আলোচিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায় বিচারিক আদালতে আইনের ভিত্তিতে বিচার (ট্রায়াল) কার্যক্রম পরিচালিত হয়নি বলে তা অবৈধ ঘোষণা করে সম্প্রতি পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়েছে।
নিম্ন আদালতে দীর্ঘ দশবছর ধরে চলা বিচার প্রক্রিয়া কি তাহলে প্রহসন ছিল? সমগ্র দেশবাসীর সাথে তামাশা করা হয়েছে। বিচারের নামে পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডে পুরাতন জেলখানার পাশে বিশেষ এজলাসে বসে অবিচার করা হয়েছে।
রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে নিরপরাধ ব্যক্তিদের সাথে যে অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছে, কারাগারের অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া জীবনের ষোলো বছর কে ফিরিয়ে দেবে? মিথ্যে অভিযোগ আরোপ করে দিনের পর দিন যে অন্যায় করা হয়েছে তার দায় কে নেবে?
এমনই প্রশ্ন আজ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের। বিচার ব্যবস্থা ও বিচারকদের কর্মকাণ্ড যদি এমন হয় তাহলে দেশজাতির ভবিষ্যৎ কী তা নিয়ে জনমনে চলছে নানা প্রতিক্রিয়া ।
আলোচিত ওই মামলায় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে গত ১৯ ডিসেম্বর ৭৯ পৃষ্ঠার হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি প্রকাশিত হয়। আপিল বিভাগের বিচারকগণ মামলার বিচারের চুলচেরা পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে তাদের অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
বলা হয়েছে, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলাটি ন্যায়বিচার নিশ্চিতে যথাযথ ও বিশেষজ্ঞ সংস্থার মাধ্যমে নতুন করে তদন্তের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো উচিত। আইনের ভিত্তিতে বিচারিক আদালতে বিচার (ট্রায়াল) কার্যক্রম হয়নি মর্মে নিম্ন আদালতের ট্রায়ালকে অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট।
হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি প্রকাশিত হওয়ার পর খালাসপ্রাপ্ত আসামিদের পক্ষের অন্যতম আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, এ মামলায় সম্পূরক অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে বিচারিক আদালতের রায় অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট।
তিনি বলেন, ‘৪০০ বছরের ইতিহাসে এই উপমহাদেশে (সাবকন্টিনেন্টে) দ্বিতীয় স্বীকারোক্তির উপর ভিত্তি করে কাউকে সাজা দেয়া হয়েছে এমন কোনো নজির নেই।’
তিনি বলেন, এ মামলার আসামি মুফতি হান্নান দুবার স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। টর্চার করে তার কাছ থেকে দ্বিতীয়বার স্বীকারোক্তি আদায়ের অভিযোগ ছিল। দ্বিতীয় স্বীকারোক্তি প্রত্যাহার করেছিলেন তিনি। এ স্বীকারোক্তির কোনো আইনগত ভিত্তি নেই।
এমনকি বিচারিক আদালতে দেওয়া এক সাক্ষীর সঙ্গে অন্য সাক্ষীর সাক্ষ্যে কোন সামঞ্জস্যতা (কোলাবরেশান) নেই। এ ধরনের কেইসে ঘটনা পরস্পর দেখেছেন এমন কোন সাক্ষ্য নেই।"
এর আগে গত ১ ডিসেম্বর দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ঐতিহাসিক রায় দেন। সংক্ষিপ্তসারে দেওয়া ঐ রায়ে যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ সকলকে খালাস দেওয়া হয়।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় মতিঝিল থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দুটি মামলা হয়। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ-সংক্রান্ত মামলা দুটির (হত্যা ও বিস্ফোরক) নতুন করে তদন্ত শুরু করে। ২০০৮ সালে ২২ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। আওয়ামী লীগ সরকার আমলে মামলার অধিকতর তদন্ত হয়। এরপর তারেক রহমানসহ ৩০ জনকে আসামি করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয়া হয়।
২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক শাহেদ নুর উদ্দিন এই মামলার (হত্যা ও বিস্ফোরক মামলা) রায় দেন। রায়ে ২০০১-২০০৬ আমলের বিএনপি সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম ও আসামি শেখ আবদুস সালাম ২০২১ সালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, বিএনপির নেতা হারিছ চৌধুরী, কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসাইনসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন সাজা দেয়া হয়। এছাড়া বিভিন্ন মেয়াদে ১১ জনকে দণ্ড দেয় বিচারিক আদালত।
২০১৮ সালে বিচারিক আদালতের রায়সহ মামলা দুটির নথিপত্র হাইকোর্টে এসে পৌঁছায়। এটি ডেথ রেফারেন্স মামলা হিসেবে নথিভুক্ত হয়। কোনো ফৌজদারি মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ে কোনো আসামির মৃত্যুদণ্ড হলে তা কার্যকর করতে হাইকোর্টের অনুমোদন লাগে। পাশাপাশি দণ্ডাদেশের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের জেল আপিল, নিয়মিত আপিল ও বিবিধ আবেদন করার সুযোগ রয়েছে। সে অনুযায়ী আসামি পক্ষ আপিল করে।
সুপ্রিম কোর্টে আসামিদের ডেথ রেফারেন্স, আপিল, জেল আপিল ও বিবিধ আবেদনের ওপর শুনানি শেষে বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ গত ১ ডিসেম্বর রায়ের সংক্ষিপ্তসার দেন। পরে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়।
যদিও মামলায় বিএনপির শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে সম্পৃক্ত করা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে প্রথম থেকেই দাবি করে আসছিল দলটি।
সম্প্রতি আপিল বিভাগের ওই রায়ে চূড়ান্ত হয় যে বিচার প্রক্রিয়াই ছিল অবৈধ। সেক্ষেত্রে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের ঐ প্রহসনের বিচার প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত প্রতিটি ব্যক্তিকে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করা উচিত বলেই মনে করেন নাগরিক সমাজ।
এমএইচএস