দৃষ্টিপাত
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতির সংস্কার কতদূর?
প্রকাশ: ০৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭:০৬
বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতার পালাবদলের বিষয় সামনে এলে ‘সংস্কার’ নিয়ে আলোচনাও সামনে আসে। গত ৫ আগস্ট ২০২৪ আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই আবারও সংস্কার নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। সংবিধান, বিচারব্যবস্থাসহ নানাকিছু সংস্কারে সরকার পদক্ষেপও নিয়েছে এবং গঠন করেছে বেশ কিছু কমিশন। তবে এসবের বাস্তবায়ন এবং সত্যিকারে সুফল পেতে হলে সবচেয়ে জরুরি যে সংস্কার—সেদিকে কার কতটুকু মনোযোগ আছে, সে প্রশ্ন রয়েই যায়। গণতন্ত্রের যে লক্ষ্য—মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে মানবিক রাষ্ট্র হয়ে ওঠা, তার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বোধকরি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সংস্কার করা। প্রশ্ন হলো—বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সংস্কার কতটুকু এগিয়েছে? বিশেষ করে ক্ষমতার পালাবদলকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আদর্শ ও নীতি-ভিত্তিক লড়াইয়ের বদলে টাকা এবং পেশী শক্তির মহড়া তো এখনও দৃশ্যমান।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে যা চলে, তাকে রাজনীতি না বলে বরং ‘ক্ষমতানীতি’ বলা যেতে পারে। যে দলের হাতে ক্ষমতা থাকে, তারা ক্ষমতাকে স্থায়ী করতে সম্ভাব্য সকল কৌশল অবলম্বন করে। অন্যদিকে, যারা ক্ষমতার বাইরে থাকে, তারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। ফলে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি একটি ক্ষমতার লড়াইয়ের মঞ্চে পরিণত হয়েছে—যেখানে আদর্শ, রাজনৈতিক দর্শন, সামাজিক দায়বদ্ধতা ইত্যাদির কোনো অস্তিত্ব অবশিষ্ট নেই।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অন্যতম সংকট হলো, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যের অভাব। তাদের মধ্যে রাজনৈতিক আদর্শের দুর্বলতা যথেষ্ট স্পষ্ট। এ অবস্থা উত্তরণের জন্য রাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্নয়ন অপরিহার্য। সেজন্য হয়তো সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা সহ সরকারি নানা কিছুই সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে এসব সংস্কারের জন্য গৃহীত পদক্ষেপগুলো কতখানি আশার আলো দেখাতে পারছে, তা নিয়ে সন্দিহান হওয়ার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জাতির বৃহত্তর কল্যাণে কাজ করতে আগ্রহী—এমন রাজনৈতিক আচরণ এখনও দেখা যাচ্ছে না বলেই মনে হচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি বড় সমস্যা হলো, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ক্ষমতার পালাবদল স্বাভাবিক উপায়ে হয়নি। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় একাধিক শাসককে হত্যা করা হয়েছে, কিছু শাসক স্বৈরাচারি হয়ে ওঠায় গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাদের পতন ঘটেছে। ফলে সাংবিধানিক বা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে বিষয়টি খুব কমই ঘটেছে। শাসকেরা অধিকাংশ সময়ই ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে প্রতারণা, নির্বাচনকে বিতর্কিত করা, প্রশাসনকে নিজেদের পক্ষে ব্যবহার করার মতো কাজ করেছে। রাজনৈতিক আদর্শের পরিবর্তে ক্ষমতার লড়াইই এখানে প্রাধান্য পায়। এর ফলে, সরকারের সংস্কার কর্মসূচি এবং নির্বাচনী ব্যবস্থার পরিবর্তনের প্রচেষ্টা কোন পথে এগুচ্ছে এবং তার সফলতার সম্ভাবনা কতখানি, তা নিয়ে জনগণের মধ্যে সন্দেহ রয়েই গেছে।
রাজনৈতিক দলগুলোতে আদর্শের দুর্বলতা এবং আদর্শহীনতার কারণে বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশ সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে। আদর্শভিত্তিক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে হলে সবার আগে দলের ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চা শুরু করতে হবে। দলীয় গণতন্ত্র এবং নেতৃত্ব নির্বাচনের প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও কার্যকরী হতে হবে।
নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে অনেক আলোচনা হলেও বাস্তবে জনগণের আস্থা অর্জন করার মতো তেমন কিছু এখনও দৃশ্যমান হয়নি। অতীতের নির্বাচনগুলোতে অনিয়ম ও ভোট জালিয়াতির কারণে জনগণ নির্বাচন ব্যবস্থা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। সুতরাং, নির্বাচনী পদ্ধতিতে স্বচ্ছতা, স্বাধীনতা এবং নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হলে দৃশ্যমান ব্যবস্থা নিতে হবে।
রাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্নতি করতে শুধু নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কারই যথেষ্ট নয়। সমান্তরালভাবে দেশের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামোও সংস্কার করা উচিত। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ এবং ধনী-গরীব বৈষম্য দূরীকরণের জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। এসব পদক্ষেপ দেশের সার্বিক অগ্রগতি এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্নয়নে সহায়ক হবে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর গঠন এবং পরিচালনা পদ্ধতি, তাদের উদ্দেশ্য—এসবের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রপদ্ধতির সাথে খুব বেশি মিল নেই। আবার ইসলামপন্থি দলগুলোই নয় শুধু, বরং বিভিন্ন সময় সামরিক ক্ষমতা থেকে শুরু করে ক্ষমতার আসনে বসা সবগুলো দলই ধর্মকে ব্যবহার করেছে। এতে দেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। গণতন্ত্র আরও দুর্বল হয়েছে। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার প্রবণতা বাদ দিয়ে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্য গড়ে তোলা। জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা ছাড়া কোনো ধরনের রাজনৈতিক সংস্কার সফল হতে পারে না।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব প্রায় একক ব্যক্তির উপর নির্ভরশীল। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নেতৃত্বের বিকাশ না হলে, নতুন নেতৃত্ব তৈরি হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যাবে। দলের ভিতরে একক নেতৃত্বের পরিবর্তে বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি করতে হলে দলের ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চাকে গুরুত্ব দিতে হবে।
রাজনৈতিক সংস্কৃতির সংস্কার একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। ঐক্য, দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, আদর্শিক রাজনীতির চর্চা, ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় স্বার্থকে গুরুত্ব দেওয়া—এসব তো হঠাৎ করেই দলগুলোর নিয়মিত বিষয় হয়ে উঠবে না। তবে নির্বাচনী সংস্কারের পাশাপাশি দলের ভিতরে গণতান্ত্রিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং জনগণের রাজনীতি সচেতনতার সমন্বয় গড়ে তুলতে কাজ করলে অবস্থার উন্নয়ন ঘটবে নিশ্চয়ই। রাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্নয়ন বা সংস্কার তাই শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলগুলোর হাতেই নয়, জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের ওপরও নির্ভরশীল। যদিও এখনও তা বহুদূর বলেই মনে হয়।
মেহেদী হাসান শোয়েব : লেখক, প্রকাশক, বিতার্কিক; শিফট ইনচার্জ, বাংলাদেশের খবর
এমএইচএস