
নানা সমীকরণে বাংলাদেশের রাজনীতি। সমীকরণটি বড্ড জটিল। প্রকৃতপক্ষে ৫ই অগাস্টের পর থেকে দেশের শাসনভার কার হাতে, সেটি মোটেও স্পষ্ট নয়। সাধারণ জনগণ তো নয়ই, রাজনীতির বিশ্লেষকেরাও এ নিয়ে দারুণ ধাঁধায় আছেন। শুধু একটি বিষয় স্পষ্ট, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কয়েকজন সমন্বয়ক যা চাচ্ছেন, সেভাবেই সবকিছু বাস্তবায়িত হচ্ছে। কেউ বলছেন, জামাতে ইসলামের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে দেশ শাসন করছে অন্তর্বর্তী সরকার। পেছন থেকে শক্তি জোগাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যদিও এসব মন্তব্যের পেছনে কোন দালিলিক প্রমাণ নেই। আর যেসব রাজনৈতিক শক্তি হাসিনা সরকারের পতনের প্রত্যাশায় ছিল, বাহ্যিক ভাবে তারা কিছুটা লাভবান হলেও সরকারের নীতি নির্ধারণে তাঁদের হস্তক্ষেপ অতি সামান্যই কার্যকর।
তাছাড়া সরকারের গৃহীত কর্মসূচি ও পদক্ষেপসমূহ অতীতের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারগুলো থেকে পুরোপুরি ব্যতিক্রম। সাধারণভাবে অন্তর্বর্তীকালীন বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার রুটিন কর্মকাণ্ডের বাইরে, একটি গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মূল লক্ষ্যে তাদের পদক্ষেপকে সীমিত রাখেন। এবারের সরকার যে সমস্ত সংস্কার কার্যক্রম কে সামনে রেখে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে কোনোভাবেই এই সরকারকে একটি অন্তর্বর্তীকালীন রুটিন সরকারের মত বিবেচনার সুযোগ নেই।
সংবিধান থেকে শুরু করে জনপ্রশাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নির্বাচন কমিশনসহ মৌলিক সংস্কারের ঘোষণাগুলো একটি বৈপ্লবিক অবস্থার ইঙ্গিত দেয়। ইতিমধ্যে বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন পাবলিক সার্ভিস কমিশন, নির্বাচন কমিশনসহ অপরাপর সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সমূহে পরিবর্তনের প্রক্রিয়াটি একটি বিপ্লবী সরকারের যৌক্তিকতাকেই সামনে নিয়ে আসে। এমন পরিস্থিতিতে, দেশের সর্বপ্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ কি চরম দুঃসময়কে অতিক্রম করে, স্বাভাবিক রাজনীতিতে ফিরে আসতে পারবে?
ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে রাজনীতি করে এগিয়ে যাওয়া দল আওয়ামী লীগ। তবুও দলটি এখন চরম অস্তিত্ব সংকটে। এমন পরিণতিতে উপনীত হওয়ার কারণ অনুসন্ধান না করে, রাজনীতির মাঠ দখলে নেওয়ার পরিকল্পনাটি কাল্পনিক। কেউ কেউ বলছেন নানামুখী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার আওয়ামী লীগ। যদি ধরে নেই ঘটনাটি সত্যি, তবে গণভবনমূখী জনতার জোয়ার ঠেকাতে আওয়ামী লীগ ব্যর্থ হলো কেন? কেন ষড়যন্ত্রকারীদের বিপরীতে দলের নেতৃত্বে প্রতিরোধ গড়ে উঠেনি।
অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে দীর্ঘতম সময়ে দেশ শাসনের পরও কেন শেখ হাসিনাকে দেশান্তরী হতে হলো? কেনো আওয়ামী লীগের নেতা, কর্মী, সমর্থকদের আজ পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। উত্তর একটাই, পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল বানিয়েও আওয়ামী লীগ জনতার মন জয়ে ব্যর্থ হয়েছে। আদর্শবান নেতাকর্মী দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। দুর্নীতিবাজ সুবিধাভোগীরা শাসন ক্ষমতা কে ব্যবহার করে লুটপাটের মাধ্যমে জনসম্পদকে কুক্ষিগত করেছে।
সরকার প্রধান তার আচার-আচরণের মাধ্যমে সামন্ত প্রভুদের মতো ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে জনগণ ভোট দিতে পারেনি। সরকার প্রধান কথায় কথায় বলতেন, জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে তার সরকার ক্ষমতায়। অসহায় জনতা মুখ ফুটে প্রতিবাদ করতে না পারলেও, বছরের পর বছর হৃদয়ে ঘৃনাকে লালন করেছে। যার মেম্বার হওয়ার ক্ষমতা নেই, তিনি এমপি হয়ে যান। যার ডাকে ৫০ জন মানুষ রাস্তায় বেরোবে না, এমন মানুষ মন্ত্রী হয়ে যান। রাজপথের কোন ইতিহাস নেই, এমন লোক দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য হয়ে যান।
রাজধানী থেকে তৃণমূল, রাজপথ থেকে গণভবন সর্বত্রই স্বৈরতান্ত্রিক দুর্বৃত্তায়নের এক দুষ্ট চক্র গড়ে উঠেছিল। যে চক্রের হাতে রাজনীতি অর্থনীতি, প্রশাসন, সবকিছুই জিম্মি ছিল। এমন পরিস্থিতিতে ৫ই আগস্টের উত্তাল তরঙ্গ, পর্বত শৃঙ্গের মতো দাঁড়িয়ে থাকা একটি দলকে সমতল ভূমিতে পরিণত করে দেয়? গত পনেরো বছরে আওয়ামী লীগে সুবিধাবাদী আর দুর্বৃত্তরা যে প্রাচীর তৈরি করেছিল, সে প্রাচীর কোনভাবেই আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক অর্জনের সঙ্গে মানানসই ছিল না।
পেশাজীবী, লেখক, বুদ্ধিজীবীদের সরিয়ে দিয়ে দুর্নীতিবাজ তোষণকারীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছিল দলটি। বরেণ্য অর্থনীতিবিদদের নাজেহাল করে অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ তুলে দেয়া হয়েছিল অসৎ আর লুটেরা ব্যবসায়ীদের হাতে। টিকেট পেলেই এমপি! সেই নীতির আলোকে আদর্শহীন অর্থ বিত্তের মালিকেরা সংসদের কর্তৃত্ব নিয়েছে। আমলারা জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে দুর্নীতি আর লুটপাটের এক অন্ধকার সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল। তৈলবাজদের সমীহনীতির প্রতিফলন হিসেবে শুধু বঙ্গবন্ধু আর শেখ হাসিনা নয়, ‘শেখ’ লেখা মার্বেল পাথরে গ্রাম থেকে শহর ছেয়ে গিয়েছিল।
ভোটের বালাই নেই! সরকার প্রধানের গণতন্ত্রের মানসকন্যা উপাধি, জনগণ ভালো চোখে দেখেনি। ত্যাগী, আদর্শবান নেতা-কর্মীদের বাদ দিয়ে ইয়াবা বদি, সোনা আনার, স্মাগলার পিপলুর মতো লুটেরাদেরসহ আর্টিস্ট, সুরেলা-সুকণ্ঠী, গায়ক নায়কদের সমাহারে ভরে উঠেছিল সংসদ। রাজনীতিবিদদের রাজনীতি থেকে বিতাড়িত করার অশুভ পাঁয়তারা সফলে দলীয় প্রধানের নীরব সম্মতি ছিল আত্মঘাতী।
স্বৈরতান্ত্রিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের সামন্তবাদী আচরণ, সুবিধাবাদী হাইব্রিড ছাড়া তৃণমূল থেকে রাজধানী অবধি সকল স্তরের নেতাকর্মীদের চরমভাবে ক্ষুব্ধ করেছিল। চলমান পরিণতির প্রত্যাশা না করলেও, দলের একটি বড় অংশ মনেপ্রাণে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা কেন্দ্রের বাহিরে থাকাকেই নিরাপদ মনে করেছিল। সুজাতা সিংহের আগমন থেকে শুরু করে ২০২৪ অবধি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভাগ্য নিয়ে ভারতীয় ছলাকলায় গ্রাম-গঞ্জের সাধারণ মানুষও ভারত বিরোধী হয়ে উঠেছিল।
দলীয় পদ পদবি, নমিনেশন বাণিজ্য, সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদায়নে স্বজনপ্রীতি আর টাকার খেলার মতো মরণ নেশায় মেতে উঠেছিল আওয়ামী লীগ। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বাণিজ্যের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল লন্ডন। সমালোচনা করলেই রাষ্ট্রদ্রোহিতা আর গুম খুনের হুমকি! বোনের আবদার রক্ষায় রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের মতো জাতীয় সিদ্ধান্ত, তিনশ আসনের জাতীয় সংসদে তেতাল্লিশ জন পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ, এমন তুঘলকি কারবার পৃথিবীর কোন দেশে আছে?
এইচটি ইমামের দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে আমলা নির্ভর গণতন্ত্রে জনগণ শুধু বিক্ষুব্ধ হয়নি, বঞ্চিতও হয়েছে। এতে শুধু সাধারণ জনগণ নয়, দলের নিবেদিত প্রাণ আদর্শিক নেতাকর্মীরাও বিষয়গুলোকে ভালোভাবে নেননি। পদ্মাসেতু মেট্রো রেলের মতো বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প যে গণতন্ত্রের বিকল্প নয়, সেটি নিয়ে ভাবনার অবকাশ আওয়ামী লীগ পায়নি।
গণভবন থেকে উপজেলার শীর্ষ পদে বসা মানুষগুলো বুঝতে না পারলেও, তৃণমূলের আদর্শিক নেতাকর্মীরা বুঝতে পেরেছিলেন, দুর্দিন বেশি দূরে নয়। কেউ তাদের আহাজারির মূল্য দেয়নি। এমপি মন্ত্রীদের অনেকেই কারাগারে। আজ রাতে বাথরুমের ছাদে, কাল গোয়াল ঘরে! এভাবেই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন দলের নেতাকর্মীরা। শীর্ষ নেতৃত্ব দেশ ছাড়া, আর তার আত্মীয়স্বজন নিরাপদে দেশ পলাতক।
মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে ভূলুণ্ঠিত করার দায় কার? আদর্শিক বিরোধীরা সুযোগ নেবেন, সেটি তো অপ্রত্যাশিত নয়। একটি সরকারের বিরুদ্ধে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রও নতুন কিছু নয়। সফলতার দাবিদার, ইতিহাসের দীর্ঘতম একটি সরকার পরিস্থিতি অনুধাবন ব্যর্থ হয়েছে। এটি কি অদক্ষতার পরিচয় নয়? আদর্শের কথা বলে রাষ্ট্রকে ঝুঁকিতে ফেলার দায় কি আওয়ামী লীগ এড়াতে পারে? দলটি আজ রাহুগ্রাসে!! বুলডোজারে ক্ষত বিক্ষত স্বাধীনতার স্বপ্ন স্বাদ। এ নিয়ে দেশবাসীর মাথা ব্যথা কতটুকু, দৃশ্যমান পরিস্থিতি তার প্রমাণ। গৌরবের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার অর্জনকে ঝুঁকিতে ফেলার দায়ে আওয়ামী লীগ কি দিশেহারা!!
মো. মাহমুদ হাসান : কলামিস্ট উন্নয়ন গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক
- বাংলাদেশের খবরের মতামত বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- [email protected]
এমএইচএস