-67bc5373b7761.jpg)
আজন্ম স্বাধীন জাতি মুসলমান। একমাত্র আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের হুকুমের অধীনতা ছাড়া কারো বশ্যতা স্বীকার করে না তারা। মুসলিমদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ শ্রেণিটি হচ্ছে ওলামায়ে কেরাম। স্বাধীনতার মন্ত্রে যারা সদা উজ্জীবিত। “مُذْ كَمْ تَعَبَّدْتُمُ النَّاسَ وَقَدْ وَلَدَتْهُمْ أُمَّهَاتُهُمْ أَحْرَارًا؟” “কবে থেকে তোমরা মানুষদের পরাধীন বানালে? অথচ তারা আজন্ম স্বাধীন!” হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর বিখ্যাত এই উক্তি তাদের জন্য স্বাধীনতার তূর্যধ্বনি। আলেমগণ দেশপ্রেমকে মনে করেন ঈমানি কর্তব্য। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, পৃথিবীর সবখানে পরাধীনতার শিকল ভাঙার আন্দোলনে এবং অন্যায় ও জুলুমের প্রতিবাদে আলেমরা ছিলেন অগ্রগামী ও বেশি সক্রিয়। সোচ্চার ছিলেন স্বাধীনতার প্রশ্নে।
ভারতীয় উপমহাদেশের আলেম-ওলামা এবং সচেতন মুসলিমরাও ছিলেন না এর ব্যতিক্রম। বালকোটের যুদ্ধ, সিপাহি বিপ্লব, ইংরেজ খেদাও আন্দোলন, রেশমি রুমাল আন্দোলন, ভারত স্বাধীনতা, পাকিস্তান আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়সহ স্বাধীনতা এবং আদর্শ ও ন্যায়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ যত আন্দোলন হয়েছে, সকল আন্দোলনে ছিল আলেমদের অগ্রণী ভূমিকা। বলিষ্ঠ সমর্থন ও সরব অংশগ্রহণ। শহীদে বালাকোট সাইয়েদ ইসমাঈল শহীদ, শাহ আবদুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলভী, কাসেম নানুতভী, ওবায়দুল্লাহ সিন্ধি, শায়খুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান, হুসাইন আহমাদ মাদানি, আশরাফ আলী থানভী, শাব্বির আহমাদ ওসমানি, শামছুল হক ফরীদপুরী, আল্লামা আতহার আলি প্রমুখ প্রখ্যাত ওলামায়ে কেরাম প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাদের সময়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। পৃষ্ঠপোষণ করেছেন। স্বাধীনতা অর্জন, সার্বভৌম রক্ষা, দেশ ও ধর্মের স্বার্থের বিপরীতে আপোস করেননি কখনো তারা।
অখণ্ড ভারত শাসন করেছে মুসলমানরা। প্রায় হাজার বছর। কেমন ছিল সেই শাসন? ইতিহাস সাক্ষী, মুসলিম শাসনাধীন ভারত ছিল সাম্প্রীতির ভারত। মুসলমান কোনোকালেই সাম্প্রদায়িক ছিল না। হাজার বছর ভারত শাসনকালে মুসলিমরা যদি আজকের ‘দাঙ্গাবাজ’ হিন্দুদের মতো সাম্প্রদায়িক হত, তাহলে ভারতে হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ তো দূরের কথা, সংখ্যালঘুও থাকতো না। অস্তিত্বহীন হয়ে যেত। ভারত হত হিন্দুমুক্ত নিরঙ্কুশ মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্র। কিন্তু দুঃখের বিষয়, হিন্দুদের শাসনক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই বিশ্ব দেখল তাদের উগ্র সাম্প্রদায়িক রূপ। ভিন্ন জাতি গোষ্ঠীকে নির্মূলে তারা হয়ে উঠলো মরিয়া। একচ্ছত্র হিন্দু রাষ্ট্রের স্বপ্নে তারা বিভোর। বৌদ্ধ ধর্মকে ভারত থেকে করলো নির্বাসিত। মুসলমানদের ওপর চলল হামলা, মামলা নির্মূলাভিযান। মূলত এসব উগ্রতা পূর্বেই আঁচ করতে পেরেছিলেন অখণ্ড ভারতের মুসলিম নেতৃবৃন্দ। তাই সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলো নিয়ে পৃথক রাষ্ট্রের আন্দোলন করেছিলেন তারা। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পাকিস্তান।
মোটকথা মুসলিম শাসনের স্মৃতি, ঐতিহ্য ও স্থাপত্য নিদর্শন রয়ে গেছে আজও ভারতের পরতে পরতে। এই উপমহাদেশের প্রতিটি আলেমের কাছে মক্কা-মদিনার পর তৃতীয় কাঙ্খিত জায়গা ভারত। ভারতীয় উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ ইসলামী বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম দেওবন্দ, নদওয়াতুল ওলামা লাখনৌ, মাজাহেরুল উলুম সাহারানপুর হাজারো আলেম তালেবে ইলমের স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান। যেখানে শিক্ষার্থী কিংবা পর্যটক হিসেবে জীবনে একবার হলেও যাওয়ার আকাঙ্খা রাখেন তারা। আকাবির ওলামায়ে কেরাম কবরস্থ হয়েছেন ভারতের মাটিতে। তাদের রূহানী ফয়েজ গ্রহণের তামান্না আছে অনেকের মনে। যেতে পারেন না ভিনদেশ হওয়ার কারণে। আগ্রার তাজমহল, কুতুবমিনার দেখতে কার মনে না চায়! বাংলাদেশ ভারতের অঙ্গরাজ্য হয়ে গেলে, অনায়াসেই আলেমদের এসব সাধ, স্বপ্ন, আকাঙ্খা পূরণ হতে পারে। সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশকে ভারতের অঙ্গরাজ্য বানানোর ভারতীয় ষড়যন্ত্র ও বিভিন্ন পদক্ষেপে সবচেয়ে বেশি খুশি হওয়ার কথা আলেমদের।
