দৃষ্টিপাত
আতশবাজি-পটকা-ফানুস : নিষেধাজ্ঞা ও বাস্তবতা
প্রকাশ: ০১ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭:০৯
বাংলাদেশে থার্টি ফার্স্ট নাইট, বড়দিন, এবং অন্যান্য উৎসব উপলক্ষে আতশবাজি ও ফানুস ওড়ানো যেন বছর বছর বেড়েই চলেছে। এসব কার্যক্রমে কিছু মানুষ আনন্দ পেলেও জননিরাপত্তা, অগ্নিকাণ্ড এবং পরিবেশ দূষণের মতো গুরুতর ঝুঁকি তৈরি হয়। প্রশাসন প্রতি বছর বিভিন্ন দিবসের আগে আতশবাজি, ফানুস ইত্যাদি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে নির্দেশনা দিলেও বাস্তবে এসব নির্দেশনার কোনো প্রয়োগ দেখা যায় না। ফলে আতশবাজি ও ফানুস ব্যবহারের প্রবণতা দিনে দিনে বাড়ছে। গতরাতে আক্ষরিক অর্থেই বাজির শব্দে ঢাকাশহর যেন কাঁপছিল। অসংখ্য অসুস্থ, বৃদ্ধ, শিশুর জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠেছিল এই শব্দ। এমনকি সাধারণ মানুষেরাও মধ্যরাত পর্যন্ত ঘুমাতে পারেননি। পাখি ও অন্যান্য প্রাণিদের কথা কেবা ভাবে আর!
যদিও এসব নিয়ন্ত্রণে অতিরিক্ত পুলিশ এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের ম্যাজিস্ট্রেট মাঠে থাকবে বলা হলেও প্রকাশ্যেই বাজি পুড়ানো-ফোটানো হয়েছে। নিয়ন্ত্রণ করা হয়নি বা করা যায়নি কিছুই। সাথে ছিল বিকট শব্দে গান-বাজনা। গতরাতে মিরপুর-এগারোতে আতশবাজি থেকে আগুন লাগার ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দেখেছি। এর আগে বাজির শব্দে শিশুমৃত্যুর মতো ঘটনাও ঘটেছে। তবু বোধোদয় হয়নি আমাদের!
বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উৎসবে আতশবাজি ও ফানুসের ব্যবহার সম্ভত অনেক আগে থেকেই ছিল। বৌদ্ধ, হিন্দু ও মুসলিম সংস্কৃতির বিভিন্ন উৎসবে আলোকসজ্জা এবং ফানুস ওড়ানোর চল বেশ প্রাচীন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে থার্টি ফার্স্ট নাইট এবং ইংরেজি নববর্ষসহ বিভিন্ন দিবস উদযাপনে এর প্রচলন বেড়েছে মাত্রাতিরিক্ত বেড়েছে। যদিও বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী আতশবাজি ও পটকা ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত হওয়ার কথা ছিল।
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) প্রতি বছর থার্টি ফার্স্ট নাইট এবং ইংরেজি নববর্ষ উপলক্ষে আতশবাজি ও পটকা ফোটানো এবং ফানুস ওড়ানো নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এবছরও ডিএমপির কমিশনার জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং দুর্ঘটনা এড়াতে এই নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা দিয়েছিলেন।। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ২০২৪ সালের থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপন উপলক্ষে ঢাকা মহানগর এলাকায় এই ধরনের কার্যকলাপ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। (সূত্র: প্রথম আলো, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪) অথচ বাস্তবতা কী দেখলাম আমরা? এই বাস্তবতা কি ডিএমপি দেখতে পায়নি? কী ব্যবস্থা নিয়েছে তারা?
আতশবাজি ও ফানুস ওড়ানো বন্ধে ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতেরও নির্দেশনা রয়েছে। থার্টি ফার্স্ট নাইটে যেকোনো ভবনের ছাদ, উন্মুক্ত স্থান বা পার্কে এসব কার্যক্রম বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। আদালত মনে করেন, এ ধরনের কার্যকলাপ থেকে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড বা দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকে।
পুলিশের মহাপরিদর্শক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের এ আদেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে।
দেশে ফানুস ও আতশবাজি ব্যবহার নিষিদ্ধ করার বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা নিয়েও প্রশ্ন তুলে ব্যাখ্যা চেয়েছেন উচ্চ আদালত। (সূত্র : বাংলাদেশের খবর, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪)
কিন্তু কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা আদৌ কি মিলবে? আদালতের নির্দেশনা কেউ মেনেছেন? সাধারণ মানুষের কথা না হয় বাদই দিলাম, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কি এই নির্দেশ মানার জন্য সামান্যতম চেষ্টা করেছেন? গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেখা যাচ্ছে, মুদি দোকান থেকে শুরু করে মহল্লার মোড়ে মোড়ে তরুণ-কিশোরেরা টেবিল নিয়ে বা মাদুর বিছিয়ে প্রকাশ্যেই বাজি-পটকার অস্থায়ী দোকান নিয়ে বসেছিল। প্রতিবছরই বসে। কিন্তু এসব প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয় না।
ফানুস, আতশবাজি এবং পটকার বেআইনি ব্যবহারে কারণে কেবল প্রাণি মারা যায় বা আহত হয় না, পরিবেশেরও ক্ষতি হয়। এ ধরনের কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে দেশে আইন থাকলেও সেগুলোর যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না।
১.
আর্মস অ্যাক্ট, ১৮৭৮ (Arms Act, 1878)
এই
আইনের অধীনে বিস্ফোরক ও আগ্নেয়াস্ত্রজাত দ্রব্যের উৎপাদন,
বেচাকেনা, এবং ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আতশবাজি ও পটকা বিস্ফোরকের
অন্তর্ভুক্ত, তাই এর উৎপাদন ও
বিক্রির জন্য লাইসেন্স থাকা বাধ্যতামূলক।
২.
বিস্ফোরক পদার্থ আইন, ১৯০৮ (Explosives Act,
1908)
এই
আইনের আওতায় বিস্ফোরক পদার্থের সুরক্ষা, মজুদ, এবং পরিবহন নিয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আতশবাজি মজুদ ও বিক্রির ক্ষেত্রে
এই আইন প্রযোজ্য।
৩.
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (Bangladesh
Environment Conservation Act, 1995)
এই
আইনের আওতায় পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী কার্যক্রমগুলো নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আতশবাজি থেকে বায়ু ও শব্দদূষণ হয়
নিশ্চিতভাবেই। তাই এ ক্ষেত্রে এ
আইন প্রযোজ্য।
৪.
শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬
আতশবাজি
ও পটকা ফোটানোর কারণে শব্দদূষণ ও বায়ুদূষণ হয়।
এই আইন অনুযায়ী এসব কার্যক্রম দণ্ডনীয় অপরাধ। প্রথমবার আইন লঙ্ঘনে ১ মাসের জেল
বা ৫ হাজার টাকা
জরিমানা বা উভয় দণ্ড
হতে পারে। পুনরায় অপরাধ করলে ৬ মাসের জেল
বা ১০ হাজার টাকা
জরিমানা বা উভয় দণ্ড
হতে পারে।
৫.
জননিরাপত্তা আইন ও প্রশাসনিক নির্দেশনা
পুলিশ
প্রশাসন এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বিশেষ উৎসবের সময় আতশবাজি বেচা-কেনা ও ব্যবহারের ওপর
নিষেধাজ্ঞা জারি করে থাকে। ঢাকা মহানগর পুলিশের বিশেষ নির্দেশনা এই ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক।
৬.
লাইসেন্সের প্রয়োজনীয়তা
আতশবাজি
বিক্রির জন্য সরকার কর্তৃক লাইসেন্স গ্রহণ বাধ্যতামূলক। লাইসেন্স ছাড়া আতশবাজি তৈরি, আমদানি বা বিক্রি করলে
আইন অনুযায়ী শাস্তি হতে পারে।
৭.
দণ্ডবিধি, ১৮৬০ (Penal Code, 1860)
যদি
আতশবাজি ব্যবহারের ফলে কারও জীবন, সম্পদ বা পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত
হয়, তবে দণ্ডবিধি অনুযায়ী অপরাধীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
বাস্তবচিত্র
এসব
আইন বিধানে থাকলেও তার প্রয়োগ নাই বললেই চলে। প্রতিবছর থার্টি ফার্স্ট নাইট এবং অন্যান্য বড় উৎসবের আগে প্রশাসন আতশবাজি-পটকা ও ফানুস নিষিদ্ধ
ঘোষণা করে। এসব নির্দেশনা অনুযায়ী, আতশবাজি বেচা, কেনা এবং ওড়ানো বা ফোটানো নিষেধাজ্ঞা
দেওয়া হয়। তবে বাস্তবে দেখা যায়, ভিন্নচিত্র—হাজারো মানুষ প্রকাশ্যে এসব কার্যকলাপ চালিয়ে যান বিনা বাধায়।
প্রশাসনের কার্যকর তদারকির অভাব এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর ঢিলেঢালা ভূমিকার কারণে এই নিষেধাজ্ঞাগুলো কার্যকর হয় না। স্থানীয় বাজারে প্রকাশ্যেই আতশবাজি ও ফানুস কেনাবেচা চলে। সাধারণ মানুষের সহজেই সংগ্রহ করতে পারে এবং প্রকাশ্যেই পোড়ায়, ওড়ায়, ফোটায়। কালেভদ্রে কিছু অভিযান ছাড়া প্রশাসন এ বিষয়ে শুধু মুখেই বড় কথা বলে। বাস্তবায়নে তেমন কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না তাদেরকে।
কিন্তু এসব নির্দেশনা ও আইন প্রয়োগের উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায় খুব সামান্যই। ফলে কেউ আর নিষেধাজ্ঞা মানা জরুরি বলেই মনে করে না। বিধি নিষেধের কড়াকড়ির ডামাডোলে ঢাকাজুড়ে অসংখ্য আতশবাজি পুড়ল, পটকার শব্দে প্রকম্পিত হল রাজধানী। অন্যান্য বছরের মতো এবারও পটকা-আতশবাজি আর ফানুস ওড়ানো বিষয়ে সব নিষেধাজ্ঞা কেবল ফাঁকা বুলি বলে প্রমাণিত হয়েছে।
আতশবাজি ও ফানুস থেকে আগুন লেগে যাওয়ার ঘটনা বারবারই ঘটে থাকে। ২০২৩ সালে ঢাকায় ফানুস থেকে ভবনে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছিল। গত রাতেও ঢাকায় একাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের কন্ট্রোল রুমের সূত্রে জানা গেছে, উড়ন্ত অবস্থায় একটি ফানুস থেকে ধানমন্ডি চার নম্বর রোডের একটি সুপারশপে আগুন লেগে যায়। মিরপুর-১১ তে গত রাতেও আগুন লেগে যাওয়ার খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানা গেছে। ডিসেম্বর-জানুয়ারির শুষ্ক মৌসুমে স্বাভাবিকভাবেই আগুন লাগার ঘটনা বেশি ঘটে। শীতের বাতাসে বাজি বা ফানুস থেকে লাগা আগুন ছড়িয়ে পড়ে বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা তাই থাকেই। গত রাতে আতশবাজি ও ফানুসের আগুনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ৩ শিশুসহ ৫ জন দগ্ধ হয়েছেন।
বাংলাদেশে যতই বলা হোক যে, জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে—এসব কথা কেবল কথার কথাই থেকে যাবে। এখানে প্রয়োজন শক্তভাবে আইনের প্রয়োগ। তাহলেই আতশবাজি-পটকা আর ফানুসের ভয়াল আতঙ্ক থেকে মুক্তি পেতে পারে মানুষ।
মেহেদী হাসান শোয়েব : লেখক, প্রকাশক, বিতার্কিক; শিফট ইনচার্জ, বাংলাদেশের খবর
এমএইচএস