দৃষ্টিপাত
শৈশবের গুরুত্ব ও শিক্ষার সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গি
প্রকাশ: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১:৪৬
শুরু হচ্ছে নতুন বছর। নতুন বছরে প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু হবে অনেক শিশুর। সারাদেশের বিদ্যালয়গুলোতে শিশুশ্রেণিতে ভর্তি হবে অসংখ্য শিশু। তাদের কলকাকলি আর হাসি-উল্লাসে প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে বিদ্যালয়গুলোর ক্লাসরুম আর প্রাঙ্গণ।
কিন্তু শিশুরা কী পড়তে চায়, তারা কী জানতে চায়, কীভাবে জানতে চায়, শিখতে চায়, পড়তে চায়--সে বিষয়ে আমাদের, মানে বড়দের মনোযোগ কতটুকু? অভিভাবকরা তো দেখছি তাদের ছেলেমেয়েদেরকে কেবল সব পরীক্ষায় ফার্স্ট দেখতে চান। সে জন্য প্রয়োজনে সন্তানের শৈশব-আনন্দকে ধ্বংস করতেও কোনো দ্বিধা নেই। এমনকি সাধ্যের চেয়ে অনেক বেশি টাকা খরচ করতেও রাজি। তবু প্রথমই হতে হবে। প্রথম না হতে পারলে যেন জীবনের কোনো মানেই নাই আর! যেন কেবল প্রথম হওয়ারাই একটা কিছু হতে পারে। আর অন্যরা সব হেরে গিয়ে ভূত হয়ে যায়। এই ‘কিছু হতে পারা’র ধারণাটিও তো আবার নির্দিষ্ট ছকেই আটকে থাকা ধারণা। শৈশবের প্রথম থেকেই তাই প্রথম হওয়ার ময়দানে ছুটতে নামিয়ে দেওয়া হয় শিশুকে। কিন্তু যে প্রতিযোগিতার দৌড়ে শিশুকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, শিশু তাতে কেমন বোধ করছে--সে বিষয়ে অভিভাবকদের মনোযোগ কতটুকু আছে?
প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হতেও পরীক্ষা দিতে হয় দেখেছি অনেক জায়গাতেই। সেই পরীক্ষা পাশের জন্য কোচিংয়ের পর কোচিং করানো হয় ছোট্ট শিশুটিকে। শিশুমনের যেমন যে চাওয়া থাকে--হাসি আনন্দ ছুটোছুটি খেলাধুলা, এসবের সময় কোথায় আজকালকার নাগরিক-শিশুদের। পরিবেশই বা আছে কতটুকু?
আমাদের শিক্ষা পদ্ধতিতে শিশুর ভালোলাগাকে মূল্যায়ন করার সুযোগ বা চর্চা আছে কতটুকু? কোনো শিশু যদি রুটিনের কোনো ক্লাস একদিন করতে না চায়, স্কুল কী সিদ্ধান্ত নেয় তার ক্ষেত্রে? কোনো শিশু যদি বলে, অমুক শিক্ষকের ক্লাস বা অমুক বিষয়ের ক্লাস আমার ভালো লাগছে না, আমি এ ক্লাসে বসতে চাই না, কী ঘটবে তখন? রাষ্ট্র শিশুর শিক্ষা নিয়ে কতটুকু সংবেদনশীলভাবে চিন্তা করে? বিদ্যালয়গুলোতে কেমন পরিবেশ নিশ্চিত করে? শিশুদের শিক্ষা দিচ্ছেন যে শিক্ষকেরা, তাদের শিশুবান্ধব মনোভাব কতটুকু? কত শতাংশ শিক্ষককে প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হয়? যাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, তারা শিশুর সাথে আচরণ বিষয়ে কতটা শেখানো হয়, আর কতটা পাঠ্যক্রমের ধারণা দেওয়া হয়?
বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিশুশিক্ষা নিয়ে অনেক গবেষণা হচ্ছে। জঁ পিয়াজে (Jean Piaget) এবং লেভ ভাইগটস্কি (Lev Vygotsky)-এর শিখন তত্ত্ব অনুসারে, শিশুরা একেকটি বয়সে বিভিন্নভাবে শেখে এবং তাদের শিখন প্রক্রিয়া বয়সভেদে পরিবর্তিত হয়। শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য শৈশবকাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। সুইস মনস্তত্ত্ববিদ জঁ পিয়াজে শিশুদের মানসিক বিকাশ নিয়ে কাজ করেছেন। তিনি শিশুর বিকাশকে চারটি ধাপে ভাগ করেছিলেন : সেন্সরি-মোটর, প্রিপোপোজিশনাল, কনক্রিট অপারেশনাল এবং ফরমাল অপারেশনাল। পিয়াজে বিশ্বাস করতেন যে শিশুরা তাদের পরিবেশ এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমে চিন্তা করার ক্ষমতা বিকশিত করে এবং এই বিকাশ একটি ক্রমাগত ও ধাপে ধাপে প্রক্রিয়া। আর রুশ মনস্তত্ত্ববিদ লেভ ভাইগটস্কি বিশ্বাস করতেন যে শিশুদের শিখন প্রক্রিয়া সমাজ ও সংস্কৃতির মাধ্যমে প্রভাবিত হয়। তার Zone of Proximal Development (ZPD) তত্ত্ব অনুযায়ী-- শিশুর বিকাশে শিক্ষক বা অভিভাবকের সহায়তা প্রয়োজন, যেন তারা নিজের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারে। তিনি ভাষাকে শিখনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হিসাবে দেখতেন।
WHO (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা) এর মতে, শৈশবেই শিশুর শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক বিকাশ সবচেয়ে বেশি হয়। তাই শিশুশিক্ষা কেবল পাঠ্যক্রমের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে শিশুর মানসিক বিকাশের ওপরও গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
আজকের দিনে শিশুশিক্ষা অনেক বেশি সৃজনশীল হতে পারে। মন্টেসরি (Montessori) পদ্ধতি, রেজিও এমিলিয়া (Reggio Emilia) পদ্ধতি এবং Project-based learning (PBL)-এর মতো পদ্ধতিগুলি শিশুদের মেধা বিকাশে বিশেষ ভূমিকা রাখে। উদাহরণস্বরূপ, মন্টেসরি পদ্ধতি শিশুদের তাদের আগ্রহ অনুসারে শেখার সুযোগ দেয় এবং তাদের চিন্তাভাবনাকে স্বাধীনভাবে বিকশিত করতে সহায়তা করে। শিশুদের অভ্যন্তরীণ আগ্রহের ওপর ভিত্তি করে তাদের শেখানোর এই পদ্ধতিগুলি শিশুর শিখন প্রক্রিয়াকে আরও কার্যকরী করে তোলে। যদি আমাদের বিদ্যালয়গুলিতে এই ধরনের পদ্ধতিগুলি প্রয়োগ করা হয়, তবে শিশুরা চাপ ছাড়াই তাদের শিক্ষা অর্জন করতে পারবে।
শিক্ষকরা কীভাবে শিশুদের সঙ্গে আচরণ করবেন, তাদের প্রতি কীভাবে সহানুভূতিশীল এবং শিশুবান্ধব মনোভাব নিয়ে কাজ করবেন, এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক দেশেই শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে শিশুদের শিখন পদ্ধতি, সামাজিক ও আবেগীয় বিকাশ এবং শিশুর মনস্তত্ত্ব বিষয়েও শিক্ষা দেওয়া হয়। তবে আমাদের দেশে এসব প্রশিক্ষণ খুবই সীমিত। যদি আমাদের শিক্ষকরা শিশুদের মনের অবস্থা এবং শিক্ষার চাহিদা সম্পর্কে ভালোভাবে জানেন, তবে তারা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আরও ভালো সম্পর্ক তৈরি করতে পারবেন।
শিশুর শৈশব যদি আনন্দহীন হয়, তবে তার ভবিষ্যত বিকাশও বাধাগ্রস্ত হবে নিশ্চিতভাবেই। মেধাবী হওয়া এবং ভালো ফলাফল অর্জন করা গুরুত্বপূর্ণ, তবে তা শিশুর শৈশবকে হারিয়ে ফেলে নয়। লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলা, নাচ, গান, অভিনয় এবং সৃজনশীল কর্মকাণ্ড শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে সহায়ক। UNICEF-এর এক গবেষণায় বলা হয়েছে যে, শিশুদের মেধাবিকাশে খেলাধুলা এবং সৃজনশীল কার্যকলাপের ভূমিকা অপরিসীম। এই ধরনের কার্যক্রম তাদের মস্তিষ্কের বিকাশে সহায়তা করে এবং সৃজনশীল চিন্তাভাবনা ও সামাজিক দক্ষতাকে উন্নত করে।
রাষ্ট্রের উচিত একটি গবেষণালব্ধ পরিকল্পনার মাধ্যমে শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করা, যা শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশে সহায়ক হবে। শিশুর শখ, আগ্রহ এবং সক্ষমতার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তাদের শিক্ষায় মনোযোগী হওয়া উচিত। পরীক্ষার চাপ, প্রতিযোগিতা এবং প্রথম হওয়ার দৌড়ে শিশুকে ঠেলে দেওয়া হলে শিশুর যথাযথ বিকাশ সম্ভব নয়। আমাদের প্রয়োজন একটি শিশুবান্ধব শিক্ষা ব্যবস্থা, যেখানে শিশুদের সব ধরনের বিকাশের জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি হবে।
এতসব কথার মাধ্যমে বলতে চাই যে, শিশুর জন্য শৈশব সবচেয়ে দামি। পড়াশোনা তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও কোনো কিছুর বিনিময়েই শৈশবকে নিরানন্দ করো তোলা উচিত না। বরং আমাদের বুঝতে হবে যে, কেবল পরীক্ষার ফলাফল বা শ্রেণিশিক্ষার মধ্যে মেধার বিকাশ বা সফলতা সীমাবদ্ধ নয়। একটি আনন্দমুখর, সৃজনশীল এবং শিশুবান্ধব শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করার মাধ্যমে শিশুর বিকাশের জন্য একটি সফল পরিকল্পনা করা করা সম্ভব। স্কুলগুলো হয়ে উঠতে হবে শিশুর আনন্দ আশ্রম, যেখানে শেখা ও বেড়ে ওঠা হবে পরিপূরক। আমাদের সবার উচিত, শিশুর শিখন প্রক্রিয়ায় সহানুভূতির সঙ্গে মনোযোগ দেওয়া, যাতে শিশুরা পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হতে পারে।
মেহেদী হাসান শোয়েব : লেখক, প্রকাশক, বিতার্কিক; শিফট ইনচার্জ, বাংলাদেশের খবর
এমএইচএস