
‘এখানে রমনীগুলো নদীর মতন, নদীও নারীর মত কথা কয়’—নদীর কোন রূপ দেখে গীতিকবি আবু জাফর কথাগুলো লিপিবদ্ধ করেছিলেন, জানি না। তবে নদীগুলো যে এখন নারীর মত কথা বলার অবস্থায় নেই, তা আমরা সবাই জানি। বলছি করতোয়া নদীর কথা। কথা বলা দূরে থাকুক, খননের মাধ্যমে বর্তমানে করতোয়াকে লাইফ সাপোর্টে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। জানি না, মৃত্যুপথযাত্রী করতোয়াকে কতদিন এভাবে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে।
উত্তর জনপদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নদী করতোয়া। পঞ্চগড় থেকে শুরু করে দিনাজপুর, রংপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ ও পাবনা জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে নদীটির বিস্তার। এই সাতটি জেলার মানুষের কৃষিকাজ, ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থায় নদীটির তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এই এলাকায় উদ্ভিদ, প্রাণী, পাখিসহ প্রাণ-প্রতিবেশ ব্যবস্থা এবং ভূপৃষ্ঠস্থ ও ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে নদীটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই করতোয়ার প্রবাহ এক অর্থে এই এলাকার প্রাণপ্রবাহ। করতোয়াকে বাঁচিয়ে রাখা আমাদের প্রাণকে বাঁচিয়ে রাখার সমার্থক।
করতোয়া একটি আন্তঃসীমান্ত তথা আন্তর্জাতিক নদী। এর বর্তমান উৎস ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার বৈকুণ্ঠপুরে (মাহবুব সিদ্দিকী, ২০২১)। ১৭৮৭ সালে তিস্তার মহাপ্লাবনের পরে নদীটি আদি উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বর্তমান পথে প্রবাহিত হচ্ছে। জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের তথ্য অনুসারে আংশিক বিচ্ছিন্ন অবস্থায় বর্তমানে করতোয়ার তিনটি ধারা রয়েছে। প্রথম ধারাটি পঞ্চগড়-দিনাজপুর করতোয়া নামে পঞ্চগড়-দিনাজপুর জেলার ১১ উপজেলার ১৮৭ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত। দ্বিতীয় ধারাটি রংপুর-বগুড়া করতোয়া নামে রংপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জ জেলার ১৩টি উপজেলার ১২৩ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে প্রবাহিত। তৃতীয় ধারাটি পাবনা করতোয়া নামে পাবনা জেলার চাটমোহর থানার ৫.২৫ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত। জলপ্রবাহের পরিমাণের দিক থেকে তিস্তার তুলনীয় না হলেও একক নদী হিসেবে করতোয়ার পঞ্চগড়-দিনাজপুর অংশ এবং রংপুর-বগুড়া অংশ দুটিই তিস্তার তুলনায় (তিস্তার দৈর্ঘ্য ১১৩ কিলোমিটার) দীর্ঘ। আবার তিনটি ধারার সমন্বিত দৈর্ঘ্যের বিবেচনায় করতোয়াকে বাংলাদেশের তৃতীয় দীর্ঘতম নদী বলা যায়। যদিও নদী কমিশনের সূত্র অনুসারে বাংলাদেশের প্রধান তিনটি দীর্ঘতম নদী যথাক্রমে—পদ্মা (৩৪১ কি.মি.), ইছামতি (ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, সাতক্ষীরা) ৩৩৪ কি.মি. ও সাঙ্গু (২৯৪ কি.মি.) নদী। একক বিচ্ছিন্ন ধারার বিবেচনায় বলি আর সমন্বিত ধারার বিবেচনাতেই বলা হোক না কেন, যে কোনো বিবেচনাতেই করতোয়া উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নদী। কিন্তু আন্তঃসীমান্ত নদীর পানি বণ্টনের ক্ষেত্রে করতোয়ার নাম কখনোই উচ্চারিত হতে শোনা যায় না। এর ফলে উজানের ভারতীয় অংশে বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ ও করতোয়া থেকে পানি প্রত্যাহারের বিষয়টি নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হচ্ছে। করতোয়ার মুমূর্ষু দশার এটি অন্যতম কারণ। তাই আন্তঃসীমান্ত নদীর পানি বণ্টন তথা পানি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অবিলম্বে করতোয়া নদীর নাম উত্থাপন হওয়া দরকার বলে আমরা মনে করি।
করতোয়া নদীর মুমূর্ষু দশার দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে দখল-দূষণ ও সরকারি সংস্থাগুলোর উদাসীনতা। করতোয়ার দখল-দূষণ শুরু হয়েছে মূলত নদী কমিশন উল্লেখিত করতোয়ার দ্বিতীয় (রংপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ) অংশে। দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট পৌরসভা, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ পৌরসভা এবং বগুড়ার শিবগঞ্জ পৌরসভার বিভিন্ন অংশে নদীটির দখল শুরু হলেও দখল এবং দূষণ দুটিই প্রকট আকার ধারণ করেছে বগুড়ার মহাস্থানগড় থেকে শেরপুর পর্যন্ত অংশে। এই অংশে শহরের বাসাবাড়ি ও শিল্প কারখানার তরল বর্জ্য এবং কাঁচাবাজারের কঠিন, তরল ও পশুবর্জ্যগুলো ড্রেন ও নালার মাধ্যমে নদীকে মারাত্মকভাবে দূষিত করছে। এখানে নদীর পানি কালো রং ধারণ করেছে, নদী থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে এবং নদী মশার প্রজনন ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। আবার একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ও কিছু প্রভাবশালী কর্তৃক অবৈধ দখলের কারণে এ অংশে নদীটি সংকুচিত হয়ে প্রায় মৃত খাতে পরিণত হয়েছে। নদীতে প্রবাহ নেই বললেই চলে।
এই অবস্থার নিরসনকল্পে কতিপয় সচেতন নাগরিক কর্তৃক ২০১২ সালে প্রথম ‘করতোয়া বাঁচাও আন্দোলন’ শুরু হয়। ২০১৫ সালে পরিবেশ আইনবিদ সমিতি কর্তৃক উচ্চ আদালতে রিট করা হলে আদালত করতোয়া নদীকে অবৈধ দখলমুক্ত করতে জেলা প্রশাসককে নির্দেশ প্রদান করে। পরবর্তীতে অজ্ঞাত কারণে প্রক্রিয়াটি স্তিমিত হয়ে যায়। ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের প্রেক্ষিতে ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ নদী দখলদারদের তালিকা সরকারি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হলে করতোয়া বাঁচাও আন্দোলন আবার গতি পায়। এর ধারাবাহিকতায় সাত দিন সময় বেঁধে দিয়ে নদীর সীমানা থেকে দখলদারদের স্থাপনা সরিয়ে নিতে উচ্ছেদ নোটিশ পাঠানো হয়। কিন্তু দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও করতোয়ার ৩৮টি স্থানে চিহ্নিত ৩০ অবৈধ দখলদারের কাছ থেকে নদীর কতটুকু অংশ অবমুক্ত করা গিয়েছে অথবা বিষয়টি কী অবস্থায় রয়েছে, সেটি আর জানা যায় না। এমতাবস্থায় অবৈধ দখল-দূষণের বিষয়টি কার্যত অমীমাংসিত রেখে এবং নদীর সীমানা নির্দিষ্ট না করে মৃতপ্রায় করতোয়ার প্রাণ ফেরাতে এ বছর করতোয়ার বগুড়া প্রান্তে ১৭ কিলোমিটার জুড়ে খনন কাজ শুরু হয়েছে, যা সমস্যা জিইয়ে রেখে মৃত্যু পথযাত্রী নদীকে কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াস মাত্র।
করতোয়া নদীর প্রাণপ্রবাহ ফিরিয়ে আনতে হলে নদীর সীমানা নির্দিষ্ট করতে হবে। দখলদারদের চিহ্নিত করতে হবে। যে কোনো মূল্যে দখলদারদের উচ্ছেদ করতে হবে। নদীতে কঠিন ও তরল বর্জ্য নির্গমন ও নিক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। সর্বোপরি খননকৃত মাটি অপসারণ করে স্থায়ীভাবে নদীর পাড় সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
এই কার্যক্রমগুলো যথাযথভাবে করতে না পারলে করতোয়া বাঁচানোর যে কোনো প্রয়াস বিফলে পর্যবসিত হবে। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে দেশে যখন সংস্কারের সুবাতাস বইছে, তখন প্রভাবশালী অবৈধ দখলদার ও দুষ্ট রাজনীতিবিদদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে মুমূর্ষুপ্রায় করতোয়া নদীতে প্রাণপ্রবাহ ফিরিয়ে আনার এখনই উপযুক্ত সময়।
অধ্যাপক মো. আব্দুল হাই : ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, সরকারি আজিজুল হক কলেজ, বগুড়া
- বাংলাদেশের খবরের মতামত বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- [email protected]
এমএইচএস