Logo

মতামত

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি : জনজীবনের দুর্ভাবনা ও অর্থনীতির চাপ

Icon

সেলিম রানা

প্রকাশ: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৮:০১

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি : জনজীবনের দুর্ভাবনা ও অর্থনীতির চাপ

জীবনযাত্রার ব্যয় যখন প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে, তখন নতুন বছরের শুরুতে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষের কপালে আরও দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। পেট্রোল, অকটেন, ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে এক টাকা করে বাড়ানো হয়েছে, যা ১ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হয়েছে। যদিও সরকার বিশ্ববাজারের ওঠানামার সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণের নীতি গ্রহণ করেছে। তবুও এ মূল্যবৃদ্ধির সরাসরি প্রভাব পড়বে জনজীবনের প্রতিটি স্তরে। যানবাহন খাত থেকে শুরু করে কৃষি উৎপাদন, শিল্পকারখানা, বিদ্যুৎ উৎপাদন—সব ক্ষেত্রেই নতুন ব্যয়ের বোঝা চাপিয়ে দেবে এই পরিবর্তন।

মূল্যবৃদ্ধির পটভূমি : এক দোলাচলের নাম
গত বছরের মার্চ থেকে সরকার বিশ্ববাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রতি মাসে নতুন দামে জ্বালানি তেল বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে পেট্রোল ও অকটেনের দাম তুলনামূলক বেশি রাখা হয়েছে, কারণ এগুলো প্রধানত ব্যক্তিগত যানবাহনে ব্যবহৃত হয় এবং সরকার এগুলোকে বিলাস-পণ্য হিসেবে গণ্য করছে। অন্যদিকে, ডিজেল ও কেরোসিনের দাম কিছুটা কম রাখা হয়, কারণ এসব পণ্য গণপরিবহন, কৃষি ও শিল্পখাতে বেশি ব্যবহৃত হয়।

তবে বাস্তবতা হচ্ছে, ডিজেলনির্ভর যানবাহন ও কৃষি যন্ত্রপাতির ওপরই দেশের অর্থনীতির প্রধান ভরসা। দেশে ব্যবহৃত মোট জ্বালানি তেলের প্রায় ৭৫ শতাংশই ডিজেল। পরিবহন খাত, কৃষি উৎপাদন, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও শিল্পখাতে ডিজেলের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। এ কারণে ডিজেলের দামের সামান্য বৃদ্ধি হলেও এর প্রভাব বহুমুখী হয়ে পড়ে।

গণপরিবহন ও যাতায়াত খাতে নতুন সংকট
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে গণপরিবহন খাত সবচেয়ে বেশি সুযোগ নেয়। সাধারণত ডিজেল চালিত বাস, ট্রাক, নৌযানসহ অন্যান্য গণপরিবহন মালিকরা অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অজুহাত খোঁজেন। সামান্য মূল্যবৃদ্ধি হলেও তারা বড় অঙ্কের বাড়তি ভাড়া চাপিয়ে দেন যাত্রীদের ওপর। এতে নিত্যদিনের যাতায়াত ব্যয় বৃদ্ধি পায়, যার সরাসরি প্রভাব পড়ে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের ওপর।

শুধু বাস বা ট্রাক নয়, পণ্য পরিবহনের খরচ বেড়ে গেলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দামও বেড়ে যায়। ফলে চাল, ডাল, তেল, সবজি, মাছ-মাংসসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। ব্যবসায়ীরা প্রায়শই পণ্য পরিবহনের ব্যয় বৃদ্ধিকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে মূল্যবৃদ্ধির সুযোগ নেন।

কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে বিপর্যয়
বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন ডিজেলনির্ভর। সেচযন্ত্র, ট্রাক্টর, ধানমাড়াই যন্ত্রসহ অন্যান্য কৃষি সরঞ্জাম ডিজেল চালিত। ডিজেলের দাম বাড়লে কৃষকের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়, যা কৃষিপণ্য ও খাদ্যদ্রব্যের দাম বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। একদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত, অন্যদিকে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি কৃষকদের জীবনযাত্রাকে আরও কঠিন করে তুলবে।

বিশেষ করে বোরো মৌসুমে ডিজেলের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি হয়, কারণ এ সময় সেচের জন্য ডিজেলচালিত পাম্পের ওপর নির্ভর করতে হয় কৃষকদের। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি সেচ খরচ বাড়িয়ে দেবে, যা ধানের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে তুলবে এবং শেষ পর্যন্ত এর প্রভাব পড়বে চালের দামের ওপর। ফলে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের খাদ্য ব্যয় আরও বেড়ে যাবে।

শিল্প ও বিদ্যুৎ খাতে নতুন ব্যয়ের চাপ
শিল্পকারখানার উৎপাদন ব্যয়ও বাড়বে, কারণ অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান এখনও জ্বালানির বিকল্প উৎস না পেয়ে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলের ওপর নির্ভরশীল। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোও ফার্নেস অয়েল ও ডিজেল ব্যবহার করে। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেলে শিল্প ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর খরচ বেড়ে যাবে, যা পণ্যের চূড়ান্ত মূল্যে প্রতিফলিত হবে।

অন্যদিকে, অনেক বহুতল ভবন ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎ বিভ্রাটের সময় ডিজেলচালিত জেনারেটর ব্যবহার করে। ডিজেলের দাম বেড়ে গেলে এসব ভবন ও প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালন ব্যয়ও বৃদ্ধি পাবে। এতে একদিকে যেমন ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, অন্যদিকে অফিস-আদালত ও ব্যবসায়িক খরচও বেড়ে যাবে।

সরকারের ভূমিকা : কী হওয়া উচিত?
সরকারের উচিত এই মূল্যবৃদ্ধির সরাসরি প্রভাব বিশ্লেষণ করা এবং পরিস্থিতি মোকাবিলায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

১. পরিবহন খাতে কঠোর তদারকি : গণপরিবহন মালিকদের অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের প্রবণতা রোধে সরকারের কঠোর মনিটরিং প্রয়োজন। যেন সামান্য মূল্যবৃদ্ধিকে অজুহাত বানিয়ে যাত্রীদের ওপর বাড়তি চাপ না দেওয়া হয়।

২. কৃষি ও উৎপাদন খাতে বিশেষ সহায়তা : কৃষকদের জন্য ডিজেলের ওপর বিশেষ ভর্তুকি প্রদান করা যেতে পারে, যাতে তারা বাড়তি ব্যয়ের চাপ থেকে কিছুটা মুক্তি পান। একইসঙ্গে শিল্প ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যও সহনীয় নীতি গ্রহণ করা উচিত।

৩. বিদ্যুৎ ও জ্বালানির অপচয় রোধ : জ্বালানি সংরক্ষণ এবং বিদ্যুতের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। বিদ্যুৎচালিত যানবাহনের ব্যবহার ও নবায়নযোগ্য শক্তির প্রসারে জোর দিতে হবে, যাতে ডিজেল ও অন্যান্য জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমে।

৪. সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা : নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির ওপর জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব কমানোর জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।

ভারসাম্যপূর্ণ নীতি প্রয়োজন
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি শুধু একটি নির্দিষ্ট খাতকে নয়, বরং অর্থনীতির প্রতিটি স্তরকে প্রভাবিত করে। এতে যেমন জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ে, তেমনি সামগ্রিক অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাই সরকারকে বিশ্ববাজারের বাস্তবতা মাথায় রেখেই নীতি গ্রহণ করতে হবে, তবে তা যেন জনসাধারণের ওপর অতিরিক্ত বোঝা না চাপায়। তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা জোরদার না হলে, এই মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হবে, যা সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতির জন্য হুমকিস্বরূপ। সময় এসেছে দূরদর্শী ও সুপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের, যাতে দেশের উন্নয়ন ও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকে।

সেলিম রানা : গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট 

  • বাংলাদেশের খবরের মতামত বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- [email protected] 
Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর