-67a5e81424015.jpg)
অমর একুশে গ্রন্থমেলা। সাধারণের কাছে একুশে বইমেলা নামেই পরিচিত। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গণে। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের ২১ তারিখ (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮ বৃহস্পতিবার) রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য আন্দোলন করে ভাষা সৈনিকেরা। পুলিশের গুলিতে নিহত হন সালাম, রফিক, জব্বার, বরকতসহ অনেকেই। এই ঘটনার পর থেকেই ফেব্রুয়ারি মাস হয়ে ওঠে বাঙালিদের কাছে ভাষার মাস। এক গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিবিজড়িত তাৎপর্যপূর্ণ মাস। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ২১শে ফেব্রুয়ারিকে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ২১শে ফেব্রুয়ারির আত্মোৎসর্গী বীরত্বপূর্ণ ঘটনাকে স্মৃতিতে অম্লান রাখতে বইমেলার নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’।
মেলা মানে উৎসব। মেলা মানে অনেক। বইমেলা মানে বইউৎসব। মেলা বই মানে অনেক বই। বইমেলা বলতে আমরা বুঝি, ‘বিক্রয় ও প্রদর্শনীর জন্য এক জায়গায় হাজার হাজার বইয়ের সমাহার। যেখানে প্রকাশক ও বিক্রেতাগণ বিভিন্ন রকমের বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসে। পাঠক ও বইপ্রেমীরা পছন্দের বই সংগ্রহের জন্য উৎসব আমেজে মেলা প্রাঙ্গণে ভীড় জমায়। নতুন বইয়ের মনকাড়া ঘ্রাণ, মোহিত করে চারিপাশ, জুড়ায় মন-প্রাণ।’
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে বইমেলার সূচনা হয়। চিত্তরঞ্জন সাহা নামক একজন প্রকাশক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গণের বটতলায় এই মেলার গোড়াপত্তন করেন। তিনি কলকাতা থেকে নিয়ে আসেন ৩২টি বই। চটের উপর সাজিয়ে বসেন। শুরু করেন বিক্রি ও প্রদর্শনী। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত একাই বই নিয়ে বসতেন তিনি। ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে মেলার সাথে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি। ১৯৮৩ সালে যুক্ত হয় বাংলা একাডেমি। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বর্তমানে এটি বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী জাতীয় মেলায় পরিণত হয়েছে।
২১শে বইমেলা। আমাদের প্রাণের বইমেলা। নিঃসন্দেহে বই মানুষের শ্রেষ্ঠ বন্ধু। বিশ্বস্ত পথপ্রদর্শক। জ্ঞানের আধার। বিনোদনের সঙ্গী। বই এমন একটি খোলা জানালা, যার মাধ্যমে আমরা বিশ্বকে অবলোকন করি। বই সভ্যতার সর্বোত্তম উৎস। সভ্যতার বিকাশ ও মনুষ্যত্বের উন্মেষে বইয়ের অবদান অনস্বীকার্য। মানুষের জ্ঞানসম্পদের সমৃদ্ধিতে বইয়ের ভূমিকা অপরিসীম। সচেতন ও পরিকল্পিত পাঠ, গভীর অধ্যয়ন বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি, পরিশীলিত সংস্কৃতি গড়ে তোলার সর্বশ্রেষ্ঠ উপকরণ। আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে শিখিয়েছেন কলমের মাধ্যমে। ইরশাদ হচ্ছে, ‘পড়, আর তোমার প্রভু অতিসম্মানিত। যিনি কলমের মাধ্যমে শিখিয়েছেন। মানুষকে জানিয়েছেন এমন বিষয় যা সে ইতঃপূর্বে জানত না।’ (সুরা আলাক, আয়াত :৩-৬) আর কলমের আচড়েই বইয়ের অস্তিত্ব। অতএব বইয়ের সাথে মহান আল্লাহ কর্তৃক শিখানো ইলম তথা ইলমে অহির রয়েছে গভীর সম্পর্ক।
বই শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে আরবি অহি (وحي) শব্দ থেকে। অহি থেকে বহি। বহি থেকে বই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরবি ‘ওয়াও’ বর্ণের বাংলা প্রতিবর্ণ হিসেবে ‘ব’ ব্যবহৃত হয়। বলা ও লেখার ক্ষেত্রে বিভিন্ন শব্দে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমনিভাবে আরবি وفاق শব্দটির উচ্চারণ বাংলায় আমরা বেফাক করে থাকি। তেমনি আরবি অহি এর উচ্চারণ বহি। আমাদের মাঝে আজও বহি শব্দটির ব্যবহার বিরাজমান। যেমন হাজিরা খাতার শিরোনামে লেখা হয়, ‘প্রাইমারি ছাত্র হাজিরা বহি’। বহি শব্দের চলিত রূপই বই। আরবি অহি শব্দটির আভিধানিক অর্থও তাই বলে। অহি শব্দের আভিধানিক অর্থ, প্রত্যাদেশ, গোপনে কোনো বার্তা পৌঁছে দেওয়া, কোনো বিষয় জানিয়ে দেওয়া ইত্যাদি। প্রত্যেকটি বইই লেখকের পক্ষ থেকে পাঠককে কোনো না কোনো বার্তা পৌঁছে দেয়। এই অর্থেও অহি শব্দের সাথে বইয়ের যুগসূত্র বুঝে আসে। তাই বলা যায়, অহি শব্দের সম্পৃক্ততা থেকেই বইয়ের নামকরণ।
ইলমে অহির বৈশিষ্ট্য হলো, তা মানুষকে সঠিক পথ দেখায়। অন্ধকার থেকে ব্যক্তিকে আলোর পথে নিয়ে আসে। অন্যায়ের পথ থেকে ফিরিয়ে এনে ন্যায়ের রাজপথে পরিচালিত করে। অসভ্যতার চোরাবালি থেকে উদ্ধার করে সমাজ ও রাষ্ট্রকে সভ্যতার মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করে। অশালীনতার ব্যাধি থেকে মুক্ত করে মানুষকে করে শালীন ও মার্জিত। যে বই এজাতীয় বৈশষ্টাবলি থেকে মুক্ত, যে বই মানুষকে মনুষ্যত্ব না শিখিয়ে পশুত্ব শেখায়, যে বই মানুষকে শালীন না করে অশালীনতার প্রতি ধাবিত করে, যে বই মানুষের সামনে পশুবৃত্তিকে সুশোভিত করে, সর্বোপরি যে বই ইলমে অহির আলো ও শিক্ষা বিবর্জিত, সে বই বই নাম প্রয়োগের অনুপযুক্ত। সে বই কখনো বইয়ের আবেদন পূরণ করতে পারে না। সে বই মানবসমাজে সভ্যতার ফলন ঘটাতে পারে না। পারে না মানবহৃদয়কে আলোকিত করতে নিখুঁত জ্ঞানের আলোয়।
বইয়ের সাথে ইলমে অহির সম্পর্ক হলো দেহ ও আত্মার ন্যায়। দুই মলাটের ভেতরে লিখিত পান্ডুলিপিকে যদি দেহ বলি, তার আত্মা বা প্রাণ হলো ইলমে অহি। অতএব যে বইয়ে অহির পরশ আছে, সে বই প্রাণবিশিষ্ট বই। সে বই মানব সমাজে প্রাণের সঞ্চার ঘটাবে। আর যে বই ইলমে অহির আলো থেকে বঞ্চিত, সে বই প্রাণহীন বই। সে বই মানব সমাজে প্রাণের স্পন্দন সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়। মুমূর্ষু মানবতার মৃত্যুকে করে ত্বরান্বিত। প্রতিটি বইই যদি হয় অহির আলোর ধারক, তবেই হবে আমাদের বইমেলা সার্থক। বইমেলা হয়ে উঠবে প্রাণের বইমেলা। বইমেলা হয়ে উঠবে প্রাণ সঞ্চারের বইমেলা।
যেহেতু অহির শিক্ষা ও অহি সমর্থিত বিষয়ের কাগুজে কাঠামোই বই। আর অহির আলো বিতরণ ও প্রসারের উৎসবমুখর আয়োজনই বইমেলা। সেই হিসেবে বইয়ের বিষয়বস্তু ও মেলার পরিবেশ যেমন হওয়ার কথা তেমনটা কিন্তু দেখা যায় না। মেলায় প্রদর্শন ও বিক্রয়ের জন্য ওঠা বই এবং মেলার পরিবেশ সিংহভাগই অহির শিক্ষা পরিপন্থি। অহির আলো বঞ্চিত। অশ্লীল কাব্য-উপন্যাস, সমাজ বিধ্বংসী বিষয়বস্তু ও খোদাদ্রোহিতার প্রতি উস্কানি সম্বলিত বিষয়াবলিও বইয়ের মোড়কে উপাস্থাপিত হচ্ছে মানুষের সামনে। উচ্ছৃঙ্খল যুবক-যুবতিদের অবাধ মেলামেশা, নারী দেহের অশ্লীল প্রদর্শনী, অবৈধ প্রেম নিবেদন ও গান-বাদ্যের ব্যবহার মেলার গাম্ভীর্যপূর্ণ সুন্দর পরিবেশ বিনষ্ট করছে।
আমি মনে করি, বইমেলায় ধর্মীয় বইয়ের স্টল বরাদ্দ প্রদান এবং দ্বীনদার শ্রেণির মানুষের বেশি উপস্থিতি মেলাকে এসব পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত করবে। প্রকৃত বইমেলায় পরিণত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। বইপ্রেমীদের আকৃষ্ট করার জন্য বইই যথেষ্ট। অন্য কোনো চাকচিক্যের প্রয়োজন নেই। অন্য চাকচিক্যের জন্য যারা মেলায় যায়, তারা না বইয়ের পাঠক, না ক্রেতা। তারা কেবলই চাকচিক্য উপভোগ করতে যায় মেলায়। অতএব, কর্তৃপক্ষের উচিত নিছক বস্তুবাদিতা ও পুঁজিবাদি মানসিকতা থেকে বের হয়ে আধ্যাত্মিকতা ও ঐশী নির্দেশের প্রতি মনোযোগী হওয়া।
পরিশেষে বলবো, বই কিনুন। বই সংগ্রহ করুন। ছোট্ট পরিসরে হলেও বইয়ের একটি নিজস্ব সংগ্রহশালা গড়ে তুলুন। নিজের জন্য। নিজেদের নতুন প্রজন্মের জন্য। আগামী প্রজন্মের জন্য। আপনার মরণোত্তর রেখে যাওয়া সম্পদের মধ্যে বইও যেন একটি সম্পদ হিসেবে থাকে। পরবর্তী প্রজন্ম যা উত্তরাধিকার হিসেবে পাবে। অনুজদের জন্য অগ্রজদের পক্ষ থেকে এটাই হবে সর্বোত্তম উত্তরাধিকার। আল্লাহ আমাদেরকে তৌফিক দান করুন।
লেখকের মেইল : [email protected]