
পিলখানায় সেনা কর্মকর্তাদের নৃশংসভাবে হত্যার ১৬ বছর আজ। ২০০৯ সালের এই দিনে তৎকালীন বিডিআর (বাংলাদেশ রাইফেলস) সদর দপ্তরে (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা বিজিবি) বিপথগামী সৈনিকরা নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। ওই বছরের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিপথগামী কিছু বিডিআর সদস্য ৫৭ সেনা কর্মকর্তা ছাড়াও নারী ও শিশুসহ আরো ১৭ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর এবার ভিন্ন প্রেক্ষাপটে পালিত হচ্ছে দিনটি। অন্তর্বর্তী সরকার বিডিআর হত্যাকাণ্ডের দিনটিতে ‘জাতীয় শহীদ সেনা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করছে। ঘটনার ১৬ বছর পর পিলখানার ঘটনায় নিহত ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনের নির্মম হত্যাকাণ্ডে শোকাবহ ও হৃদয়বিদারক দিনটিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের মাধ্যমে সেনা সদস্যদের আত্মত্যাগকে জাতীয় স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানা হত্যাকাণ্ডে তখনকার বিডিআর মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদসহ ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা ছিলেন। এছাড়া নারী ও শিশুসহ আরো ১৭ জন নিহত হন। এর মধ্যে বিডিআর ডিজির স্ত্রীও ছিলেন। ওই সময় ২৫ ফেব্রুয়ারি বিডিআরের বার্ষিক দরবারের দিন সকাল ৯টায় দরবার হলে এ দরবার শুরু হয়। সারাদেশ থেকে আসা বিডিআর জওয়ান, জেসিও, এনসিওসহ ২ হাজার ৫৬০ জন সদস্যের মিলনমেলায় তখন পরিপূর্ণ দরবার হল।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই বিডিআর মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ বক্তব্য শুরু করেন। তার বক্তব্যের একপর্যায়ে কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিডিআরের কিছু বিপথগামী সদস্য অতর্কিত হামলা চালায় দরবার হলে। মঈন নামে একজন সিপাহী ডিজির মাথায় অস্ত্র তাক করে। এ অবস্থায় অফিসাররা তাকে নিরস্ত্র করেন।
পরে মঞ্চের নিচে নেমেই কর্মকর্তারা ডিজি শাকিলকে মধ্যে রেখে গোল হয়ে দাঁড়ান। একজন সৈনিক চিৎকার করে অশালীন ভাষায় তাদের সিঙ্গেল লাইনে দাঁড়াতে বলেন। এর পরই একে একে হত্যা করা হয় তাদের। শুরু হয় পিলখানা জুড়ে তাণ্ডব। চলে সেনা কর্মকর্তাসহ তাদের পরিবারের সদস্যদের হত্যা, নির্যাতন, জিম্মি, লুটপাট আর অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা। পিলখানার চার দেয়ালের ভেতরের নৃশংস এই হত্যাযজ্ঞ বুঝে উঠতে সময় লাগে আরো দুদিন।
হত্যাযজ্ঞ চলাকালে শেখ হাসিনার তৎকালীন সরকারি বাসভবন যমুনায় দফায় দফায় বৈঠক হয়। ২৫ ফেব্রুয়ারি দুপুরে ১৪ জন কিলারকে যমুনায় নেওয়া হয়। তাদেরকে তৎকালীন শেরাটন হোটেল থেকে খাবার এনে খাওয়ানো হয়। তাদের দাবির মুখে শেখ হাসিনা বিডিআর জওয়ানদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। ঘটনার পরদিন রাতে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে প্রায় ৩৩ ঘণ্টার বিদ্রোহের অবসান ঘটলে পিলখানার নিয়ন্ত্রণ নেয় পুলিশ। এর আগে সেনাদল প্রবেশ করে পিলখানায়। যদিও ঘটনার দিন ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালেই সেনাদল ও র্যাবের টিম বিডিআর গেটে পৌঁছালেও তাদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
২৭ ফেব্রুয়ারি পিলখানার ভেতরে সন্ধান মেলে একাধিক গণকবরের। সেখানে বিডিআরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ, তার স্ত্রীসহ সেনা কর্মকর্তাদের মরদেহ পাওয়া যায়। উদ্ধার করা হয় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা গ্রেনেডসহ বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ। এর আগে বিদ্রোহ দমনের নামে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, পল্লী উন্নয়ন সমবায় প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আওয়ামী লীগের এমপি মির্জা আজমকে পিলখানা এলাকায় পাঠানো হয়েছিল।
নারকীয় এ হত্যাকাণ্ডের পর ২৮ ফেব্রুয়ারি লালবাগ থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। পরে মামলা দুটি নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তরিত হয়। হত্যা মামলায় ৮৫০ জনের বিচার শেষ হয় ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর। যেখানে ১৫২ জনের ফাঁসি ছাড়াও ১৬০ জনের যাবজ্জীবন এবং ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এ ছাড়া খালাস পান ২৭৮ জন।
এদিকে বিস্ফোরক আইনের মামলায় ৮৩৪ জন আসামির বিরুদ্ধে বিচার কাজ শুরু হয় ২০১০ সালে। কিন্তু মাঝপথে বিস্ফোরক মামলার কার্যক্রম একপ্রকার স্থগিত রেখে শুধু হত্যা মামলার সাক্ষ্য উপস্থাপন করে রাষ্ট্রপক্ষ। যে কারণে এই মামলার বিচার ঝুলে যায়। হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ায় বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনার তদন্ত পুনরায় শুরুর দাবি ওঠে। গত ১৯ ডিসেম্বর অভিযোগ নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যান শহীদ পরিবারের সদস্যরা। সম্প্রতি বিস্ফোরক আইনে আটক জওয়ানরা মুক্তি পেয়েছেন।
এদিকে পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে জড়িত দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র ও প্রকৃত ঘটনার উদ্ঘাটন এবং অপরাধীদের চিহ্নিত করতে বিডিআরের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমানের (অব.) নেতৃত্বে জাতীয় স্বাধীন পূর্ণাঙ্গ তদন্ত কমিশন গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। ঘটনার তদন্তে স্বাধীন তদন্ত কমিশনের কার্যক্রম এগিয়ে চলছে।
বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পর অনেকে শেখ হাসিনার সরকারের ভয়ে গত সাড়ে ১৫ বছর মুখ খুলতে পারেনি। তবে শেখ হাসিনার পতনের পর তাদের অনেকে প্রকৃত সত্য বলতে শুরু করেছেন। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকাদের নাম উঠে আসছে। শেখ হাসিনা নিজেই বিষয়টি আগে থেকে অবগত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া হত্যার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে মেজর জেনারেল (অব.) তারেক সিদ্দিক, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ সেলিম, শেখ ফজলে নূর তাপস, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম এবং সেনাবাহিনী ও পুলিশের কিছু কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।