Logo

মতামত

তিস্তার কান্না আর না

Icon

মীর রবি

প্রকাশ: ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ২১:০৪

তিস্তার কান্না আর না

বাংলাদেশ ও ভারতের অমীমাংসিত ইস্যুগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান একটি ইস্যু তিস্তা। তিস্তার সুষম পানিবণ্টন চুক্তি অসম্পন্ন থেকে গেছে সব সরকারের আমলেই। যুগের পর যুগ পানির ন্যায্য হিস্যা ঝুলিয়ে রেখেছে ভারত সরকার। পানিবণ্টন চুক্তির সমাধান না হতেই শেখ হাসিনার শাসনামলে আলোচনায় আসে তিস্তা নদী কেন্দ্রিক মেগা প্রকল্প ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা’। এই পরিকল্পনাও তিস্তার জলের মতো ঝুলে গিয়েছে ভারতের আপত্তির জন্য। এর প্রধান কারণ ছিল প্রকল্প ঘিরে চীনের সম্পৃক্ততা। 

ভারত ঘনিষ্ঠ আওয়ামী সরকার ভারতকে অখুশি করে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে চীনকে তিস্তা প্রকল্পের কাজ দিতে সাহস পায়নি। বাংলাদেশে তিস্তা নিয়ে চীনের এই প্রকল্প ভারতের জন্য বরাবরই উদ্বেগের কারণ ছিল। কেননা, এটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শিলিগুড়ি করিডর এবং উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর খুব কাছাকাছি বিস্তৃত। এজন্য ভারতের আপত্তিতে খোদ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েও শেষ পর্যন্ত চুপ হয়ে যান এবং নতুন করে সিদ্ধান্ত নিতে হয় তাকে। গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে ভারতকে দিয়েই এই প্রকল্প বাস্তবায়নের আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন তিনি। ঠিক সেটাও কতটুকু ফলপ্রসূ আলাপ ছিল, সেটা নিয়ে এখন নতুন করে আলোচনার কিছু নেই। বরং এই প্রকল্পের পটভূমিতে ভারতের সঙ্গে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হওয়াটাই আমাদের জন্য চিন্তার বিষয়। যা নদী-সম্পর্কিত কার্যক্রমের ভবিষ্যৎ নিয়ে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষের অধৈর্য বাড়িয়ে তুলছে। একদিকে পানি কেন্দ্রিক মৌসুমি জটিলতা, অন্যদিকে তিস্তা মহাপরিকল্পনারও কোনো খবর না থাকায় আশাহত হয়েছে তিস্তা নদী অববাহিকার বাসিন্দারা। 

সাম্প্রতিক বাস্তবতায় আবারও আলোচনায় এসেছে তিস্তা মহাপরিকল্পনা। অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ভারতের বিজেপি সরকারের সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্যে তিস্তাকে ঘিরে নানা সমীকরণ দেখতে পাচ্ছি আমরা। পানি চুক্তির সমস্যাকে জিয়ে রেখেই সরকার চীনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের অপেক্ষমাণ চীন সফরের সংবাদে নতুন করে আলোচনায় এসেছে তিস্তা মহাপরিকল্পনা। ঢাকা বেইজিং সম্পর্ক উন্নয়ন ও নিজেদের স্বার্থে তিস্তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলেছেন এই উপদেষ্টা। তিস্তাকে ঘিরে ভারত বাংলাদেশ চীন, ত্রিদেশীয় সম্পর্কে জটিলতা রয়েছে। এর বাইরে তিস্তা ছাড়াও আলোচনায় রয়েছে ব্রহ্মপুত্র। প্রচারণা রয়েছে তিস্তা থেকে ভারত যেমন পানি অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছে, ঠিক তেমনি ব্রহ্মপুত্র থেকে অন্যত্র পানি সরিয়ে নিচ্ছে চীনও। ব্রহ্মপুত্র থেকে ভারতও পানি অপসারণ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সেই প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মতে ভিন্ন ভিন্ন মতামত রয়েছে। তিস্তা মহাপরিকল্পনাকে হিসেবে ধরে কেউ কেউ মনে করছেন, এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও চীনের সম্পর্কে খানিকটা উন্নতি ঘটলেও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরও সংকটময় হয়ে উঠতে পারে। এক্ষেত্রে এটা রাজনৈতিক সরকারের সিদ্ধান্তের জন্য রেখে দেয়াই উত্তম। অন্যরা এর সঙ্গে একমত নন। তারা বাংলাদেশের স্বার্থে এই প্রকল্প চীনকে দিয়েই দ্রুত বাস্তবায়নের কথা বলছেন। এর বাইরে ব্রহ্মপুত্র নিয়ে তেমন কেউ কথা তুলছেন না এই মুহূর্তে। 

অতি সাম্প্রতিক ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বাংলাদেশের তিস্তা প্রকল্পে সহায়তার বিষয়ে চীনের আগ্রহের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের জানান, তিস্তা প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে চীন। এটার সমাধান হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে নদী ও পানি ব্যবস্থাপনা সমঝোতা স্মারক রয়েছে। সেই সমঝোতা স্মারকের মেয়াদ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সফরে এ সমঝোতা স্মারক নবায়ন করার কথা রয়েছে। 

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের পরপরই আগামী মার্চে চীন সফরে যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এই দুই সফরই বাংলাদেশের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই সফরকে ঘিরে তিস্তা অঞ্চলের মানুষ মহাপরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে। তারা আশা করছে এই প্রকল্প অন্তত এবার আলোর মুখ দেখবে। তিস্তা পাড়ের মানুষ ভারতের সঙ্গে পানি চুক্তিতে যতটা না আগ্রহী, সেই তুলনায় চীনের সঙ্গে এই প্রকল্প ঘিরে অধিকতর উৎসুক। তারা মনে করে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হলে শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানিপ্রবাহ খানিকটা বাড়বে হয়ত, কিন্তু বর্ষায় গজলডোবা ব্যারাজের সব গেট খুলে দেওয়ায় কৃত্রিম ও মৌসুমি  বন্যার হাত থেকে রক্ষার নিশ্চয়তা নেই।  এতে তিস্তা অঞ্চলের জনগণ স্থায়ী কোনো সমাধান পাবে না। অন্যদিকে চীনের প্রস্তাবিত প্রকল্পের জলাধারগুলোর সংরক্ষিত পানি পরিকল্পিত সেচব্যবস্থায় ব্যবহৃত হবে  বলে, তারা এই প্রকল্প ঘিরেই সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজছে। তারা মনে করে তিস্তা মহাপরিকল্পনাই তাদের সকল সমস্যার টেকসই সমাধান দিতে পারে। সেই সঙ্গে এই অঞ্চলে কৃষি ও কৃষিশিল্প ভিত্তিক নতুন দিগন্তের সূচনা করবে তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন। বিশেষত উত্তরাঞ্চলের মানুষের নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এসব বিষয়কেই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে তিস্তা পাড়ের মানুষ। 

তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে সম্ভাব্য প্রকল্প যাচাই করতে ভারত ও চীন উভয়ই সমীক্ষা চালিয়েছে। বিশেষত বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পাওয়ার চায়না যৌথভাবে প্রায় ৩ বছর কারিগরি সমীক্ষা চালায়। জানা যায়, সমীক্ষা শেষে তিস্তা নদীব্যবস্থাপনার একটি প্রস্তাবও উত্থাপন করে পাওয়ার চায়না। প্রস্তাবে তিস্তা নদীর গভীরতা বৃদ্ধিতে খনন, বর্ষাকালে ভারতের ছেড়ে দেওয়া অধিকতর পানিসৃষ্ট বন্যা থেকে তিস্তার দুপারের মানুষকে রক্ষার জন্য অতিরিক্ত পানি সংরক্ষণে জলাধার নির্মাণ এবং খরাকালে ভারত নদীর পানি আটকে দিলে, জলাধারে সংরক্ষিত পানি দিয়ে কৃষি কাজ চালানো, ভাঙন রোধ, নদী পাড়ের কৃষি জমি উদ্ধার করে সেচ ও কৃষির বিস্তার, নৌ চলাচল, নদীর দু’পারে সড়ক নির্মাণ, পর্যটন, আবাসনসহ কৃষি ভিত্তিক শিল্পায়নের কথা উল্লেখ করা হয়। যা এই অঞ্চলের জনগণের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে মর্মে তিস্তা জনপদের মানুষ নতুন স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ হয়ে আছে। তারা চায় এর দ্রুত বাস্তবায়ন। অর্থনীতির চাকা সচলে তারাও এই প্রকল্পের মধ্য দিয়ে হয়ে উঠতে চায় উন্নয়নের অংশীজন। 

বিধায়, এই প্রকল্প প্রস্তাবটির বাস্তবায়নের দাবিতে দেশের উত্তরাঞ্চল ছাড়াও দেশের নানা প্রান্তরে গত কয়েক বছর থেকে মানববন্ধন, সভা-সমাবেশ, মিছিলসহ নানা কর্মসূচি পালন করতে দেখা গিয়েছে। বিশেষভাবে ‘তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও আন্দোলন’ বারবার তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি ও তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জোর দাবি জানিয়ে আসছে। তাদের সংগ্রাম দীর্ঘদিনের। তারা বলছেন, ‘আমরা ভারত চীন বুঝি না, আমরা নিজস্ব অর্থায়নে এই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন চাই’। তাদের মতে নিজস্ব অর্থায়নে চীনের কারিগরি সহায়তায় এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা উচিত। এর বাইরে চীনের প্রস্তাবিত ঋণ ও ঋণের শর্ত সাপেক্ষে প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে দেশের স্বার্থ রক্ষা সম্ভব নয়। কারণ, অতিরিক্ত সুদহার এবং ঋণ পরিশোধের স্বল্প সময়সীমা দেশের অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করবে। এজন্য সকল দিক যৌক্তিক বিবেচনায় বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিকে আমলে নিয়ে তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়নের দাবি আরও জোরালো হচ্ছে। তিস্তাবাসী তিস্তার কান্না আর চান না। 

মীর রবি : কবি ও সমাজচিন্তক

  • বাংলাদেশের খবরের মতামত বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- [email protected] 

এমএইচএস

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর