সিরিয়ার দীর্ঘ বিপ্লব : গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা ও আঞ্চলিক সংকট
মুহাম্মাদ শোয়াইব
প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮:৩৯
ছবি : সংগৃহীত
১৪ বছরের অবিরাম সংগ্রাম ও পাঁচ দশকের নিপীড়নময় শাসনের বিরুদ্ধে সিরিয়ার জনগণের অটল লড়াই শেষে, অবশেষে তারা স্বৈরশাসক বাশার আল আসাদের শাসনের অধ্যায় উল্টাতে সক্ষম হয়েছে। এই লড়াই তাদের গণতন্ত্র, রাজনৈতিক বহুত্ববাদ এবং আইন ও প্রতিষ্ঠানের শাসনের ভিত্তিতে একটি আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের দৃঢ় আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ। যদিও স্বৈরতন্ত্রের অবসান সিরিয়ার জন্য একটি বড় অর্জন, নতুন সিরিয়া গঠনের পথ রক্ত, ঘাম ও ত্যাগের দীর্ঘ কাহিনী।
সিরিয়ার সংঘাতের মাত্রা শুধু শাসক ও জনগণের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এটি একটি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংঘাতে রূপ নিয়েছিল। সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ রূপান্তর মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিশাল পরিবর্তন এনে দিয়েছে, যার প্রভাব এই অঞ্চলের সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। নতুন সিরিয়ার জন্য এই বিপ্লব যেমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচনা, তেমনি অতীতের ক্ষত নিরাময়ে একতার প্রয়োজন অপরিহার্য।
সিরিয়া গত এক দশক ধরে বিভিন্ন রাষ্ট্রের উচ্চাকাঙ্ক্ষার সংঘর্ষের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। বহিরাগত শক্তিগুলোর কৌশল ও নীতির দ্বন্দ্ব শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ সংঘাতকেই গভীরতর করেনি; বরং এটি আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক সম্পর্ককেও নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে।
সিরিয়ার সংঘাতে বাশার আল আসাদের সরকারকে সমর্থন দিতে রাশিয়া ও ইরানের সক্রিয় অংশগ্রহণ তাদের মধ্যে কৌশলগত অংশীদারিত্বকে এক নতুন মাত্রায় উন্নীত করেছে। এই জোট মধ্যপ্রাচ্যে শক্তি সমীকরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অক্ষ হিসেবে কাজ করেছে। এর প্রভাব শুধু সিরিয়ার রাজনৈতিক ভবিষ্যতেই নয়; বরং অঞ্চলটির নিরাপত্তা কাঠামোকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।
তুরস্কের ভূমিকা ছিল জটিল ও বহুস্তরীয়। একদিকে, সিরিয়ার উত্তরে প্রভাব বিস্তারের জন্য মস্কোর সঙ্গে তুরস্কের সহযোগিতা তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে, কুর্দি মিলিশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মতবিরোধ তাদের সম্পর্ককে আরও জটিল করেছে। তুরস্কের সামরিক অভিযান ও কৌশলগত স্বার্থ এই অঞ্চলে উত্তেজনার মাত্রা বাড়িয়েছে।
সিরিয়ার সংকট তুর্কি-আরব সম্পর্কেও গভীর ছাপ ফেলেছে। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আরব দেশগুলোর সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক পুনর্গঠনের চেষ্টা চলছে, তবে সংঘাতের প্রথম দিকের অবস্থান এই সম্পর্কগুলোতে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলেছে।
সিরিয়ার রূপান্তর তুরস্কের জন্য একদিকে কৌশলগত সুযোগ তৈরি করেছে, অন্যদিকে এনেছে জটিল দায়িত্ব। সিরিয়ার পুনর্গঠনে তুরস্ককে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। বিশেষত, তুরস্কের উচিৎ এমন পরিস্থিতি তৈরি না করা যা সিরিয়ার রূপান্তরকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।
তুরস্ক বারবার হায়াত তাহরির আল শামের মতো চরমপন্থী গোষ্ঠীর সঙ্গে সংযোগের অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তবে সিরিয়ার উত্তরে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে তুরস্কের কৌশলগত যোগাযোগ অস্বীকার করা যায় না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিতে এটি প্রশ্ন তুলছে যে আঙ্কারা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য কতটা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
সিরিয়ার রূপান্তর আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তির সমীকরণেও গভীর প্রভাব ফেলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইল সিরিয়ার রূপান্তর থেকে কৌশলগত সুবিধা অর্জনের সম্ভাবনা দেখছে। ইরান এবং রাশিয়ার প্রভাবমুক্ত সিরিয়া পশ্চিমা জোটের জন্য বড় বিজয় হবে। তবে এটি ঝুঁকিমুক্ত নয়।
ইসরাইলের জন্য আসাদ শাসনের অধীনে স্থিতিশীল, তবে হুমকির উপযোগী প্রতিবেশী ছিল। রূপান্তরিত সিরিয়া নতুন জোট গড়ে তুললেও এর অনিশ্চয়তা ইসরাইলের জন্য উদ্বেগ বাড়াতে পারে। সিরিয়ার রূপান্তর আরব বিশ্বের জন্য মিশ্র প্রতিক্রিয়া এনেছে। এটি নতুন মিত্রতা গড়ার সুযোগ তৈরি করলেও আঞ্চলিক ভারসাম্য পরিবর্তনের ঝুঁকি রয়েছে। লাভ-ক্ষতির মাপকাঠি এখনো পুরোপুরি পরিষ্কার নয়।
সিরিয়ার বিপ্লব শুধু দেশটির ভবিষ্যৎ নয়; বরং মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক দৃশ্যপটকেও প্রভাবিত করেছে। তুরস্ক, ইরান, এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা এই প্রক্রিয়ার দিক নির্ধারণ করবে। নতুন অধ্যায় রচনা করতে হলে একতা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি অপরিহার্য। এই বিপ্লব, যদিও দেশীয় আকাঙ্ক্ষা থেকে জন্ম নিয়েছে, তা আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক শক্তির পুনর্গঠনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।
লেখক : মিডিয়া রিসার্চার, এমিরেটস সেন্টার ফর স্ট্র্যাটিজিক স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ (ইসিএসএসআর), সংযুক্ত আরব আমিরাত
মেইল : [email protected]