী ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন বলেন, দেশে প্রতিদিন ক্যান্সার রোগী বাড়ছে, কিন্তু চিকিৎসা সেবার আশানুরূপ অগ্রগতি নেই। ক্যান্সার শনাক্ত থেকে চিকিৎসা সকল ক্ষেত্রেই আমাদের সংকট রয়েছে। সরকারি পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য বিশেষ ইউনিট করতে হবে। প্রয়োজনীয় জনবল ও চিকিৎসা সরঞ্জাম ছাড়া ক্যান্সরের মতো চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব নয়। 

তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে প্রতি বছর কত মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় তার কোনো হিসাব সরকারিভাবে রাখা হয় না। আমাদের রোগীর সংখ্যা জানা প্রয়োজন। তাহলে সেই অনুপাতে সরকার পদক্ষেপ নিতে পারবে। তাছাড়া ক্যান্সার চিকিৎসা খুব ব্যয়বহুল। সমাজে যাদের অর্থবিত্ত আছে তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে ক্যান্সার চিকিৎসায় এগিয়ে আসা উচিত।

দেশে ক্যান্সার চিকিৎসার পরিকল্পনা ও সংকট নিয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী (প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদা) অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান বলেন, চলতি বছরে দেশে চারটি ক্যান্সার হাসপাতাল চালু করা হবে। একই সাথে ক্যান্সার হাসপাতালসহ অন্যান্য হাসপাতালগুলোতেও রোগীদের জন্য দরকারি যন্ত্রপাতি দ্রুত আমদানি করা হবে। আমাদের জনবহুল দেশে দ্রুত কোনো সমস্যা সমাধান করা কঠিন। আমরা চেষ্টা করছি মানুষের সেবার নিশ্চয়তা দিতে।

এসআইবি/ওএফ

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর