আপডেট : ০৬ নভেম্বর ২০২১
মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানির প্রতারণায় ফতুর হয়েছেন দেশের লাখ লাখ আমানতকারী। দ্বিগুণ মুনাফার লোভ দেখিয়ে কিছু কোম্পানির কর্মকর্তারা টাকা নিয়ে পালিয়েছে, কিছু কোম্পানির কর্মকর্তারা গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছে। ২০১২ সালের ডেসটিনি কেলেঙ্কারির পর থেকে এখনো থামেনি এই কারবার। এমএলএম’র পাশাপাশি নতুন করে ই-কমার্সের নামেও প্রতারণার ফাঁদে পড়ে সর্বস্ব হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ। জানা গেছে, বিভিন্ন এমএলএম, অনলাইন ও ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো নানা প্রলোভন দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অন্তত ৪০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। গ্রাহকরা তাদের বিনিয়োগের এই পুঁজি ফেরত পাবেন কি না তা অনিশ্চিত। এরই মধ্যে প্রতারিত লাখ লাখ গ্রাহক পথে বসেছে। অতি মুনাফার ফাঁদে ফেলে গ্রাহকদের টাকা লুটের সবচেয়ে বড় দুটি উদাহরণ ডেসটিনি ও যুবক। এ দুটি প্রতিষ্ঠান সাধারণ গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করে প্রায় ৭ হাজার ১০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ৪ হাজার ১১৯ কোটি ২৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে বিচার চলছে ডেসটিনি গ্রুপের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, পরিচালকসহ ২২ জনের। কথিত মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানি (এমএলএম) ইউনিপেটুইউতে ১০ মাসে দ্বিগুণ লাভের আশায় ৬ লাখ বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগ করা ৬ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় চেয়ারম্যান শহীদুজ্জামান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুনতাসির হোসেন। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ২০১১ সালের ইউনিপেটুইউ’র কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিনিয়োগকারীদের অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে মামলা করে। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠানটির ওপর তদন্ত করেও এসব তথ্যের প্রমাণ পায়। এ ছাড়া ২০১৩ সালে প্রায় পাঁচ লাখ গ্রাহকের কাছ থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় আইসিএল গ্রুপ। পরবর্তীকালে নামসর্বস্ব ১৩টি প্রতিষ্ঠান ফেলে উধাও হয়ে যায় গ্রুপটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও মূল উদ্যোক্তা শফিকুর রহমানসহ পরিচালকরা। যদিও পরে গ্রুপটির মূল উদ্যেক্তা শফিকুর রহমান ও তার স্ত্রী আইসিএল গ্রুপের পরিচালক কাজী সামসুন নাহার মিনা র্যাবের হাতে আটক হন। তবে এখনো প্রতারিত গ্রাহকরা টাকা ফিরে পায়নি। ১৭ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ‘এহসান গ্রুপ পিরোজপুর-বাংলাদেশ’ নামের এক কোম্পানির চেয়ারম্যান রাগীব আহসান এবং তার এক সহযোগীকে সম্প্রতি গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। এহসান মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড, এহসান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড বিল্ডার্স লিমিটেডসহ কয়েকটি মাদরাসা খুলে ওই কোম্পানি ব্যবসা চালিয়ে আসছিল। গ্রাহকের অর্থ আত্মসাতের পর প্রতিষ্ঠানের মালিকদের কেউ কেউ দেশত্যাগ করছেন, বিদেশে পাচার করছেন বিপুল পরিমাণ অর্থ। ইভ্যালি ও ই-অরেঞ্জসহ আলোচিত ১৪টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে তদন্ত করে এমন অভিযোগ পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো হলো সিরাজগঞ্জ শপ, ধামাকা শপিং ডটকম, নিরাপদ ডটকম, আলাদিনের প্রদীপ, আলেশা মার্ট, কিউ-ডটকম, বুমবুম, আদিয়ান মার্ট, নিডস, দালাল, এসকে ট্রেডার্স ও মোটরস। এর মধ্যে ধামাকা শপিং গ্রাহকের ৫৯৮ কোটি টাকা নিয়ে পলাতক রয়েছে। যদিও প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ১১৭ কোটি টাকা পাচারের ‘প্রমাণও পেয়েছে’ সিআইডি। এ জন্য প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএমডি জসিম উদ্দিন চিশতিসহ তার স্ত্রী ও তিন সন্তান ও ধামাকা শপিংয়ের এক পরিচালক এবং চারটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে তারা। ই-অরেঞ্জ নামের একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষ প্রতারণামূলকভাবে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। প্রতিষ্ঠানটির মালিকদের কয়েকজন গ্রেপ্তারের পর এখন কারাগারে। আরেক মালিক পুলিশ কর্মকর্তা সোহেল রানা ভারতে আটক হয়েছেন। বিভিন্ন ছাড়ে পণ্য কিনতে এ প্রতিষ্ঠানে যারা টাকা দিয়েছিলেন তারা এখন চিন্তায় আছেন আদৌ টাকা ফেরত পাবেন কিনা। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার আটক করা হয় ই-ভ্যালির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন ও এমডি মোহাম্মদ রাসেলকে। চটকাদার ছাড়ের মাধ্যমে সারাদেশে বিপুল পরিমাণ গ্রাহক তৈরি করে প্রতিষ্ঠানটি। তবে দীর্ঘদিন ধরেই গ্রাহকদের পাওনা পরিশোধ করতে পারছিল না তারা। গ্রাহকদের কয়েকশ কোটি টাকার পণ্য পাওনা থাকলেও ই-ভ্যালি কর্তৃপক্ষ তা দিতে কালক্ষেপণ করে আসছিলেন। গত বছরের জানুয়ারিতে রাজধানীর কলাবাগান এলাকা থেকে ই-কমার্সের নামে যাত্রা শুরু করে এমএলএম কোম্পানি এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আল আমিন প্রধানের নেতৃত্বে অন্য সহযোগীরা গত বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মাত্র ১১ মাসে ২৬৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। গত বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি আল আমিনসহ প্রতিষ্ঠানটির ছয়জন গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। ওই ঘটনায় মামলা হয় এবং আল আমিনসহ ছয়জনকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। কিন্তু দুই মাসের ব্যবধানে জামিনে বেরিয়ে আবারও এসপিসির কার্যক্রম শুরু করেন আল আমিন প্রধান। জানা যায়, এর পরও থামেনি এসপিসির কার্যক্রম। বর্তমানে প্রায় পঞ্চাশ লাখের অধিক নিবন্ধনকারী রয়েছে এসপিসির। প্রতি অ্যাকাউন্ট বাবদ এসপিসিকে দিতে হয় ১২০০ টাকা। এর পর বলা হয়- প্রতিদিন ২০ সেকেন্ড করে ওয়েবসাইট ভিজিট করলেই গ্রাহক পাবেন ১০ টাকা। এর পর তিনজনকে অ্যাড করতে পারলেই মিলবে অতিরিক্ত টাকা। এ ক্ষেত্রে ১ জনকে যুক্ত করলে অর্থাৎ স্পনসর বোনাস ৪০০ টাকা। এসব প্রতিষ্ঠানই নয়, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় শহরগুলোয় ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে নানা ধরনের ই-কমার্স ও এমএলএম কোম্পানি। এসব প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের লাভের লোভ দেখিয়ে আকৃষ্ট করে অর্থ আত্মসাৎ করে আসছে। রাজধানীর মালিবাগ, মগবাজার, গুলশান, ফার্মগেট, হাতিরপুল, মতিঝিল, পল্টনে বেশি সক্রিয় এমএলএম প্রতিষ্ঠানগুলো। অনেক প্রতিষ্ঠানেরই একাধিক অফিস রয়েছে। ‘এক্সিলেন্ট ওয়ার্ল্ড’ নামক এমএলএম কোম্পানির প্রধান নির্বাহী আনোয়ার এইচ রয়েল রানা। ‘উইন লাইফ গ্লোবাল লিমিটেড’ পরিচালনা করছেন মো. মনিরুল ইসলাম কাইয়ুম। ‘ডেলি বাজার লিমিটেড’ নামের এমএলএম চালাচ্ছেন আমিনুল ইসলাম হূদয়। ‘পাওয়ার লাইফ বিডি লিমিটেড’-এর কান্ট্রি ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন রেজাউল লতিফ রিপন। মালয়েশিয়াভিত্তিক ‘ইনফিনিটি’ পরিচালিত হচ্ছে গুলশান-১ এ জব্বার টাওয়ার থেকে। ‘এবি নিউট্রিক ইন্টারন্যাশনাল’ ঢাকার বায়তুল ভিউ টাওয়ার এবং চট্টগ্রাম থেকে পরিচালিত হচ্ছে। রাইন রাজ্জাক প্লাজায় ‘মর্ডার্ন এমএক্সএন লিমিটেড’ চালাচ্ছেন আলমগীর মতি। পল্টনভিত্তিক অনেকগুলো এমএলএম সক্রিয় থাকলেও ‘মিশন-১০’ নেটওয়ার্ক সবচেয়ে বড়। ‘ওয়াল মিশন’ পরিচালিত হচ্ছে বিজয়নগর স্কাইলার্ক সেন্টার থেকে। রাজধানীর মোতালেব প্লাজাসহ হাতিরপুলেই ৩০টির মতো এমএলএম কোম্পানির ব্যবসার কার্যালয় রয়েছে। এ ছাড়া এমিটাচ, এমলবিং, টিয়ানশি, ফরএভার, এক্সিলেন্ট ফিউচার, ডিএক্সএন, এবিনিউট্রিক, এডভান্স বাংলা, ডি কাসিক লাইভ, ডাহিসেন, ড্রিম টুগেদার, পিনাকল, এসএমএন গ্লোবাল, সানসু লাইফ, লাইফওয়ে বিডি, লাক্সার গ্লোবাল, এমওয়ে ভিনশন বেশি সক্রিয়। গত এক মাসে অন্তত ১০টি অনলাইন এমএলএম কোম্পানি বিপুলসংখ্যক গ্রাহকের কয়েকশ কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ইনসাফ সেভেন, টু-লাইক, গোল্ডরাশ, গোল্ড লাইন, বিন্দাসওয়ার্ক ডট কম, বিডি লাইক, ইফোর্ডবিডি, জিওনেস, লাইক এইচএমপি ওয়ার্ল্ড, টু-লাইক ওয়েব, বিডি ক্যাশ রিওয়ার্ডস, স্টারস ফেয়ার২৫.কম, ওয়ালমার্ট গ্রুপ, জিএসসিবিডি, ইউকে লাইকসহ অনেক কোম্পানি। ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) জেনারেল ম্যানেজার জাহাঙ্গির আলম বলেন, উন্নত দেশে ই-কমার্স খাতে নজরদারি ও স্বচ্ছ প্রতিযোগিতা পর্যবেক্ষণের জন্য ফেয়ার ট্রেড কমিশন থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে এ ধরনের কোনো কমিশন নেই। আমাদের প্রতিযোগিতা কমিশন রয়েছে। কিন্তু এটির ক্ষেত্র সীমিত। তা ছাড়া সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যেও সমন্বয়হীনতা রয়েছে। সিআইডির ডিআইজি শেখ নাজমুল আলম বলেন, আমানতকারীদের টাকা আত্নসাতকারীদের অভিযান চলমান রয়েছে। আমরা যার বিরুদ্ধেই অভিযোগ পাচ্ছি তাদের বিরুদ্ধেই আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১