বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ১৫ অক্টোবর ২০১৮

ভুয়া আইনজীবীর ছড়াছড়ি

# তিন বছরে ধরা পড়েছে ৬৩ জন # শনাক্তে সক্রিয় বারের দুটি কমিটি

সুপ্রিম কোর্ট সংগৃহীত ছবি


বেশভূষায় পুরোপুরি আইনজীবী। সাদা শার্টের ওপর কালো কোট। ওপরে কালো গাউন। ১৫ বছর ওকালতি (আইনজীবী) করেছেন। কিন্তু আদতে তিনি আইনজীবীই নন। আইনের কোনো ডিগ্রি নেই। যা করে এসেছেন তার পুরোটাই প্রতারণা। চলতি বছরের ২৩ এপ্রিল ধরা পড়ে গেছে তার ছদ্মবেশ। নাম নাজমুন নাহার। আদালতপাড়ার চেম্বার থেকে তাকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেছেন ঢাকা আইনজীবী সমিতির টাউট উচ্ছেদ কমিটি। এভাবে প্রায়ই সমিতির হাতে ধরা পড়ছেন ভুয়া আইনজীবীরা।

শুধু ঢাকা আইনজীবী সমিতিই নয়, সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টেও ভুয়া আইনজীবীর উপস্থিতি মিলেছে। ২৭ বছর ধরে অন্য এক আইনজীবীর পরিচয় নম্বর (আইডি) ব্যবহার করে এসএম শহিদ উল্লাহ মালিক হয়েছেন ঢাকায় দুটি বাড়ি, ৪১ কাঠা জমি ও চারটি গাড়ির। অবশেষে সামান্য একটি ঘটনায় ধরা খেয়ে গেছেন তিনি। প্রতারণার দায়ে কারাগারে যেতে হয়েছে তাকে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সুপ্রিম কোর্টে ভুয়া আইনজীবীদের তৎপরতা তেমন নেই। বছরে দুয়েকজন ধরা পড়ছেন। গত তিন বছরে এ সংখ্যা সাতে দাঁড়িয়েছে। এখানে ভুয়া আইনজীবী শনাক্ত করতে কাজ করছে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ‘আদালত ব্যবস্থাপনা’ নামের একটি কমিটি। এর উল্টো চিত্র ঢাকা আইনজীবী সমিতিতে। সেখানে গত তিন বছরে ধরা পড়েছেন ৫৬ ভুয়া আইনজীবী। এর মধ্যে ২০১৬ সালে ৮ জন, ২০১৭ সালে ৩১ এবং চলতি বছর ১ অক্টোবর পর্যন্ত ১৫ ভুয়া আইনজীবীকে পুলিশে সোপর্দ করেছে ঢাকা আইনজীবী সমিতির টাউট উচ্ছেদ কমিটি। ধরা পড়া প্রত্যেকের নামে মামলার পর তাদের শেষ গন্তব্য কারাগার। তবে এত কঠোর অবস্থানের পরও থামছে না ভুয়া আইনজীবীদের প্রতারণা। সমিতির চোখে ধুলো দিয়ে এখনো অনেকে চালিয়ে যাচ্ছেন লোক ঠকানোর কাজ। ভুয়া আইনজীবী শনাক্তে ঢাকা আইনজীবী সমিতিতে ২৭ সদস্যের একটি কমিটি আছে। এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মিজানুর রহমান (মামুন)। আদালতপাড়ায় গেলেই চোখে পড়ে টাউট উচ্ছেদ কমিটির সতর্কীকরণ ও বিশেষ বিজ্ঞপ্তি। ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের নতুন ভবনের সামনে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি টানিয়েছে ঢাকা আইনজীবী সমিতি ও ঢাকা মহানগর আইনজীবী সমিতি। ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক তার নোটিশে বলেছেন, কেউ এলএলবি পাস বা ইন্টিমেশন জমা না দিয়ে আদালত অঙ্গনে পোশাক পরে ঘোরাফেরা করলে টাউট হিসেবে চিহ্নিত হবেন। তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে সমিতি। মহানগর আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. সহিদ হোসেন ঢালী মামলা মোকদ্দমার বিষয়ে আইনজীবীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়েছেন। 

টাউট উচ্ছেদ কমিটির সদস্য সচিব ও ঢাকা আইনজীবী সমিতির জ্যেষ্ঠ সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান তালুকদার দিপু জানান, চলতি বছর ২৩ এপ্রিল নাজমুন নাহার নামে এক ভুয়া আইনজীবীকে আটকের পর পুলিশে সোপর্দ করা হয়। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে প্রতারণা করে চলছিলেন তিনি। বার কাউন্সিলের কোনো সনদ নেই তার। অথচ বিচারপ্রার্থীদের কাছে নিজেকে সিনিয়র আইনজীবী পরিচয় দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। এ অভিযোগে তার বিরুদ্ধে রাজধানীর কোতোয়ালি থানায় মামলা হয়েছে।

