সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের শাসনের পতন মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তার শাসনের সমাপ্তি কেবল একটি রাজনৈতিক ঘটনাই নয়; বরং এটি নেতাদের জন্য মূল্যবান শিক্ষার দিকনির্দেশনা। আসুন বিশদে এই শিক্ষাগুলোকে ব্যাখ্যা করা যাক, যা ভবিষ্যতের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
১. নৈতিক নেতৃত্বের গুরুত্ব
একটি রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব নির্ভর করে তার নেতার প্রতি জনগণের এবং সেনাবাহিনীর বিশ্বাসের ওপর। আসাদ তার সৈন্য ও জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলেন, কারণ তার লড়াই ছিল ক্ষমতার জন্য, জনগণের জন্য নয়। একজন নেতার নৈতিক নেতৃত্ব ব্যতীত কোনো শক্তিই স্থায়ী হতে পারে না।
২. দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ বড় শক্তির সাথে টিকতে পারে না
যে দেশে কর্মকর্তাদের মূল্যায়ন হয় তাদের আনুগত্যের ভিত্তিতে, সে দেশ কখনোই যুক্তরাষ্ট্রের মতো সুসংগঠিত শক্তির মোকাবিলা করতে পারবে না। আসাদের শাসনের সময় দুর্নীতি ছিল সর্বব্যাপী, যা তার শাসনের ভিত দুর্বল করে তোলে।
৩. আঞ্চলিক প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করা অপরিহার্য
আসাদের সেই বিখ্যাত বক্তৃতা—যেখানে তিনি উপসাগরীয় দেশগুলোর নেতাদের ‘অর্ধাঙ্গিনী মানুষ’ বলে অপমান করেছিলেন—তার শাসনের প্রতি আরব দেশগুলোর বিরাগ সৃষ্টি করেছিল। ইরানের প্রতি অতিরিক্ত পক্ষপাতিত্ব এবং আরব দেশগুলোর অসন্তুষ্টি তার শাসনের পতনকে তরান্বিত করে।
৪. একাধিক শক্তির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হওয়া বিপজ্জনক
আসাদ যখন ইরান ও রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল হন, তখন তিনি নিজের সার্বভৌমত্ব হারিয়ে ফেলেন। একাধিক শক্তির সমর্থন পেতে গিয়ে তিনি নিজেই কৌশলের শিকার হন এবং তার ভবিষ্যৎ নির্ধারণের ক্ষমতা হাতছাড়া করেন।
৫. মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখুন
আসাদ কেবল আঞ্চলিক প্রতিবেশীদেরই নয়, তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র রাশিয়াকেও অসন্তুষ্ট করেন। রাশিয়ার সামান্য সংস্কারের পরামর্শ এবং তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের আহ্বান তিনি উপেক্ষা করেন। এটি তার জন্য বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হয়।
৬. সেনাবাহিনী ও দমনমূলক যন্ত্র দীর্ঘস্থায়ী রক্ষাকবচ নয়
সেনাবাহিনী বা দমনমূলক নিরাপত্তা যন্ত্র দীর্ঘমেয়াদে কোনো শাসককে রক্ষা করতে পারে না। আসাদ যেমন তার শাসনের পতন ঠেকাতে ব্যর্থ হন, তেমনি ইতিহাসে সাদ্দাম হোসেন ও মুয়াম্মার গাদ্দাফির শাসনের পতনেও দেখা গেছে যে কেবল জনগণের আস্থা ও সন্তুষ্টিই টিকে থাকার মূল চাবিকাঠি।
৭. সময়ের সুযোগ গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
আরব দেশগুলো ও তুরস্ক বারবার আসাদকে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য সাহায্যের প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু তিনি সেগুলো প্রত্যাখ্যান করেন। প্রতিটি সুযোগই তার জন্য সম্ভাব্য সমাধান হতে পারত, যা তিনি একগুঁয়েভাবে নষ্ট করেন।
৮. সংখ্যালঘু-সংখ্যাগরিষ্ঠ বিভ্রান্তি থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন
আসাদের শাসন সংখ্যালঘুদের মনে একটি ভীতি তৈরি করেছিল যে সংখ্যাগরিষ্ঠ শাসনের ক্ষেত্রে তারা সুরক্ষিত থাকবে না। কিন্তু তার পতনের পর দেখা গেছে এই আশঙ্কা ভিত্তিহীন ছিল।
৯. দেশের অভ্যন্তরীণ শক্তিতে বিনিয়োগ করুন
ইরান ও অন্যান্য বিদেশি শক্তির প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা আসাদের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ। নিজস্ব শক্তিতে বিনিয়োগ ও দ্বন্দ্ব এড়িয়ে চলা একটি দেশের দীর্ঘমেয়াদী সাফল্যের জন্য অপরিহার্য।
১০. ইসরায়েল ও আন্তর্জাতিক শক্তির প্রতি সতর্ক থাকুন
আসাদের পতনের পর ইসরায়েল তার ভূমি দখল বাড়িয়েছে এবং অঞ্চলটি নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ইসরায়েলের কৌশল সম্পর্কে সতর্ক থাকা এবং অভ্যন্তরীণভাবে শক্তিশালী হওয়া প্রতিটি দেশের জন্য শিক্ষা।
বাশার আল আসাদের শাসনের পতন আমাদের অঞ্চলের জন্য একটি শক্তিশালী শিক্ষা। তার শাসনের ভুল এবং কৌশলগত ব্যর্থতা মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি দেশের জন্য একটি অনুস্মারক যে- নেতৃত্ব, নৈতিকতা ও সঠিক কৌশল ছাড়া, ক্ষমতা অস্থায়ী। আসাদের পতন মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পরিবেশে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন, যা আমাদের সবাইকে ভবিষ্যতের জন্য সচেতন হতে শেখায়।
বিএইচ/