আপডেট : ৩০ মে ২০২১
চলন্ত বাসে আবারো ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। রাজধানীর অদূরে গত শনিবার দিবাগত রাতে গণধর্ষণের শিকার হন এক তরুণী। এ ঘটনায় ৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এর আগেও চলন্ত বাসে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটেছে। তারমধ্যে টাঙ্গাইল ও কিশোরগঞ্জের দুটি ঘটনা দেশব্যাপী আলোচিত হয়। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, নারীদের নিরাপদ পরিবেশ এখনো আমরা নিশ্চিত করতে পারেনি। একজন নারী বাসে করে তিনি তার গন্তব্যে যাচ্ছেন অথচ বাস তার জন্য নিরাপদ না। তাহলে নারীরা চলাফেরা করবেই বা কেমন করে আবার তারা চাকরি করবে কিভাবে। তাদের দাবি, যারা নারীদের ওপর এ রকম হিংস্রতা দেখাচ্ছে তাদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে পাশাপাশি আমাদের নিজেদের মানসিক অবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। আশুলিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) জিয়াউল ইসলাম জানান, ভুক্তভোগী নারীর বোন মানিকগঞ্জে থাকেন। গত শুক্রবার তিনি বোনের বাসায় যান। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড থেকে নারায়ণগঞ্জে নিজের বাসায় ফেরার জন্য তিনি বাসে ওঠেন। রাত আটটার দিকে আশুলিয়ার নবীনগর বাসস্ট্যান্ডে তাকে নামিয়ে দেওয়া হয়। এ সময় বাসের জন্য তিনি অপেক্ষা করতে থাকেন। রাত নয়টার দিকে নিউ গ্রামবাংলা পরিবহনের একটি মিনিবাসের চালকের সহকারী মনোয়ার ও সুপারভাইজার সাইফুল ইসলাম এসে টঙ্গী স্টেশন রোডের কথা বলে তার কাছে ৩৫ টাকা ভাড়া চান। তিনি মিনিবাসে উঠলে গন্তব্যে যাওয়ার আগেই সব যাত্রীকে নামিয়ে দেওয়া হয়। চালক বাসটি নিয়ে আবার নবীনগরের দিকে রওনা হন। এ সময় বাসের জানালা ও দরজা আটকে বাসের চালক, সহকারীসহ ছয়জন ওই নারীকে ধর্ষণ করেন। টহল পুলিশ বাসটি থামিয়ে ভুক্তভোগীকে উদ্ধার করে। এ সময় ওই ছয়জনকে আটক করে থানায় নিয়ে আসা হয়। আটককৃতরা হলো, ঢাকার তুরাগ থানার গুলবাগ ইন্দ্রপুর ভাসমান গ্রামের নজরুল ইসলামের ছেলে আরিয়ান (১৮), কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থানার তারাগুনা এলাকার মৃত আতিয়ারের ছেলে সাজু (২০), বগুড়ার ধুনট থানার খাটিয়ামারি এলাকার সুলতান মিয়ার ছেলে সুমন (২৪), নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর থানার ধামঘর এলাকার জহুর উদ্দিনের ছেলে মনোয়ার (২৪), বগুড়ার ধুনট থানার খাটিয়ামারি এলাকার তোফাজ্জল হোসেনের ছেলে সোহাগ (২৫) ও বগুড়ার ধুপচাচিয়া থানার জিয়ানগর গ্রামের সামছুলের ছেলে সাইফুল ইসলাম (৪০)। তারা সবাই তুরাগ থানার কামারপারা ভাসমান এলাকায় ভাড়া থেকে আব্দুল্লাহপুর-বাইপাইল-নবীনগর মহাসড়কে মিনিবাস চালাতেন। পুলিশ কর্মকর্তা জিয়াউল ইসলাম বলেন, আটককৃতদের প্রত্যেকের ৪ দিনের করে রিমান্ড আবেদন করা হয়েছে। চলন্ত বাসে আলোচিত ধর্ষণ ও হত্যা : টাঙ্গাইলের মধুপুরে চলন্ত বাসে কলেজছাত্রী জাকিয়া সুলতানা রূপাকে গণধর্ষণ ও হত্যা মামলায় ২০১৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি চারজনের বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ দেন আদালত। এসময় একজনের ৭ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তৎকালীন সময়ের টাঙ্গাইল নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের ভারপ্রাপ্ত বিচারক এবং অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ প্রথম আদালতের বিচারক আবুল মনসুর মিয়া আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। ২০১৭ সালের গত ২৫ আগস্ট বগুড়া থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে রূপাকে চলন্ত বাসে ধর্ষণ করে পরিবহন শ্রমিকরা। বাসেই তাকে হত্যার পর মধুপুর উপজেলায় পঁচিশ মাইল এলাকায় বনের মধ্যে রূপার মরদেহ ফেলে রেখে যায়। এলাকাবাসীর কাছ থেকে খবর পেয়ে পুলিশ ওই রাতেই অজ্ঞাত নারী হিসেবে তার মরদেহ উদ্ধার করে। পরদিন ময়নাতদন্ত শেষে রূপার মরদেহ বেওয়ারিশ হিসেবে টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় গোরস্থানে দাফন করা হয়। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে মধুপুর থানায় হত্যা মামলা করে। পত্রিকায় প্রকাশিত ছবি দেখে রূপার ভাই হাফিজুর রহমান মধুপুর থানায় গিয়ে ছবির ভিত্তিতে তাকে শনাক্ত করলে এ ঘটনায় মামলা দায়ের হয়। ঘটনাটি সেই সময়ে দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। ২০১৮ সালের ৬ মে রাতে ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের পিরিজপুরগামী স্বর্ণলতা পরিবহনের বাসে নিজ বাড়ির উদ্দেশে যাচ্ছিলেন শাহিনুর আক্তার। বাসটি কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছালে অন্য যাত্রীরা নেমে যান। পরে কটিয়াদী থেকে পিরিজপুরে যাওয়ার পথে কিশোরগঞ্জ-ভৈরব সড়কের বাজিতপুর উপজেলার বিলপাড় গজারিয়া জামতলী এলাকায় চলন্ত বাসে চালক নুরুজ্জাামান, চালকের সহযোগী লালন মিয়া ও চালকের খালাতো ভাই বোরহান উদ্দিন তাকে ধর্ষণের পর চলন্ত বাস থেকে ফেলে দেন। মুমূর্ষু অবস্থায় শাহিনুরকে উদ্ধার করে কটিয়াদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ময়নাতদন্তে শাহিনুরকে গণধর্ষণের পর হত্যার আলামত পাওয়া যায়। শাহিনুর আক্তার রাজধানীর ইবনে সিনা হাসপাতালে নার্স হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ঘটনার পরের দিন নিহতের বাবা মো. গিয়াস উদ্দিন বাদী হয়ে বাসের চালক নূরুজ্জামান নূরু, চালকের সহকারী লালন মিয়া, হাসপাতালে তানিয়ার মরদেহ নিয়ে আসা আল আমিন এবং পিরিজপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল্লাহ আল মামুনসহ চারজনের নাম উল্লেখ করে আরো কয়েকজনের বিরুদ্ধে বাজিতপুর থানায় ধর্ষণ ও হত্যা মামলা করেন। এ ঘটনাটি চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। দোষীদের বিচারের দাবিতে উত্তাল হয় সারা দেশ। গত বছরের ৮ নভেম্বর গাজিপুরের কালিয়াকৈরে বাসে ফেরি করে চকলেট বিক্রেতা এক নারী চলন্ত বাসে ধর্ষণের শিকার হন। জানা যায়, ওই নারী শনিবার রাত ৯টার দিকে কালিয়াকৈর