Logo
Logo

মতামত

কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা

Icon

হাসনাত কাদীর

প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১:৫৯

কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন তুঙ্গে। পথে নেমেছে হাজার হাজার তরুণ-তরুণী। গত কয়েকদিনের আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আজ বৃহস্পতিবার সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে তারা। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সকাল থেকে দফায় দফায় পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ চলেছে। পুরো ঢাকায় সৃষ্টি হয়েছে অচলাবস্থা। বিকেল ৫টা পর্যন্ত রাজধানীতে ছয়জন ও মাদারীপুরে একজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কয়েকশ। আহতদের মধ্যে পুলিশ সদস্যও রয়েছেন। সারাদেশে ছড়িয়ে পড়া এই বিক্ষোভে গত মঙ্গলবার আরও ছয়জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছিল। ফলে প্রাণহানির সংখ্যা ১১ জন ছাড়িয়ে গেছে।

কোটা সংস্কারের এই দাবি যৌক্তিক ও সময়োপযোগী। একটি দেশের সরকারি চাকরির ৫৬ শতাংশ কোটায় হবে, এমন নজির পৃথিবীর কোথাও নেই। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে, একটি মেধাভিত্তিক সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নের পথে এই বিপুল সংখ্যক কোটা রীতিমতো গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে। বেকারত্বের মহাসমুদ্রে পরিণত হওয়া এই রাষ্ট্রের রাজপথে তাই তরুণেরা নেমে এসেছেন। দুহাত প্রসারিত করে বুলেটের মুখে বুক পেতে কোটার নামে বৈষম্য দূর করতে চিৎকার করেছেন। সরকার দূরদর্শিতার পরিচয় দিত- যদি শুরুতেই যৌক্তিক সমাধানের জন্য তাদেরকে আলোচনার টেবিলে ডাকত। সেটি না করে বরং ক্ষমতাসীন দলের দায়িত্বশীল নেতৃত্ব বললেন, ‘ছাত্রলীগ প্রস্তুত আছে।’ তারা ভুলে গেলেন জোরজবরদস্তি করে একটি যৌক্তিক আন্দোলন দমন করা যায় না। তারা সময়ের দাবিকে অগ্রাহ্য করে হাঁটলেন ‘ভয় দেখিয়ে জয় পাওয়ার’ ভুলভাল থিয়োরিতে। 

ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায় বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। প্রশ্ন উঠেছে, ‘শাসন করার দায়িত্ব’ ছাত্রলীগের হাতে কে দিয়েছে? এই পাশবিকতার প্রতিবাদে সারাদেশের সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগকে ‘বয়কট’ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দিতে শুরু করে। এমনকি খোদ ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মীও লজ্জায় পদত্যাগ করেন এই সংগঠন থেকে। রক্তক্ষয়ী মঙ্গলবারের পরে গতকাল বুধবারও (আশুরার ছুটির দিন) সারাদেশে ছাত্র বিক্ষোভ, সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ, গায়েবানা জানাজা, কফিন মিছিল ও দফায় দফায় সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। প্রধানমন্ত্রী বার্তা দিলেন। তবে তিনি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এড়াতে যৌক্তিক ও সময়োপযোগী কোনো সিদ্ধান্ত দিলেন না। ‘শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পুলিশ-বিজিবি-র‍্যাব ও সোয়াটের ন্যক্কারজনক হামলা, খুনের প্রতিবাদ, খুনিদের বিচার, সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাস নিশ্চিত করা ও কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে’ বৃহস্পতিবার কমপ্লিট শাটডাউন (সর্বাত্মক অবরোধ) ঘোষণা করেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। 

দেরিতে হলেও অবশেষে ইট-পাটকেল, টিয়ারশেল, কাঁদানে গ্যাস, আগুন আর সাউন্ড গ্রেনেডের প্রকম্পিত শব্দের মধ্যেই আজ আইনমন্ত্রী আনিসুল হক আন্দোলন প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘পিতৃতুল্য হিসেবে আমি অনুরোধ করছি, আহ্বান জানাচ্ছি আপনারা আন্দোলন থেকে সরে আসেন। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আমরা (সরকার) কোটা সংস্কারের ব্যাপারে নীতিগতভাবে একমত।’

কোটা সংস্কার সংক্রান্ত মামলার শুনানি এগিয়ে আনতে অ্যাটর্নি জেনারেলকে আগামী রোববার আদালতে আপিল করতে বলেছেন আইনমন্ত্রী। কোটা আন্দোলন চলাকালে সংঘর্ষের ঘটনায় মৃত্যু ঘিরে হাইকোর্টের বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামানকে দিয়ে বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলেও তিনি জানান। 

তবে সরকারের আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেছেন, ‘আলোচনা আর গোলাগুলি একসঙ্গে হয় না। লাশের ওপর দিয়ে আলোচনায় যাওয়া যায় না (সূত্র: সমকাল)।’

বিশিষ্টজনেরা বলছেন, চাকরিপ্রত্যাশীরা কোটা সংস্কার চান, সরকারও সংস্কার চাইছে। আলোচনার মাধ্যমেই যৌক্তিক সমাধানের পথে হাঁটতে হবে। আলোচনার পথ খোলা রাখাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। সেই পথ এড়িয়ে যাওয়া ছাত্রসমাজের জন্য সুবিবেচনা প্রসূত নয়। 

যত দ্রুত একটা যৌক্তিক সংস্কারে একমত হওয়া যাবে ততই হানাহানি, রক্তপাত, মূল্যবান প্রাণহানির আশঙ্কা কমবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় তত দ্রুত একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার পথে এগোনো যাবে। তবে কোটা সংস্কার একটি শুরু মাত্র। আমাদের এও ভাবতে হবে, সরকারি চাকরির মাত্র তিন হাজার পদের জন্য চার লাখ প্রার্থী কেন জীবনবাজি রাখে? কেন সাধারণজন তাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে ওঠে? বুঝতে হবে, আবু সাঈদরা যখন দুহাত প্রসারিত করে বুলেটের মুখে বুক পেতে জীবন দেয়, তখন সেটি মামুলি এক মনুষ্যবুক নয়। সেটি এক জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি। প্রশ্ন করতে হবে, কথায় কথায় রাজাকার ট্যাগ কেন? এই ট্যাগের রাজনীতি কিছুতেই কাম্য হতে পারে না। স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ যেন অন্যায্য কাজে ঢাল হিসেবে ব্যবহার না হয়, নজর রাখতে হবে সেদিকে। মনে রাখতে হবে, নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়? নগরে যেন আগুন না লাগে সেটি নিশ্চিত করতে হবে কর্তৃপক্ষকেই। তা না করে ছাইচাপা আগুনে হাওয়া দিলে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা দলের জন্য তা অশনিই হয় বটে। 

বৈষম্য দূর করতে যে দেশের তরুণেরা কণ্ঠ তুলতে কুণ্ঠাবোধ করে না, সেই দেশ নিয়ে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আপাদমস্তক দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়নের এই রাষ্ট্র সংস্কার করতে তারা যেকোনো সময় জ্বলে উঠতে পারে। আর সেই সময়টি হবে বাংলাদেশের একটি নতুন যুগের সূচনা। শুধু খেয়াল রাখতে হবে এই মেধাবী ও প্রতিবাদী তারুণ্যের ঘাড়ে বন্দুক রেখে কোনো অশুভ শক্তি যেন ফায়দা না লুটে। 

হাসনাত কাদীর : প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ; বাংলাদেশের খবর

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর