আপডেট : ০৬ নভেম্বর ২০২১
জ্বালানি তেল ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে হঠাৎ গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে সারা দেশে গণপরিবহন বন্ধ করে দেন মালিক-শ্রমিকরা। এতে চরম ভোগান্তির শিকার হন সাধারণ মানুষ। ছুটির দিন হলেও বিভিন্ন সরকারি পরীক্ষা ও পূর্বনির্ধারিত পরীক্ষা থাকায় মহাবিপদে পড়েন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। বিশেষ করে গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সাতটি সরকারি কলেজের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া আরো ১৯ প্রতিষ্ঠানের চাকরির পরীক্ষা থাকায় পরিবহন সংকটে চরম ভোগান্তিতে পরেন লাখো পরীক্ষার্থী আর চাকরিপ্রার্থী। পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা বলছেন, জ্বালানি তেলের বাড়তি মূল্যের সাথে ভাড়া সমন্বয় করতে হবে। তা না হলে বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন এবং বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান ড্রাইভার ইউনিয়ন যৌথভাবে আগামীকাল রোববার পর্যন্ত গণপরিবহন চলাচল বন্ধ রাখবে। এদিকে ভাড়া বৃদ্ধি না করা হলে আজ শনিবার থেকে লঞ্চ চলাচল বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে নৌযান মালিক শ্রমিকরা। এদিকে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে খরচ বেড়েছে ডিজেলে চালিত বাস-ট্রাকের। তাই ভাড়া বৃদ্ধি বা তেলের দাম কমানোর দাবিতে তার সব ধরনের পরিবহন চলাচল বন্ধ রেখেছে। কিন্তু এই সুযোগে রাজধানীতে গ্যাসে চালিত পরিবহনও বন্ধ রাখেন মালিক-শ্রমিকরা। চলেনি দূরপাল্লার যানবাহনও। ফলে চাপ বেড়ে যায় লঞ্চ ও ট্রেনে। ঢাকা-বরিশালসহ অভ্যন্তরীণ রুটে লঞ্চে বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা। অন্যদিকে, পণ্য পরিবহন বন্ধ থাকায় চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাস ব্যহত হয়। জানা গেছে, কোনো আলোচনা ছাড়াই জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে ক্ষুব্ধ পরিবহন মালিক সমিতির নেতাকর্মীরা। এ অবস্থায় জ্বলানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে ভাড়া সমন্বয়ের দাবি বাস মালিক-শ্রমিকদের। বাস মালিকরা জানান, পূর্বের ভাড়াই এখনো সমন্বয় করা হয়নি। সেখানে আবার নতুন করে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। এতে মালিকদের ভর্তুকি দিয়ে গণপরিবহন চালাতে হবে। আর জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির নেতারা। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে থাকায় গত বুধবার বাংলাদেশে ডিজেল ও কেরোসিন লিটার প্রতি ১৫ টাকা করে বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এর প্রতিবাদে শুক্রবার সকাল থেকে দেশব্যাপী অনির্দিষ্টকালের পরিবহন চলাচল বন্ধ করে দেন মালিক-শ্রমিকরা। এ কারণে সকল ধরনের দূরপাল্লার বাস ও পণ্য পরিবহন বন্ধ থাকায় যাত্রীরা পড়েন দুর্ভোগে। লকডাউনের কারণে যেসব গণপরিবহন এবং পণ্য পরিবহন মালিকেরা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন, তারাই ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে এই কর্মসূচি পালন করছেন। তারা ভাড়া পুনর্নির্ধারণের দাবিও জানিয়েছেন। গতকাল ঢাকার রাস্তায় হাতেগোনা দুই-তিনটি কোম্পানির বাস এবং রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) বাস চলাচল করতে দেখা গেছে। ফলে চাপ বেড়ে যায় বিআরটিসি বাসে ও সিএনজি অটোরিকশায়। সকাল থেকে ঢাকার মিরপুর, ফার্মগেট, শাহবাগ, মহাখালী, মালিবাগ, মৌচাক, রামপুরা, বাড্ডা, নতুনবাজারসহ বিভিন্ন পয়েন্ট ঘুরে দেখা গেছে শুধু বিআরটিসি বাস। ভাড়ায় চালিত সিএনজি, লেগুনা, রিকশা এবং নিজস্ব পরিবহন ছাড়া আরো তেমন কোনো গণপরিবহন চলেনি। ফলে দূরপাল্লার যাত্রীরা আগে থেকে জানতে না পারায় ভোগান্তির শেষ ছিল না। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষায় থেকে যাত্রীদের মাঝে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। এমনকি অনিশ্চয়তায় থেকে অনেকে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। কমলাপুরে গিয়ে দেখা গেছে, শুধু বিআরটিসি বাস ছাড়া অন্য সব ধরনের পরিবহন বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারি বিভিন্ন পরিবহন বন্ধ করে রাস্তার পাশে বাস দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে এবং সব ধরনের কাউন্টার বন্ধ রাখা রয়েছে। গাবতলীতে গিয়ে দেখা যায়, বাসে কন্ডাক্টর ও সুপারভাইজারেরা অলস সময় পার করছেন। কাউন্টার খোলা থাকলেও টিকিট বিক্রি হচ্ছে না। নাটোরের যাত্রী জব্বার মিয়া বলেন, কল্যাণপুরে এসে জানতে পারলাম আজ বাস চলছে না। বিপদে পড়েছি, বাড়িতে যাওয়া আজ খুবই জরুরি। এভাবে হঠাৎ করে পরিবহন ধর্মঘটের কারণে সাধারণ জনগণ দুর্ভোগে পড়েছে বলে জানান তিনি। যাত্রাবাড়ীতে গিয়ে দেখা গেছে, কোনো ধরনের পরিবহন না থাকায় হেঁটেই রওনা দিচ্ছেন। আবার অনেকে গাড়ি না পাওয়ার কারণে বাড়তি টাকা দিয়ে রিকশা বা সিএনজিচালিত অটোরিকশায় গন্তব্যে যাচ্ছেন। দুর্ভোগের শিকার অপর এক যাত্রী বলেন, গাবতলী থেকে মানিকগঞ্জ যেতে সিএনজি অটোরিকশায় লাগে ৮০ টাকা। এখন আমাকে দিতে হচ্ছে ১৫শ টাকা। প্রতিজনের জন্য ৫০০ টাকা করে। তসলিমা ইসলাম নামের এক নারী বলেন, জাতীয় হূদরোগে আমার আব্বা ভর্তি আছেন। তাঁকে সব সময় আমার পরিবারের অনেকে সেবা করছেন। আমার বাসা নারায়ণগঞ্জ। আব্বার জন্য বাসা থেকে কিছু খাবার ও জামা-কাপড় আনার জন্য গতকাল নারায়ণগঞ্জ গেছি। কিন্তু, আজ সকাল থেকে বাসা না চলায় বাড়তি ভাড়া দিয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশা করে যাত্রাবাড়ী এসেছি। এখন আবার ভেঙে ভেঙে রিকশায় যাব। যা টাকা ছিল, সব শেষ। এভাবে আরও যদি ধর্মঘট থাকে তাহলে চরম বিপদে পড়তে হবে বলে জানান তিনি। এদিকে, গতকাল সরকারি ও বেসরকারি চাকরি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজের পরীক্ষাসহ মোট ২৬টি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরিবহন বন্ধ থাকায় পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছাতে পরীক্ষার্থীদের গুনতে হচ্ছে বাড়তি টাকা। রাস্তায় বাস না থাকায় রিকশা ও অটোরিকশাতে করেই যাতায়াত করতে হয়েছে তাদের। এক নারী পরীক্ষার্থী বলেন, এটা একটা ভোগান্তি না। যারা পরীক্ষার্থী আছে তারা তো অনেক টেনশনে আছে। আমি না হয় কাছ থেকে এসেছি কিন্তু যারা দূরে থাকে, ঢাকার বাইরে থেকে এসেছে তাদের জন্য তো এটা চরম ভোগান্তি। আরো এক পরীক্ষার্থী বলেন, আমি তো