দীর্ঘদিন লড়াই করে ‘ত্রাসের বেড়াজাল’ ছিন্ন করে ছাত্র-জনতা স্বৈরাচারের পতন ঘটাতে সক্ষম হন। ভয় থেকে জয়ে পদার্পণ হয় আমাদের। ভোরের সূর্যের মতো মনে উঁকি দিতে থাকে নতুন আশা-আকাঙ্ক্ষা। আমরা স্বপ্ন দেখতে থাকি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের। যেখানে মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক হবে সাম্যের, ভ্রাতৃত্বের, ভালোবাসার, সম্মানের। কেউ কাউকে শোষণ করবে না, নাগরিক হিসেবে সবাই যার যার অধিকারটা ঠিকঠাক পাবে। এর জন্যই তো লড়াই, রক্তক্ষয়, প্রাণনাশ। রক্ত ও প্রাণের মূল্যে কি আমরা একটু পরিবর্তন আশা করতে পারি না?
আমাদের আশা তো আশা পর্যন্তই থেকে যাচ্ছে। আশা প্রাপ্তিতে পরিণত হচ্ছে না। হয়তো অনেকে বলবেন, ধীরে ধীরে হবে, হচ্ছে। কিন্তু হচ্ছে যেহেতু তাহলে দৃশ্যমান নয় কেন? ৫ আগস্টের ৫ মাস পরও কেন শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করবে পুলিশ? অমানবিকভাবে নির্যাতন করবেই বা কেন? যদি শিক্ষার্থীরা রাস্তায় পুলিশের কিল-ঘুষি-লাথি খেতেই হয়, তাহলে তো সেটাকে আর পরিবর্তন বলা চলে না। আমরা জুলাইয়ের দিনগুলোতে পুলিশের বর্বরতা দেখেছি। মঙ্গলবার (৭ জানুয়ারি) সচিবালয়ের সামনে ঘটা শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের তাণ্ডব জুলাইয়ের মতোই হিংস্রতা, মনুষ্যত্বহীনার প্রকাশ। পুলিশ কি আর ভালো হবে না? ভালো হওয়ার নয়? এরকম নতুন বাংলাদেশ তো আমরা চাইনি। আমাদের ‘স্বপ্নের নতুন বাংলাদেশ’ কি হাইজ্যাক করার চেষ্টা হচ্ছে?
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। সেখানে দেখা যায়, প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষার্থীকে পুলিশের বেশ কয়েকজন পুলিশ মারধর করছে। একযোগে সবাই মিলে কিল-ঘুষি-লাথি-লাঠিপেটা সবই করছে। একপর্যায়ে ওই শিক্ষার্থীকে গলাচেপে ধরে। তারপর শার্টের কলার ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। যা একটি সভ্য ও মানবিক রাষ্ট্রে হতে পারে না। আফসোস, আমরা এখনো বর্বরতার ভেতরেই খাবি খাচ্ছি!
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ৫ মাস অতিবাহিত হলেও এখনো পুলিশ সংস্কার করা সম্ভব হয়নি। পুলিশকে জনবান্ধব করা যায়নি। পুলিশ আগের মতোই ‘গুন্ডাবাহিনী’ হিসেবে রয়ে গেছে। সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিদিন নানা প্রতিশ্রুতির বস্তা উগড়ে দেওয়া হচ্ছে। আমরা সেসবের নিচে চাপা পড়ছি। আর আওয়ামী লীগের লাঠিয়াল বাহিনী খ্যাত পুলিশ এখনো তাদের ভয়ঙ্কর রূপ দেখাচ্ছে শিক্ষার্থীদের ওপর। বিষয়টি আমাদের জন্য লজ্জার।
জুলাইয়ে পুলিশের গুলিতেই সারাদেশে শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন পেশার হাজারো মানুষ নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। কিন্তু পুলিশের বিচার হবে কিনা, পুলিশকে জনবান্ধব করা হবে কিনা, এখনো তেমন রূপরেখা হাজির করা হয়নি। অথচ পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন হয়েছে। পুলিশ সংস্কারের ফিরিস্তি দেখিয়েই আবার পুলিশ দ্বারা শিক্ষার্থীদের মারধর করা হচ্ছে। আমরা কি কখনো ভালো পুলিশ অর্থাৎ জনবান্ধব পুলিশ দেখতে পারব না? আমরা আশা করব সংস্কার, আর মার খাব বারবার? আশাই সর্বনাশা হবে? তা হতে দেওয়া যায় না। এখনই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। জনগণের টাকায় গড়ে ওঠা বাহিনী জনগণকে মারবে, তা হতে পারে না। সরকারকে অবশ্যই বর্বর পুলিশদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। সবাই মিলে সেই দাবি জোরালো করতে হবে।
সচিবালয়ের সামনে পুলিশ কর্তৃক শিক্ষার্থীদের লাঠিচার্জের ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। কিন্তু এ ঘটনা যেন হালকাভাবে উড়িয়ে দেওয়া না হয়। তদন্তের নামে যেন পুলিশকে দায়মুক্তি দেওয়া না হয়। কিংবা গুটিকয়েক পুলিশকে বরখাস্ত করেই ঘটনাটি নিষ্পত্তি করলে চলবে না। ব্যবস্থা বদল করতে হবে। গুটিকয়েক পুলিশ বরখাস্ত করলেই যে পুলিশি নির্যাতন থেমে যাবে, সেটা বলা যাচ্ছে না। পুলিশ দিয়ে জনগণকে নির্যাতনের সংস্কৃতি সমূলে উপড়ে ফেলতে হবে। সে জন্য যা যা করণীয়, তা করতে হবে সরকারকে।
একইসাথে এ ঘটনার জবাবদিহি করতে হবে সরকারকে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের পর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হয়েছে। পক্ষান্তরে শিক্ষার্থীরাই ড. ইউনূসকে এনেছেন দায়িত্বে। এ কথা তিনি নিজেও বিভিন্ন বক্তব্যে বলেছেন। তাই এখন অধ্যাপক ড. ইউনূসের পরিষ্কার করা দরকার যে, শিক্ষার্থীরা তাকে আনার প্রতিদান হিসেবে তিনি পুলিশের কিল-ঘুষি-লাথি উপহার দিচ্ছেন কিনা!