অথচ ভারতের সাথে নতজানু পররাষ্ট্রনীতির সবচে বড় সমালোচক এদেশের ওলামায়ে কেরাম। ভারতকে একচেটিয়া সুযোগ-সুবিধা প্রদান কিংবা বাংলাদেশকে ভারতের করদরাজ্য বানানোর সর্বাত্মক বিরোধী ওলামায়ে কেরাম। দেশীয় এজেন্ট ও বিদেশি প্রভুর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে সরব ওলমায়ে কেরাম। ভারতের মিডিয়া ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জনগণকে সোচ্চার করার ভূমিকায় অগ্রগামী ওলামায়ে কেরাম। এগুলো ওলামায়ে কেরামের স্বাধীনচেতা, দেশাত্মবোধ ও দেশপ্রেমের পরিচায়ক। ওলামায়ে কেরাম সবসময় যে নীতি অবলম্বন করে চলেন, তা হলো- ‘আদর্শহীনতার কারণে যার সাথে শত্রুতা, স্বার্থের কারণে তার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়াব না।’ [ওয়ালা ও বারা’র নীতি{إِنَّ الَّذِيْ مَدَّ رِجْلَهٗ لَا يَمُدُّ يَدَهٗ} অর্থাৎ আদর্শ বিসর্জন দিয়ে কোনো বন্ধুত্ব নয়।]
অনেক ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা। এর সার্বভৌমত্ব নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়েছে অনেক। প্রকাশ্যে বা আড়ালে ঘটেছে অনেক ঘটনা। এসব ব্যাপারে আলেমরা সর্বদাই সজাগ ছিলেন। জনগণকে জাগানোর চেষ্টাও করছেন আগে থেকেই। আলেমরা হুজুগে নয়। এদেশের সচেতন নাগরিক। সাচ্চা দেশপ্রেমিক। ইতিহাস প্রমাণ করে, ‘যাদের মধ্যে ধর্মীয় মূল্যবোধ যত বেশি, তাদের দেশপ্রেম তত খাটি। আর যাদের কাছে ধর্ম গুরুত্বহীন, তাদের দেশপ্রেম চরম ভাঁওতাবাজি।’ এদেশের হুজুগে দেশপ্রেমিকরা শুধু পাকিস্তানের প্রতি ঘৃণা প্রকাশের মধ্যেই নিজেদের দেশপ্রেম সীমাবদ্ধ করে রেখেছে। অথচ প্রকৃত দেশপ্রেমিক তো তারাই, ক্ষমতার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে দেশের প্রশ্নে, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে সর্বদাই আপোসহীন যারা। অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী। অকুতোভয়। শোষকদের মধ্যে শ্রেণিবিভাগ করে না যারা। শোষক হিসেবে সকল শোষকই সমান যাদের দৃষ্টিতে। চাই সেই শোষক পাকিস্তান হোক বা বৃটেন কিংবা ভারত।
স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন। অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা। ১৯৪৭ এর পর থেকে অখণ্ড পাকিস্তান ও ১৯৭১ থেকে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ ভারতীয় ষড়যন্ত্রের অক্টোপাস থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি কখনো। ষড়যন্ত্র, অপপ্রচার, মিথ্যাচার ও বিকৃত ইতিহাসের বেড়াজালে থাকায় জাতির চিন্তার স্বাধীনতা, মানসিক উন্নয়ন, আত্মমর্যাদাবোধ এবং দেশ ও মানবতার স্বার্থে জাতীয় ঐক্য আজও সম্ভব হয়নি। এইজন্য আমরা এখনো ‘হতভাগা বাঙালি’ হয়ে আছি। মনে রাখতে হবে, সাম্রাজ্যবাদী ভারতের রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের অক্টোপাস থেকে মুক্ত হতে না পারলে, এদেশের গণমানুষ কখনোই পাবে না প্রকৃত স্বাধীনতার সুফল।
‘স্বাধীনতা কাকে বলে বলতে পারো তুমি? স্বাধীনতা নয়তো শুধু এক খণ্ড ভূমি।’ স্বাধীনতার মানে, স্বাধীনতার উদ্দেশ্য, স্বাধীনতার প্রাপ্তি নিয়ে ভাবতে হবে আমাদের। ৭১-এর পর থেকে আমরা যে হালে কাটিয়েছি অর্ধ শতাব্দী, এটাই যদি স্বাধীনতা হয়, তাহলে পরাধীনতার সংজ্ঞা কী? অখণ্ড ভারতে কিংবা পাকিস্তানের অধীনে কি আমরা এরচেয়েও খারাপ অবস্থায় ছিলাম? ইতিহাসের তুলনামূলক পুনর্পাঠ আজ খুব জরুরি। কবির ভাষায় বলতে চাই,
‘যদি আমার দেশের সীমানা বন্ধু কেড়ে নিতে কেউ চায়,
যদি আমার দেশের ধন-সম্পদ লুটে নিতে কেউ চায়,
যদি আমার সাগরে আমার পাহাড়ে ফেরায় লোভের চোখ,
আমি প্রতিবাদে ফেটে পড়বোই, তাতে যা হবার তাই হোক’
- বাংলাদেশের খবরের মতামত বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- [email protected]
বিএইচ/