জলবায়ুর প্রভাবে ঢাকায় দ্রুততর হচ্ছে মশার জীবনচক্র

কৃষিবিদ সৈয়দা বদরুন নেসা
প্রকাশ: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৬:৫০
-67ab2cd029338.jpg)
ঢাকা শহরে মশার উপদ্রব একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এটি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বিশেষত ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও ম্যালেরিয়ার প্রকোপ জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। নগরায়ণের বিশৃঙ্খল ও অপর্যাপ্ত স্যানিটেশন ব্যবস্থা, জলাবদ্ধতা, আবর্জনার অনিয়ন্ত্রিত স্তূপ, সর্বোপরি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব— সবকিছু একসঙ্গে মিলে মশার বংশবৃদ্ধির আদর্শ পরিবেশ তৈরি করেছে। তবে এই সংকটের কার্যকর ও টেকসই সমাধান সম্ভব, যদি বিজ্ঞানভিত্তিক নীতিমালা, নগর ব্যবস্থাপনার উন্নতি ও জনসচেতনতার মধ্যে সঠিক সমন্বয় করা হয়।
জলবায়ু পরিবর্তন মশার জীবনচক্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে মশার জীবনচক্র দ্রুততর হচ্ছে। অনিয়মিত ও অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে শহরে জলাবদ্ধতা বাড়ছে, যা এডিস ও কিউলেক্স মশার বংশবৃদ্ধির জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি করছে। অতিরিক্ত আর্দ্রতা ও তাপ মশার ডিম ফুটে ওঠার হার বাড়িয়ে দিচ্ছে।
মশার বংশবিস্তার তাপমাত্রার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। বিশেষ করে, এডিস মশার ক্ষেত্রে ১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে থ্রেশহোল্ড লেভেল ধরা হয়। তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে এডিস মশার মেটাবলিক কার্যক্রম সফল ও দ্রুততার সাথে হতে থাকে। যার ফলে তাদের মিলিত হওয়ার ফ্রিকোয়েন্সি যেমন বেড়ে যায়, তেমনি ডিম পাড়ার হারও বৃদ্ধি পায়।
তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এডিস মশার বিপাকীয় কার্যক্রম দ্রুততর হয়। যার ফলে এদের প্রজনন হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। গরম ও আর্দ্র আবহাওয়ায় মশার ডিম ফোটার গতি ত্বরান্বিত হয়। তারা স্বল্প সময়ের মধ্যেই নতুন প্রজন্ম তৈরি করতে সক্ষম হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের ধরন বদলে যাওয়ায় মশার প্রজনন মৌসুম দীর্ঘ হচ্ছে।
শীতের স্থায়িত্ব কমে আসার কারণে মশার কার্যক্রম সারা বছরজুড়ে বজায় থাকছে, যা ডেঙ্গু ও অন্যান্য মশাবাহিত রোগের বিস্তারকে ত্বরান্বিত করছে। আগে শীতকালে মশার প্রকোপ কম থাকলেও এখন বছরের বেশিরভাগ সময়ই মশার উৎপাত দেখা যায়। শুধু তাপমাত্রাই নয়, আর্দ্রতা ও বৃষ্টিপাতের পরিবর্তনও মশার বিস্তারকে প্রভাবিত করছে। বেশি তাপমাত্রা ও উচ্চ আর্দ্রতা মশার জীবনচক্র দ্রুত সম্পন্ন করতে সাহায্য করে, ফলে অল্প সময়ে মশার সংখ্যা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। শহরের অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, জমে থাকা পানি ও খোলা জলাশয় এ সমস্যাকে আরও তীব্র করছে। সুতরাং, জলবায়ু পরিবর্তন মশার বংশবিস্তার ও মশাবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাবে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলছে।
নগর ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা ও অপরিকল্পিত অবকাঠামো ঢাকায় মশা বৃদ্ধির আরেকটি বড় কারণ নগর ব্যবস্থাপনার ত্রুটি। ঢাকার মোট ভূমির মাত্র ২০-৩০ শতাংশ অংশ নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা হয়, অথচ বাকি ৭০-৮০ শতাংশ এলাকা যেমন ড্রেন, জলাশয়, খালি জায়গা, সরকারি-বেসরকারি ভবনের পেছনের অংশে ময়লা ও জমে থাকা পানির প্রতি যথাযথ নজর দেওয়া হয় না। বিশেষত, ঢাকার খাল ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা একেবারেই নাজুক অবস্থায় রয়েছে। খাল ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার সঠিক সংস্কার না হওয়ায় পানি জমে মশার লার্ভা বৃদ্ধির সুযোগ পাচ্ছে। খালগুলোর তলদেশে পর্যাপ্ত ঢাল (স্লোপ) না থাকায় পানি সঠিকভাবে প্রবাহিত হয় না, ফলে সেখানে মশার বংশবৃদ্ধি হয়। অধিকাংশ খাল দখল হয়ে যাওয়ায় জলাবদ্ধতা দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে, যা মশার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে।
এ সমস্যা সমাধানে নগর কর্তৃপক্ষকে অবিলম্বে খালগুলোর সংস্কার করতে হবে এবং খালের তলদেশে পর্যাপ্ত ঢাল নিশ্চিত করতে হবে, যাতে পানি দ্রুত প্রবাহিত হয় ও মশার জন্মস্থান নষ্ট হয়। প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ ও সরকারি পরিকল্পনা ভীষণ প্রয়োজন। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মশা নিয়ন্ত্রণে নানা কর্মসূচি হাতে নিলেও কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ। শুধুমাত্র কীটনাশক ছিটিয়ে বা ধোঁয়া প্রয়োগ করে মশা দমন সম্ভব নয়, কারণ ব্যবহৃত কীটনাশকের প্রতি মশার প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যাচ্ছে, ফলে এটি কার্যকর থাকছে না। শুধু উড়ন্ত মশা নিধন করলেই হবে না, লার্ভা ধ্বংস না করলে মশার সংখ্যা কমবে না।
নিয়মিত জরিপ ও গবেষণা চালিয়ে কোথায় কী ধরনের মশার আধিক্য রয়েছে তা চিহ্নিত করতে হবে। সঠিক কীটনাশক ও প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে, যাতে এটি পরিবেশবান্ধব ও কার্যকর হয়। এছাড়া, সরকারি সংস্থাগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক বেস্ট প্র্যাকটিস অনুসরণ করতে হবে, যেখানে ড্রোন প্রযুক্তি ব্যবহার করে জলাবদ্ধ এলাকা চিহ্নিত করা ও কীটনাশক প্রয়োগ করা হবে। সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে নিজস্ব ভবন ও আশপাশ পরিষ্কার রাখতে আইনি বাধ্যবাধকতা থাকবে। বাজার ও শিল্পাঞ্চলগুলোর ড্রেনেজ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কঠোরভাবে মনিটরিং করা হবে।
বর্তমানে সামাজিক গণমাধ্যমে নানা ধরনের মশা নিধনের পদ্ধতি প্রচারিত হয়, যেমন—লেবু ও লবঙ্গের মিশ্রণ, বিভিন্ন প্রাকৃতিক তেল, আল্ট্রাসনিক মশা তাড়ানোর যন্ত্র। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, এসব পদ্ধতির কার্যকারিতা খুবই সীমিত এবং সর্বোচ্চ ৫% মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর হতে পারে। তাই, কেবল সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত তথ্যের ওপর নির্ভর না করে বাস্তবসম্মত ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করা দরকার। মশা নিয়ন্ত্রণের টেকসই সমাধানের জন্য বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত কয়েকটি উপায় গ্রহণ করা যেতে পারে—জৈবিক নিয়ন্ত্রণ এর মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করে মশার লার্ভা ধ্বংস করা, যা পরিবেশবান্ধব ও দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর। জেনেটিক মডিফিকেশন প্রয়োজন যেমন কিছু দেশে পরীক্ষামূলকভাবে বিশেষ ধরনের পুরুষ মশা ছাড়া হয়েছে, যা স্ত্রী মশার সঙ্গে মিলিত হয়ে তাদের ডিম নিষ্ক্রিয় করে ফেলে।
পরিবেশবান্ধব কীটনাশকের ব্যবহার করতে হবে। যেমন রাসায়নিক কীটনাশকের বিকল্প হিসেবে জৈবিক কীটনাশক ও ব্যাকটেরিয়া প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে। সঠিক ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও খাল সংস্কার করতে হবে। এ ক্ষেত্রে শহরের সকল ড্রেন নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে। খালগুলোর তলদেশে পর্যাপ্ত ঢাল থাকতে হবে, যাতে পানি দ্রুত প্রবাহিত হয় ও সেখানে মশার জন্ম না নেয়। জলাবদ্ধতা রোধে নালা-ড্রেন পরিষ্কার ও সচল রাখতে হবে।
ঢাকায় মশার প্রকোপ একটি জটিল সমস্যা, যার পেছনে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন, নগর ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা, অপরিকল্পিত অবকাঠামো ও জনসচেতনতার অভাব। শুধুমাত্র কীটনাশক প্রয়োগ করে মশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এজন্য বৈজ্ঞানিক গবেষণা, সঠিক নগর পরিকল্পনা ও কার্যকর জনসচেতনতা দরকার। টেকসই সমাধানের জন্য নিয়মিত গবেষণা, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার, সিটি হাউজ কিপিং-এর কার্যকর বাস্তবায়ন, খাল ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন অপরিহার্য। শুধুমাত্র সরকার নয়, নাগরিক, প্রতিষ্ঠান, গবেষক ও পরিবেশবিদদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ই মশার প্রকোপ কমানো সম্ভব।
লেখক : শিক্ষক ও গবেষক
- বাংলাদেশের খবরের মতামত বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- [email protected]