থানাধীন চন্দ্রা বাসস্ট্যান্ডে এলে তার পূর্ব পরিচিত পরিবহন শ্রমিক মো. শরীফ হোসেন (২০) ও সাদ্দাম হোসেন (২২) তাকে গাজীপুর মহানগরীর চান্দনা চৌরাস্তায় যাওয়ার কথা বলে তাকওয়া গাড়িতে তুলে। বাসটি তাকে নিয়ে যাত্রীসহ গাজীপুর চৌরাস্তায় আসে। পুনরায় খালি বাসে করে তাকে নিয়ে কালিয়াকৈর থানার পল্লীবিদ্যুৎ এলাকায় ফ্লাইওভারের ওপর বাস থামিয়ে তাকে অনৈতিক প্রস্তাব দেয়। এতে সে রাজি না হলে তারা ওই নারীকে জাপটে ধরে টানাহেঁচড়া করে পরিহিত কাপড়চোপড় ছিঁড়ে ফেলে। তার চিৎকারে আশপাশের লোকজনসহ টহল পুলিশ এগিয়ে আসতে থাকলে তারা ওই নারীর গায়ের ওড়না দিয়ে নাক-মুখ বেঁধে ফেলে। পরে চালক সাদ্দাম হোসেন বাস চালিয়ে চন্দ্রার দিকে যেতে থাকলে টহল পুলিশ বাস থামানোর জন্য সিগন্যাল দেয়। চালক বাস না থামিয়ে চন্দ্রার দিকে যেতে থাকলে পুলিশ পেছন দিক থেকে ধাওয়া করে। একপর্যায়ে চালক সাদ্দাম হোসেন বাস চালিয়ে চন্দ্রা হতে ইউটার্ন নিয়ে কালিয়াকৈর থানাধীন মৌচাক এলাকায় এসে বাম দিকে ভান্নারাগামী রাস্তা দিয়ে কালিয়াকৈর থানাধীন জামালপুর আসার পথে রাত অনুমান ১টার দিকে বাসে থাকা আরেক চালক মো. শরীফ হোসেন তাকে জোরপূর্বক একাধিকবার ধর্ষণ করে। পরে বাসটি জয়দেবপুর থানার ভাওয়াল মির্জাপুর ও মাস্টারবাড়ি হয়ে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক দিয়ে ময়মনসিংহের দিকে যাওয়ার সময় শনিবার রাত সোয়া ২টার দিকে মেম্বারবাড়ি স্ট্যান্ডের কাছে পৌঁছলে টহল পুলিশ বাস থামানোর জন্য সিগন্যাল দেয়। তারা সিগন্যাল অমান্য করে বাস চালিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ রাস্তা ব্যারিকেড দিয়া বাস থামায়। এ সময় ধর্ষক মো. শরীফ হোসেন বাস থেকে কৌশলে নেমে দৌড়ে পালিয়ে যায়। পরে পুলিশ ওই নারীকে উদ্ধার করে এবং বাসের চালক মো. সাদ্দাম হোসেনকে আটক ও বাসটি জব্দ করে। সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর চলন্ত বাসে একাদশ শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে গিয়ে বাস থেকে লাফ দেয়। এতে সে গুরুতর আহত হয়। পরে স্থানীয় লোকজন উদ্ধার করে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে। সৃষ্টি হিউম্যান রাইটসের ভাইস চেয়ারম্যান শাহাদাৎ হোসেন মুন্না বলেন, পথেঘাটে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, পাশাপাশি তাদের কর্মস্থলও। তিনি বলেন, বাসের মধ্যে যারা এ ধরনের জঘন্য কাজের সঙ্গে জড়িত তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) সোহেল রানা বলেন, এসব ঘটনায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে পুলিশ তদন্ত করে এবং অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে। তিনি বলেন, এগুলো প্রতিরোধে নিজেদের মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন। নারী বিপদে পড়লে তাদের সহায়তার জায়গায় বিপদে ফেলা এটা জঘন্য মানসিকতার কাজ। তিনি বলেন, এসব ঘটনা প্রতিরোধে পুলিশ বদ্ধপরিকর।
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১