বরিশালের মুলাদী থানার চর নাজিরপুরের মো. মনিরুজ্জামানকে গত ২৪ এপ্রিল ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের সামনে থেকে আটক করে টাউট উচ্ছেদ কমিটি। আইনজীবী সমিতির নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায় মনিরুজ্জামান ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্য নন এবং শিক্ষানবিস আইনজীবীও নন। ওই ব্যক্তি ভুয়া পরিচয়ে দীর্ঘদিন ধরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছিলেন আদালত অঙ্গন। ওই দিনই কোতোয়ালি থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। 

চলতি বছরের ২১ মার্চ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন এক চিঠির মাধ্যমে জাল সনদে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত লুৎফুন নাহারের সদস্যপদ স্থায়ীভাবে বাতিল করেন।

২০১৬ সালের ৮ আগস্ট বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) থেকে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল বরাবর একটি চিঠি আসে। তাতে বলা হয়, লুৎফুন নাহার নামে সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী বিসিআইসিতে আইনজীবীর প্যানেলভুক্তির জন্য আবেদন করেন। কিন্তু তার সনদে অস্পষ্টতা থাকায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তাতে জানা যায় তার সনদ ভুয়া।

এলএলবি পাস না করেও লুৎফুন নাহার দেখান ২০০৩ সালে তিনি বঙ্গবন্ধু ল কলেজ থেকে ব্যাচেলর অব ল তৃতীয় শ্রেণিতে পাস করেছেন, যার রেজিস্ট্রেশন নম্বর ১০৫২৬২ এবং রোল নম্বর ৫৩।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি সনদ যাচাইয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে চিঠি দিয়ে জানতে চায়। এর প্রেক্ষিতে গত ১ ফেব্রুয়ারি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সমিতিকে জানায়, নথি অনুযায়ী উল্লিখিত তথ্য সঠিক নয় এবং এরকম সনদপত্র ও নম্বরপত্র জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইস্যু করা হয়নি। এরপরই লুৎফুন নাহারের সদস্যপদ স্থায়ীভাবে অকার্যকর ও বাতিল করে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি।

অন্যদিকে ২৭ বছর অন্যের পরিচয়পত্র ব্যবহার করছিলেন ভুয়া আইনজীবী এসএম শহিদ উল্লাহ। প্রকৃত আইনজীবী মো. শহিদ উল্ল্যাহর পরিচয়পত্র নম্বর (আইডি) ব্যবহার করে তিনি হাইকোর্টে এ পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার মামলা পরিচালনা করেছেন।

অবশেষে  প্রতারণা মামলায় ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি শাহবাগ থানার পুলিশ সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে গ্রেফতার করে তাকে। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মামলার বাদী। এরপর তাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে ধরিয়ে দেওয়ার নোটিশ দেওয়া হয়।

তার ভুয়া আইনজীবীর পরিচয় উদঘাটিত হওয়ার ঘটনাটি চমকপ্রদ। ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির কার্যনির্বাহী সদস্য পদে বিএনপি সমর্থিত নীল প্যানেল থেকে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন পারভীন আক্তার নামে এক নারী আইনজীবী। প্রার্থী ফরমে সমর্থক হিসেবে স্বাক্ষর নেওয়ার জন্য এসএম শহিদ উল্লাহর কাছে যান তিনি। কিন্তু তিনি মনোনয়ন ফরমে স্বাক্ষর দিতে অস্বীকৃতি জানান। তবে অনুরোধের একপর্যায়ে ফরমে স্বাক্ষর করলেও আইডি নম্বর দিতে অস্বীকার করেন। পরে তিনি আইডি নম্বরও দেন। কিন্তু এসএম শহিদ উল্লার দেওয়া সেই নম্বর সঠিক নয় বলে পারভীন আক্তারের ফরম বাতিল হয়ে যায়। পরে পারভীন প্রকৃত শহিদ উল্ল্যাহকে খুঁজে বের করেন। মূল আইডির নম্বরধারী মো. শহিদ উল্ল্যাহ আওয়ামী সমর্থিত একজন আইনজীবী। তিনি এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির কাছে লিখিত অভিযোগ করেন।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিতে ভুয়া আইনজীবী বা দালাল শনাক্ত করতে কাজ করছে ১২ সদস্যের আদালত ব্যবস্থাপনা কমিটি। এর আহ্বায়ক সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সহসভাপতি ড. গোলাম রহমান ভূঁইয়া। তিনি জানান, চলতি বছর লুৎফুন নাহার নামের ভুয়া আইনজীবীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তার সদস্যপদ অকার্যকর ও বাতিল করা হয়েছে। কমিটির কাছে কেউ ভুয়া আইনজীবী বিষয়ে অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া কমিটি এ ধরনের ঘটনা চিহ্নিত করতে তৎপর রয়েছে।


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১