বাস দিয়েই আসতাম তাহলে ভাড়া কম লাগতো। কিন্ত এখন তো সিএনজি অটোরিকশাতে আসতে হয়েছে। ডাবল টাকা লেগেছে। অভিযোগের সুরে আরো একজন পরীক্ষার্থী জানান, পাঁচশ টাকার বাড়া সাতশ টাকা দিয়ে এসেছি। আমাদের আবার যেতে হবে বরগুনার পাথরঘাটায়। এখানে আবার দুইদিন হোটেলে থাকতে হয় কি-না সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। মিজানুর রহমান নামে এজ চাকুরিজীবী জানান, ফার্মগেট থেকে মহাখালী আসার উদ্দেশ্যে বিআরটিসি বাসে উঠলে তার কাছে ৫০ টাকা ভাড়া দাবি করা হয়। পরবর্তীতে যাত্রীদের সঙ্গে বাসের চালক ও হেলপারের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়। সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, ভোক্তা পর্যায়ে লিটারপ্রতি জ্বালানি তেলের দাম ১৫ টাকা বৃদ্ধি হওয়ায় ভর্তুকি দিয়ে গণপরিবহন চালানো সম্ভব হবে না। ডিজেলের মূল্য ৬৫টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০ টাকা করা হয়েছে এবং বৃহস্পতিবার থেকে এই দাম কার্যকর হয়েছে। তিনি জানান, সংগঠনের পক্ষ থেকে আমি চিঠি দিয়েছি বিআরটিএ চেয়ারম্যানের কাছে। এই চিঠিতে জরুরিভাবে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরসহ দূরপাল্লার বাস ভাড়া বাড়ানোর দাবি জানানো হয়েছে। আট বছর ধরে ভাড়া বাড়ানো হয়নি। এখন তা বাড়াতে হবে। ভাড়া সমন্বয় না হলে পরিবহন মালিকরা গাড়ি চালাবেন না। তাদের সিদ্ধান্ত বহাল রয়েছে। আমরা সংগঠনের পক্ষ থেকে কোনো ঘোষণা না দিলেও গাড়ি বন্ধ থাকবে। বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সাধারণ সম্পাদক রাকেশ ঘোষ বলেন, সংগঠনের পক্ষ থেকে ধর্মঘটের ঘোষণা দেওয়া হয়নি। কিন্তু মালিকরা গাড়ি চালাবেন না। আঞ্চলিক কমিটিগুলো বিভিন্ন জেলায় বাস চলাচল বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে। তবে ভাড়া সমন্বয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বিআরটিএ-তে রোববার বৈঠক ডাকা হয়েছে। তাই দাবি আদায় লক্ষ্যে রোববার পর্যন্ত চলবে এ ধর্মঘট বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ তোফাজ্জল হোসেন মজুমদার জানান, জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে বাসের ভাড়া সমন্বয়ের সঙ্গে ট্রাক-কাভার্ডভ্যানের সম্পর্ক নেই। তবে পরিবহন মালিকরা খরচ নিয়ে অনেক চাপের মধ্যে আছে। এখন ডিজেলের দাম বাড়ায় আমাদের পক্ষে যানবাহন চালানো অসম্ভব হয়ে পড়বে। এই পদক্ষেপ (জ্বালানির দাম বৃদ্ধি) পুরোপুরি অযৌক্তিক। তেলের দাম বৃদ্ধিতে পণ্যবাহী একটি ট্রাকের ঢাকা-চট্টগ্রাম যাতায়াত খরচ বেড়েছে ২২০০ টাকা। বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ রুস্তম আলী খান জানান, জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে তাদের সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো আলোচনা করা হয়নি। এমনকি তেলের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে কোনোরকম পূর্বাভাসও দেওয়া হয়নি। বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার জানান, ভাড়া বাড়াতে মালিকদের কাছ থেকে আবেদন পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে রোববার বৈঠক ডাকা হয়েছে।
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১