আপডেট : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪
শ্রীপুর (গাজীপুর) প্রতিনিধি: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নির্বাচিত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম গাজীপুরের শ্রীপুরে অবৈধভাবে রেকর্ডের রাস্তা, সরকারি খাল ও পারিবারিক কবরস্থান দখল করে গড়ে তোলেছেন খামারবাড়ি।স্থানীয় গরীব,অসহায় মানুষকে রেজিষ্ট্রি বায়নার ফাঁদে ফেলে প্রায় ২০ বিঘা জমি দখল-জবরদখলের অভিযোগ রয়েছে সাবেক এ মেয়রের বিরুদ্ধে। সাবেক এই মেয়রের হাত থেকে রক্ষা পায়নি রেকর্ডের রাস্তা, সরকারি খাল ও পারিবারিক কবরস্থান। রেকর্ডের রাস্তা,লবলং খাল ও ব্যাক্তি মালিকানা জমি দখলের জন্য বিভিন্ন জালজালিয়াতির এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে স্থানীয় একাধিক দালালের ভূমিকা রয়েছে।মেয়র আতিকের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে জাল-জালিয়াতির কাজে অংশ নিতে দ্বিধা বোধ করতেন না তাঁরা। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ধনুয়া এলাকার আজিম উদ্দিন ওরুফে আঝুর ছেলে বাবুল।দখল-দূষণের কারণে অস্তিত্ব সংকটে পড়া লবলং খালের গতিপথ পরিবর্তন করে লবলঙ্গে শেষ থাবা বসিয়েছেন মেয়র আতিক।খালটি দখলের বিষয়ে ইতিমধ্যে উপজেলা সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) অবহিত করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। খোঁজ নিয়ে জানা যায়,আতিক ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র হওয়ার পর সম্পদে ফুলেফেঁপে ওঠেন।মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর ক্ষমতার দাপটে ঢাকার পাশাপাশি গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার গাজীপুর ইউনিয়নের ধনুয়া নতুন বাজার এলাকায় অবৈধভাবে বিপুল সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন সাবেক এ মেয়র। অভিযোগ রয়েছে,উপজেলার ধনুয়া গ্রামে পারিবারিক কবরস্থান,রেকর্ডের রাস্তা ও সরকারি খাল দখল,নাম মাত্র বায়না দিয়ে ব্যক্তিমালিকানা জমি দখল করে প্রায় ২শ বিঘা সম্পত্তির মাঝে গড়ে তোলেছেন বিশাল এক বাগান বাড়ি। বাগান বাড়ির ২শ বিঘা জমির মধ্যে প্রায় এক তৃতীয়াংশ দখল-জবরদখলকৃত সম্পত্তি। এ বাগান বাড়ির ভিতরে রয়েছে ফাইভ স্টার মানের সুইমিংপুল সহ সুবিশাল কটেক্স,মাছ চাষের জন্য বিশাল পুকুর ও হাঁসের খামার।বিশাল খামারবাড়ির যতদূর চোখ যায় সবই হচ্ছে আতিকের।স্থানীয় বাসিন্দারা জমি বিক্রি করতে না চাইলে জমির মালিকদের ওপর চড়াও হতো আতিকের পেটুয়া বাহিনী। স্থানীয় কয়েকজন দালাল নিজেদের পকেট ভারী করার জন্য মেয়র আতিককে সহযোগিতা করেন। স্থানীয় দালালদের অত্যাচারে ভুক্তভোগীরা ভয়ে ওই সময় মুখ খোলতে সাহস পাননি। এলাকায় খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে,মেয়র আতিক ২০০৮ সালে উপজেলার গাজীপুর ইউনিয়নের ধনুয়া মৌজায় কিনে গড়ে তুলেছেন বিশাল এক খামারবাড়ি। জমি কেনার পাশাপাশি খামারবাড়ি তৈরিতে জোরপূর্বক দখল করা হয়েছে পারিবারিক কবরস্থান,রেকর্ডের রাস্তা,সরকারি খাল এবং ব্যক্তি মালিকানা প্রায় ২০ বিঘা জমি। বর্তমানে সাবেক মেয়রের গড়া প্রকল্পের দুই পাশে লবলঙ্গের অস্তিত্ব থাকলেও খামারবাড়ির অংশে এর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে । তবে এর সামান্য অংশ ফাঁকা রেখে তৈরি করেছেন কাঠের সেতু। শ্রীপুর উপজেলা সদরের বুক চিরে বয়ে চলা লবলঙ্গ নদের বেশির ভাগ অংশ দখল আর দূষণের কারণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। সরেজমিনে দেখা যায়, খামারবাড়ির পাশাপাশি লবলঙ্গ খাল দখল করে গড়ে তুলেছেন আরও বিভিন্ন স্থাপনা। আতিকুলের গড়া এই প্রকল্পে এসে বোঝার উপায় নেই, এই খামারবাড়ির মাঝখান দিয়ে একটি নদ বয়ে গেছে। তবে খামারের দুই পাশে এর অস্তিত্ব এখনো দৃশ্যমান। খামারবাড়িতে কৃষিজমি ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে বেশ কয়েকটি বিলাসবহুল ছোট-বড় কটেজ। ছোট-বড় মিলিয়ে রয়েছে বেশ কয়েকটি পুকুর। পুকুরগুলোর ঘাট পাকা করা। অর্ধশতাধিক শেডে রয়েছে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগির খামার। আছে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রজাতির পাখিও। লবলঙ্গপারের বাসিন্দা নাসির আহমেদ বলেন,মেয়র আতিক প্রজেক্টের নামে খালের বিশাল অংশ জবরদখল করেছেন। শুধু খালই নয় রেকর্ডের রাস্তা,পারিবারিক কবরস্থান ও বহু লোকের জমি টাকা না দিয়ে অন্যায়ভাবে জোরপূর্বক দখলে নিয়েছেন।স্থানীয় বাসিন্দা চানু মিয়া বলেন, ‘ছোটবেলা এই নদে সাঁতার কাটতাম। ধীরে ধীরে সেটি খালে পরিণত হলো চোখের সামনে। ২০০৮ সালের দিকে মেয়র আতিক জমি কেনা শুরু করেন। প্রথমে উঁচু জমি, এরপর কৃষিজমি কেনেন তিনি। পরে হঠাৎ করেই লবলঙ্গ নদের অংশসহ কৃষিজমি বালু দিয়ে ভরাট করে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করেন।স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ ধনুয়া মৌজার ১০ কোটি টাকা মূল্যের একখণ্ড জমি আমমোক্তারনামা জোর করে রেজিস্ট্রি করে দিতে বাধ্য করেন এক কৃষককে।তাঁদের কথামত জমি রেজিস্ট্রি না দিলে জেল জুলুমের শিকার হতে হতো। যারা জমি বিক্রি করতে রাজি হননি তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেছেন।এমনই একজন ধনুয়া গ্রামের হাবিজ উদ্দিনের ছেলে হোটেল ব্যবসায়ী মো: খোরশেদ আলম।তিনি অভিযোগ করে বলেন, ধনুয়া মৌজায় তার নিজ নামে নামজারি করা ১৭ শতাংশ জমি জোর করে রেজিস্ট্রি দিতে বাধ্য করেন।নামজারি জমাভাগের নথি নাম্বার -৭৭০৪/০৭-০৮ এবং জোত নং-৩৪৫৩। যার খতিয়ান সিএস-৫১, এসএ-২৩০,আরএস-১০৯৪ এবং দাগ এসএ ও সিএস দাগ- ১৭৪৫ ও ৪৬,আরএস ৬৬৯৩।খোরশেদ আলম আরও বলেন,তাদের পারিবারিক কবরস্থানের ৯ শতাংশ জমি দখলে নেওয়ার পর টাকা না দিয়ে উল্টো মামলা দিয়ে পুলিশের মাধ্যমে হয়রানি করা হয়েছে। তিনি অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সুদৃষ্টি কামনা করে বলেন,১৫ বছর আগে জোরপূর্বক তার নিকট থেকে দখলে নেওয়া ১৭ শতাংশ জমির বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ৫ কোটি টাকা। হয়তো জমি ফেরত নয়তো জমির বর্তমান বাজার মূল্যের সমপরিমাণ অর্থ পরিশোধের দাবি জানান। স্থানীয় বাসিন্দারা আরও জানান,মেয়র আতিকের প্রজেক্টের ভিতর দিয়ে একটি রেকর্ডের রাস্তা গেছে। যার আরএস দাগ নং-৬৬৮৮ এবং সিএস ১৭৪২ নং দাগের রেকর্ড ভুক্ত রাস্তাটি ধনুয়া নতুন বাজার এলাকার সামছুলের মোড় থেকে জামতলা এলাকা হয়ে পীরজাদা পঁচাই শাহের মাজার অতিক্রম করে বাগান বাড়ির মাঝ পথ দিয়ে উত্তর পাশে ধনুয়া ঈদগাহ মাঠ সংলগ্ন আফতাব উদ্দিন মাতবরের পুকুর পাড় পর্যন্ত। রেকর্ড ভুক্ত রাস্তার সিএস দাগ-১৭৪২ এর আরএস ৬৬৮৮ দাগের প্রায় ১ হাজার ফিট রাস্তা মেয়র আতিকের দখলে রয়েছে।মেয়র আতিকের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে জাল-জালিয়াতির কাজে স্থানীয়দের কৌশলে ফাঁদে ফেলে জোরপূর্বক জমি দখলে নিতে মৌখ্য ভূমিকা পালন করছেন ধনুয়া এলাকার আজিম উদ্দিন ওরুফে আঝুর ছেলে বাবুল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ধনুয়া নতুন বাজার এলাকার এক ব্যবসায়ী বলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কথা বলার মতো এই এলাকায় কেউ নেই। প্রকাশ্যে তো দূরের কথা, গোপনে কিছু বললেও রক্ষা নেই। কোনোভাবে কানে গেলে তাঁদের রোষানলে পড়তে হয়। মারধর ও মামলার আসামি হতে হয়, এমন উদাহরণ বহু রয়েছে। আতিকুলের গড়া প্রকল্পের দায়িত্ব থাকা বাবুল মিয়া বলেন, ‘মেয়র সাহেব স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে জমি ক্রয় করেছেন। লবলঙ্গ আমাদের প্রজেক্টের ভেতর নেই। আতিক সাহেব লবলঙ্গ জবরদখল করেননি।নদী পরিব্রাজক দল শ্রীপুর শাখার সভাপতি সাঈদ চৌধুরী বলেন, ‘দখল আর দূষণের কারণে লবলঙ্গ আজ অস্তিত্ব সংকটে। ঠিক সেই মুহূর্তে শেষ থাবা বসালেন সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম। এখন তো অস্তিত্বই নেই।খাল রক্ষায় জরুরি ভিত্তিতে উদ্যোগ নেওয়া সময়ের দাবি। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য মেয়র আতিকের মোবাইল ফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রীপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আতাহার শাকিল বলেন, ‘লবলঙ্গ দখল করে সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামের প্রকল্পের বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে ফোন করে আমাকে জানানো হয়েছে।মেয়র আতিকের পক্ষ থেকে কাগজ পত্র জমা দেওয়া হয়েছে। ইউনিয়ন ভূমি অফিস কে তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।বিষয়টি তদন্ত করে লবলঙ্গ মুক্ত করা হবে।
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১