-679b5143db085.jpg)
পৃথিবীব্যাপী সকল দেশে সকল সরকার দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে বদ্ধ পরিকর হয়ে কাজ করে; আর বাংলাদেশে স্বাধীনতার ৫৪ বছর ধরে যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তখন সেই সরকারই ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে ব্যস্ত থেকেছে। মধ্যিখানে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে, মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে বারবার। তবে বৈষম্য বিরোধী-দুর্নীতিরোধের পরিকল্পনা থেকে গঠিত এই সরকার মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে চার পদক্ষেপ বাস্তবায়নে তৎপরতা চালাচ্ছে বলে জানতে পেরেছি।
তবে গণমাধ্যম বলছে- এগুলো বাস্তবায়নে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে অসহযোগিতা। সুযোগ বুঝে অসাধু ব্যবসায়ীদের বেশি মুনাফার প্রবণতা আগের চেয়ে বেড়েছে। বিভিন্ন স্তরে চাঁদাবাজি হচ্ছে। এসব কারণে পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। ফলে মূল্যস্ফীতির ওপর বাড়তি চাপ পড়ছে। যদিও গণমাধ্যম বলছে- এসব সমস্যা বিগত সরকারের তৈরি। কিন্তু সেগুলো এখন মোকাবিলা করতে হচ্ছে বর্তমান সরকারকে।
৪টি পদক্ষেপের মধ্যে আছে ১. টাকার প্রবাহ হ্রাস ২. শুল্ক কমানো ৩. সুদের হার বৃদ্ধি এবং ৪.বাজার তদারকি জোরদারের মতো চিন্তা। তার সাথে আরো একটি পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। একজন লেখক হিসেবে, একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে সেই বিশেষ পদক্ষেপটি বর্তমান সরকারের কাছে তুলে ধরছি, আর তা হলো- সুদের হার বৃদ্ধি না করে কমান এবং খাদ্য-বাণিজ্য-শিল্প মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদেরকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে নতুন করে নিয়োগ এবং পদোন্নতি দিতে হবে। কারণ সুদ বাড়ালে কোনোভাবেই মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে না।
সরকারকে এখন সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে পণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায়। এজন্য শিল্পের কাঁচামাল আমদানির পথ অবারিত রাখতে হবে। উৎপাদন খাতে টাকার জোগান বাড়াতে হবে। সরবরাহ ব্যবস্থায় সব ধরনের বাধা অপসারণ করতে হবে। যে-সব ব্যবসায়ী সন্দেহভাজন বা পলাতক তাদের বিশেষ তদারকির আওতায় আনতে হবে। যাতে বাজারে পণ্যে মূল্য বাড়াতে তারা কারসাজি করতে না পারে।
পাশাপাশি বিনিয়োগ বাড়িয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে হবে। সরকার পণ্যমূল্য কমাতে আমদানি শুল্ক কমাচ্ছে। শুধু আমদানি পণ্যের শুল্ক কমিয়ে পণ্যের দাম কমানো সম্ভব নয়। অতীতে এ ধরনের পদক্ষেপ বাজারে কোনো সুফল বয়ে আনেনি। শুল্ক কমানোর সুফল পেতে হলে প্রয়োজন যথাযথভাবে বাজার তদারকি। যদিও বলা হচ্ছে যে, বিভিন্ন কারণে সরকার বাজার মনিটরিং জোরদারের নির্দেশ দিয়েছে। এখনই শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ যেভাবে পণ্যমূল্য বাড়ছে তাতে আগামীতে মূল্যস্ফীতির হার আরও বাড়তে পারে। সরকার এখনই সতর্ক না হলে মার্চে শুরু হওয়া রমজানে বাজার পরিস্থিতি ভোক্তার জন্য পীড়াদায়ক হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
আলোকিত বাংলাদেশ মানে নিরন্তর জনবান্ধব চিন্তা। তা কি আদৌ এই সরকার সুপরিকল্পিতভাবে করতে পারছে? যদি পারতো, তাহলে কেন কবি শামসুর রাহমানের ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’ কথাটি বারবার উচ্চারিত হচ্ছে? কী কারণে এ সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে কয়েকজন বড় ব্যবসায়ীসহ মাঝারি ও ছোট বেশ কিছু ব্যবসায়ী পলাতক হয়েছে? তারা বিদায়ি সরকারের ঘনিষ্ঠ বা সরাসরি দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যে কারণে গ্রেফতারের ভয়ে গা ঢাকা দিয়েছেন। তারা পেছন থেকে কোনো ধরনের কলকাঠি নাড়ছেন কিনা তা জোরালোভাবে মনিটর করার জন্য এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে বলে আমি মনে করি।
সেই সাথে বিশ্বাস করি শুধুমাত্র সুপরিকল্পনার অভাবে বিশ্বে কমলেও গত সরকারের ভুল ব্যবস্থাপনায় দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। অবশ্য এরই মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে টাকা পাচার বন্ধ ও সন্দেহজনক লেনদেন রোধে অনেক ব্যবসায়ীর ব্যাংক হিসাব জব্দ বা স্থগিত করা হয়েছে। সন্দেহভাজনদের ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবও স্থগিত করা হয়েছে। এতে ওইসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিক ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারছে না।
বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) থেকে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো কোম্পানির হিসাব জব্দ করা হয়নি। কিন্তু ব্যাংকগুলো অতি সতর্কতা হিসেবে অনেক প্রতিষ্ঠানের এলসি খুলছে না নিয়মিত। আগের এলসির দায়ও শোধ করতে দেরি করছে। তাদের সন্দেহ এই প্রক্রিয়ায় টাকা পাচার হতে পারে বলে ধারণা করছে ছাত্র-জনতার সরকার হিসেবে ব্যাপক বিশ্বাসের সরকার-ড. ইউনূস সরকার। তাতে ভালো ফলাফল আসবে না, যদি না কঠোর এবং সুপরিকল্পনা নিতে ব্যর্থ হয় আমাদের এই সময়ের সরকার।
তাছাড়া ব্যাংকগুলোকে পরিষ্কার বার্তা দেওয়া হয়েছে, কোনো কোম্পানির এলসিসহ বাণিজ্যিক লেনদেন বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। তবে কোনোভাবেই যাতে টাকা পাচার না হয় সেটি ব্যাংকগুলোকেই নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু ব্যাংক তা নিশ্চিত করতে পারছে না। কারণ কোম্পানি পরিচালনার সঙ্গে যারা জড়িত তারাই এখন পালিয়ে যাচ্ছেন। এখন সরকারের পক্ষ থেকে কোম্পানিগুলোর কাঁচামাল আমদানি, পাইপলাইনে থাকা কাঁচামাল, উৎপাদন, বিপণন এসব তথ্য সাপ্তাহিক ভিত্তিতে তদারকি করা দরকার। এসব খাতে ঘাটতি হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলেও আমি বিশ্বাস করি। এতে করে উৎপাদন ও সরবরাহ স্বাভাবিক হতে পারে।
এছাড়া যারা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে দাম বাড়াচ্ছে আগে তাদের দ্রুত চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। এরই মধ্যে অবশ্য সরকারের নিদের্শনাকে সামনে রেখে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগস্ট-সেপ্টেম্বরে বন্যার কারণে উৎপাদন বাঁধাগ্রস্ত হয়েছে। এসব কারণেও বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
সরকারের কেন্দ্রীয়সহ স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা এখনও ঠিকভাবে কাজ করছে না। এতে তদারকি ব্যবস্থা শিথিল হয়ে পড়েছে। সে কারণে উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থার তথ্যের ঘাটতিতে সঠিক পদক্ষেপও নেওয়া যাচ্ছে না। সরকার এখন পণ্যের দাম কমাতে শুল্ক কমাচ্ছে। যা ভালো উদ্যোগ বলেই সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে, কিন্তু শুল্ক কমানোর ঘোষণা সরকার দিলেও ভেতরে যে যন্ত্রণার দুর্নীতি চলছে, তা থামানোটাও খুব জরুরি। দুর্নীতি থামাতে ব্যর্থ হলে সকল লোক দেখানো পদক্ষেপ বলেই বিবেচিত হবে। যা প্রশ্নবিদ্ধ করবে বিশ্বে এই সময়ে একমাত্র নোবেলবিজয়ী রাষ্ট্রনায়ক ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বৈষম্যবিরোধী-দুর্নীতিরোধকল্পের সরকারকে। যা আমাদের কারোই প্রত্যাশিত হবে না।
