এখন আমার প্রতিবেশী বলতে জঙ্গলের দুইটা গুঁইসাপ, আমার শোবার ঘরের পেছনেই, তাঁদের একটা বাচ্চা আর জলাশয়ের ঐ পাড়ের বসত বাড়ির চারটা ভিনদেশি হাঁস। আমি ঘুরেফিরে সারাদিন এদেরকেই দেখি। হেমন্তের শুরু হওয়ায় রাতটা মাঝেমধ্যে দীর্ঘ এবং একঘেঁয়ে লাগে তবে থেমে থেমে শিয়ালের ডাক সেই একগুঁয়েমির ভার কিছুটা নিজের কাঁধে নেয়। গত সেপ্টেম্বর থেকে আমি এখানেই থাকছি, গাজীপুরের নন্দীবাড়ি গ্রামে। নতুন কোন ছবির পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে থাকতে শুরু করিনি, যেমনটা আদিমের বেলায় ঘটেছিলো, টানা সাতমাস বস্তিতে থেকেছিলাম তাঁদের নিয়ে ছবি বানাবো বলে। আচ্ছা! লিখতে শুরু করে আমি কেমন কলকাতার টোনে লিখছি অথচ সচরাচর আমি সচেতনভাবে টঙ্গীর আঞ্চলিক ভাষাতেই কথা বলি!
টঙ্গীতেই আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা, আমার বাড়ি। কিন্তু আমি আর থাকতে পারছিলাম না টঙ্গীতে, নিজের ঘরেই আমার কেমন দমবন্ধ হয়ে আসছিল। একসময় টের পাই জীবন থেকে আমার পালানোর প্রস্তুতি চলছে। আমি আর নিতে পারছিলাম না। বুঝতে পারছিলাম আমার তুমুল একাকিত্ব দরকার, ঘর ছাড়ি! এরপর থেকেই আমার এখানে থাকা শুরু। যখন থাকতে শুরু করি তখন বিলের ভরা যৌবন, একটা নৌকার বন্দোবস্ত হয়। বিলে নৌকা নিয়ে ঘুরি, বিলের পাড়ে বসে থাকি, মাঝেমধ্যে কামরুল ভাই, দুলাল ভাইয়ের সঙ্গে আড্ডা দেই। তবে দুলাল ভাইকে খুব একটা পাওয়া যায় না, আমি ঘটনা জানতে চাই। দুলাল ভাই জানায়, প্রায়ই তাঁর মা তাঁকে একা রেখে টঙ্গীতে চলে যান, আগে যেখানে তাঁরা থাকতেন। দুলাল ভাই বাড়িতে থেকে হাঁস-মুরগি দেখাশোনা করেন, মায়ের জন্য অপেক্ষা করেন, কিন্তু কোনো কোনো দিন তাঁর মা বাড়ি ফেরেন না, টঙ্গীতে থেকে যান।
দুলাল ভাইয়ের কথায় আমার ভেতরে গল্প ভাবনা শুরু হয়- ‘বিলের পাড়ে দুলালের বাড়ি। বাড়ির সদস্য বলতে দুলাল, দুলারের মা, হাঁস-মুরগি আর কয়েকটা ছাগল। দুলালের মা দুলালকে রেখে প্রায়ই বিভিন্ন মাজারে জিয়ারত করতে চলে যান, হঠাৎ হঠাৎ ফিরে আসেন, ফিরে এসে দুলালকে ওলী-আউলিয়াদের নানান কেরামতির গল্প শোনান, দুলাল মুগ্ধ হয়ে শোনে। ছাগলের জন্য দুলাল বিল ধরে দূর থেকে ঘাস কেটে আনে, হাঁস-মুরগির দেখাশোনা করে, অবসরে মাছ শিকার করে। কিন্তু দুলালের একা ভালো লাগে না, মা ফিরে আসলেই মাকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদে, মা আবার গল্প শোনায়, দুলাল শান্ত হয়। একদিন দুলালের মা আর ফিরে আসে না...’