বাংলাদেশের রাজনীতি-শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-অর্থনীতি-কূটনীতিকে ধ্বংস করা রাজনীতির নামে মন্দনীতিতে বদ্ধ পরিকর হওয়া আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের শাসনামলে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বৈশ্বিক মন্দা শুরুর আগে দেশে মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে ৫ শতাংশের মধ্যেই ছিল। মন্দার প্রভাবে বিশ্বব্যাপী এ হার বাড়তে শুরু করে। দেশে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বৈশ্বিকভাবে মূল্যস্ফীতির হার এখন অনেকটা কমে এসেছে। জুনে বাংলাদেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার সর্বোচ্চ ১৪ দশমিক ১ শতাংশে উঠেছিল। আগস্টে তা কমে ১১ দশমিক ৪ শতাংশে নেমেছে। সেপ্টেম্বরে তা ১০ দশমিক ৪০ শতাংশে নেমে এসেছে। এ হার ক্রমশ কমছে।
এভাবে বাংলাদেশকে খাদের কিনারে নিয়ে যাওয়া অন্ধকারের পর আলোর পথ ধরে সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার অনেক দেশেই কমে গেছে। এর মধ্যে ভুটানে ২ দশমিক ৩ শতাংশ, ভারতে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ, নেপালে ৪ দশমিক ১ শতাংশ নেমেছে। অর্থনৈতিক মন্দায় জর্জরিত পাকিস্তানে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার কমে ২ দশমিক ৫ শতাংশে নেমেছে। অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে পড়া শ্রীলঙ্কা ইতোমধ্যেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ থেকে নেওয়া ঋণের পুরোটাই পরিশোধ করেছে। মূল্যস্ফীতির হারও কমে শূন্য দশমিক ৮ শতাংশে নেমেছে।
এই সময়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার কমে ইন্দোনেশিয়ায় ৩ দশমিক ৪ শতাংশে, মিয়ানমারে ৬৬ শতাংশ থেকে কমে ৫৮ শতাংশে, ব্রাজিলে ৪ দশমিক ৬ শতাংশে, চীনে ২ দশমিক ৯ শতাংশে, মালয়েশিয়ায় ১ দশমিক ৬ শতাংশে, মালদ্বীপে ৬ দশমিক ৫ শতাংশে, থাইল্যান্ডে ১ দশমিক ৮ শতাংশে, কানাডায় ২ দশমিক ৭ শতাংশে, ফ্রান্সে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশে, জার্মানিতে ১ দশমিক ৫ শতাংশে, ইতালিতে শূন্য দশমিক ৬ শতাংশে, জাপানে ২ দশমিক ১ শতাংশে, ওমানে ৩ দশমিক ৩ শতাংশে, সৌদি আরবে ১ দশমিক ১ শতাংশে, সুইডেনে ১ শতাংশে, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২ দশমিক ৫ শতাংশে, যুক্তরাজ্যে ১ দশমিক ৩ শতাংশে, যুক্তরাষ্ট্রে ২ দশমিক ১ শতাংশে নেমেছে।
একথা বলতে কোনো দ্বিধা নেই যে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বিজয় আসার পেছনে বড় একটি কারণ ছিল অর্থনৈতিক মন্দা। ছাত্ররা পড়াশোনা শেষ করে অর্থনৈতিক মন্দায় কর্মসংস্থান করতে পারছিল না। জনগণ পণ্যমূল্য বাড়ায় জীবিকা নির্বাহ করতে পারছিল না। এই দুই কারণে আন্দোলনে সব শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণ ছিল। কিন্তু সেই মানুষেরা আজ দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতে জর্জরিত, মূল্যস্ফীতির কারণে নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম হয়েছে। ছাত্র-জনতার সরকারের কাছে তাই জনগণের দাবি দুর্নীতিরোধ করতে হবে, দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল করতে হবে এবং আইন-শৃঙ্খলা কঠোরভাবে বজায় রাখতে হবে। তা না হলে হেরে যাবে বাংলাদেশ সেই অতীতের মতো।
লেখক : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ (এনডিবি)
- বাংলাদেশের খবরের মতামত বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- [email protected]