গল্প এগুতে থাকে, ট্রিটমেন্ট দাঁড় করাই, চিত্রনাট্যের কাজ চলছে। অনেকটা স্থির আছি এখন, কদিন আগেও কেমন এক হাহাকারের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম। আদিম নির্মাণের সময়টা নানান প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে গেছে, তবু দারুণভাবে বেঁচে ছিলাম সেই সময়টায়, কেননা আর্টের জার্নি আমার শরীরে প্রাণ দেয়, শরীর চলে। এই যে একা বেঁচে থাকা, এখানে কোন ছল খুঁজে পাই না। যখনই আমি অন্যের সঙ্গে কথা বলি তখনই নিজেকে অপরিচিত মনে হয়, মনে হয় এটা তো আমি না। আমার এই একার জার্নি আমার কাছে আর্টের জার্নি, নিজেকে খুঁজে পাওয়ার জার্নি।
নিজেকে কখনোই ফিল্মমেকার ভেবে স্বস্তি পাইনি আমি। একবার একজন স্ট্রিট পেইন্টারকে আমি দেখেছিলাম দীর্ঘ রাস্তাকে নিজের ক্যানভাস বানিয়ে যা খুশি তাই আঁকতে, লিখতে। কেউ কেউ দাঁড়িয়ে দেখতো, কেউ মুচকি হেসে চলে যেতো, কেউ আবার সেই পেইন্টারের সঙ্গে কথা বলতে চাইতো, ভদ্রলোক কোন কথা বলতেন না, চুপচাপ নিজের মতো এঁকে যেতেন। এরপর থেকে আমি নিজেকে স্ট্রিট পেইন্টার ভেবে সুখ পেতাম। মনে হতো, স্ক্রিন আমার ক্যানভাস, আমি যা খুশি তাই আঁকবো। এতে সুবিধা হয়, ছবির ভুলত্রুটি, সফলতা, ব্যর্থতা নিয়ে কোন ভাবনা ছিল না, নিজের আনন্দে আদিম বানিয়েছি।
এখন নিজেকে ইনকোয়ারার ভেবে স্বস্তি পাই। নিজের গ্রেটার রূপকে খুঁজি। ছবি সেই খুঁজে পাওয়ার মাধ্যম। আদিম নির্মাণের সময় আমি শুধু সেই মানুষগুলোকে দেখেছিলাম। অবজার্ভার ছিলাম শুধু, যা যা অবজার্ভ করেছি তাই আদিমে উঠে এসেছে। আমি এখনো অবজার্ভার, নিজেকে অবজার্ভ করি। এই যে দুলালের গল্প! দুলালের সঙ্গে কথা বলার পর আমি দুলালকে আর অবজার্ভ করিনি বরং নিজের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, নিজের ভেতরের লাইটকে অনুসরণ করছিলাম। এরপর আমি এক পরলৌকিক গল্প খুঁজে পাই। অতল থেকে আমার এই ছবি নির্মাণের প্রসেস শুরু হয়েছে, সেক্ষেত্রে অতলকে আমি আমার ট্রানজিশন ফিল্ম মনে করি। আদিম কিংবা হাজতের আমি আর বর্তমানের আমির মধ্যে বিস্তর ফারাক!
সকাল থেকে ইলেকট্রিসিটি ছিল না, ল্যাপটপের চার্জ শেষ হতেই আমি গ্রামের পথ ধরে হাঁটা শুরু করি। দুইটা বককে পাশাপাশি দেখি, বিলের পানি অনেকটা শুকিয়ে গেছে, আর কদিন বাদে ধানক্ষেতের আইল ধরে হাঁটবো, আমার ধানক্ষেতের আইল ধরে হাঁটতে ইচ্ছে করে। একটু পর খেয়াল করি দুইটা না, চারটা বক। অনেকটা সময় তাঁদের দিকে আমি তাকিয়ে থাকি কিন্তু কেউই একটা মাছও শিকার করতে পারে না। আমি গুঁইসাপকেও কোনোদিন শিকার করতে দেখিনি, ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁরা একরকম দাঁড়িয়ে থাকে। একদিন হঠাৎ একটা গুঁইসাপ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর আচানক দৌড় দেয় কিন্তু শিকারে ব্যর্থ হয়, এরপর তাঁর ধৈর্য আর কুলায় না, তাকে আমি পাশের বসত বাড়ির দিকে এগুতে দেখি, কিছুদূর এগুনোর পর একজন মহিলা গুইসাপটাকে দৌড়ানি দেয়, গুইসাপটা দৌড়াতে থাকে।
লেখক : চলচ্চিত্র নির্মাতা
এমএইচএস