একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে বিবাদ বাড়ছে। মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যা বাড়ায় ক্ষমতাসীন দলে প্রকাশ্য হচ্ছে অভ্যন্তরীণ কোন্দলও। দেশজুড়ে শতাধিক সংসদীয় আসনে দলটির শত্রু ও প্রতিপক্ষ এখন আওয়ামী লীগ নিজেই। অভ্যন্তরীণ কোন্দল মেটাতে গত দুই বছর ধরে কেন্দ্রীয় নেতারা উদ্যোগ নিলেও তেমন সুফল পাওয়া যায়নি।
সম্ভাব্য প্রার্থীদের অনেকে দলের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে ঘায়েল করতে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়ে রাজনীতির মাঠ গরম করছেন। সরকারের উন্নয়ন তুলে না ধরে কেউ দলের নেতা ও সংসদ সদস্যের সমালোচনা করলে তাকে মনোনয়ন দেওয়া হবে না বলে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হুশিয়ারি আছে। তবুও থামছে না কোন্দল। দলের ভেতরের দ্বন্দ্ব-সংঘাতে অস্বস্তিতে ক্ষমতাসীন দল।
মনোনয়ন নিয়ে দুই পক্ষের সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও খুনোখুনি হচ্ছে। নেতাকর্মীরা বিভিন্ন স্থানে প্রকাশ্যে সংঘাত-সংঘর্ষেও জড়িয়ে পড়ছে। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ-১, কুমিল্লা-১, নেত্রকোনা-৫, পটুয়াখালী-১, রংপুর-৫, শেরপুর-২, ফরিদপুর-৪, চুয়াডাঙ্গা-২ ও কুষ্টিয়া-৪ সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী কয়েক নেতার সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় দল বিব্রত।
গত ১০ সেপ্টেম্বর বরিশাল-৪ আসনের সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ এনে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সংবাদ সম্মেলন, ১০ অক্টোবর পাবনার চাটমোহরে মনোনয়নপ্রত্যাশী ১০ জনের আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী আরেক নেতার বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন, ২৩ সেপ্টেম্বর যশোর-৪ আসনের সংসদ সদস্য রণজিত কুমার রায়ের বিরুদ্ধে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী অন্য নেতার সমর্থকদের ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন দলের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েক নেতাকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। তাদের শঙ্কা, জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত এমন অবস্থা চলতে থাকলে কয়েকটি আসনে দলীয় মনোনয়নপ্রাপ্তরা আগামী নির্বাচনে বেকায়দায় পড়তে পারেন।
আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘আমাদের পার্লামেন্টারি বোর্ডের কাছে সারা দেশের তৃণমূল পর্যায়ের প্রতিবেদন এসেছে। জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করব। দলীয় মনোনয়ন নিয়ে তৃণমূলের নেতাদের কাছ থেকে তাদের পরামর্শ চাওয়া হবে। তৃণমূলের পরামর্শ আর দলের জরিপ সমন্বয় করে মনোনয়ন বোর্ড একজনকে মনোনয়ন দেবে।’
দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সূত্র জানায়, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কোন্দল মীমাংসা করতে চায় আওয়ামী লীগ। চূড়ান্ত মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থী ছাড়া বাকি মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে সমঝোতা করে বিরোধ মিটিয়ে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে দলটি। প্রার্থী বাছাইয়ের পাশাপাশি সাংগঠনিক বিরোধ মেটানো ও নির্বাচনী প্রচারণা সমানতালে চলছে। দলীয় কোন্দল নিরসনে বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বৈঠক করার পরিকল্পনাও দলের রয়েছে। কোন্দলজর্জরিত এলাকায় চলতি মাস থেকেই বিনা নোটিশে বা গোপনে শীর্ষ নেতারা সফর করবেন।
শীর্ষ নেতাদের কারো কারো মতে, কোন্দলজর্জরিত এলাকায় বিনা নোটিশে বা গোপনে শীর্ষ নেতারা সফর করলে অনেক আসনে কোন্দল শেষ পর্যন্ত মিটবে না। রাজশাহী জেলার ছয়টি সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল মেটাতে গত ৬ সেপ্টেম্বর জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের নেতাদের বৈঠক হয় ঢাকায় কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে। এরপরও সেখানে কোন্দল তেমন থামেনি। দলটির মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতাদের অন্তর্কলহ ও পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষমূলক প্রচারণা সেখানে ক্ষয় করছে সাংগঠনিক শক্তি। দলীয় এই কোন্দল দমাতে নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ সাংগঠনিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থার পক্ষে।
এই কোন্দল বা বিরোধ নিয়ে ভিন্নমতও আছে নীতিনির্ধারকদের। তারা বলছেন, আওয়ামী লীগ বড় রাজনৈতিক দল হওয়ায় প্রতিযোগিতার বিষয়ও আছে। প্রতিযোগিতার বিষয়টিকেও অনেক সময় বাইরে থেকে দলীয় কোন্দল বলে মনে হতে পারে। তাছাড়া ভালো ও মন্দ- সব রকমের নেতাকেই নির্বাচনের সময় দরকার হয়। কারণ দর্শানোর চিঠি পাঠানো, ভর্ৎসনা, অসন্তোষ প্রকাশ ও উপদেশ দেওয়ার মধ্য দিয়ে আপস-মীমাংসার ওপর জোর দিয়েছে আওয়ামী লীগ। সবাইকে নিয়ে সমঝোতার মাধ্যমে চলার কৌশল নিয়েছে দল। শেষ পর্যন্ত দলের প্রার্থী বাইরে গিয়ে ‘বিদ্রোহী’ হলে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
নীতিনির্ধারকরা বলছেন, মনোনয়নকেন্দ্রিক কোন্দল নিরসনে বিভিন্ন সাংগঠনিক জেলায় মনোনয়নপ্রত্যাশীদের তালিকা চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চলতি মাসেই বিভাগীয় পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করতে পারেন। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কোন্দলের কারণ একেবারে গ্রাম পর্যায়ের তৃণমূল নেতাদের কাছ থেকে শুনবেন শেখ হাসিনা। এ বৈঠকের পর মনোনয়নপ্রত্যাশীদের দ্বন্দ্ব কমে আসবে বলে আশা করেন শীর্ষ নেতারা।
আওয়ামী লীগ সূত্র বলছে, দলীয় মনোনয়ন নিয়ে কোন্দল ও দ্বন্দ্ব বেশি থাকা সংসদীয় আসনে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে প্রার্থী বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ। এতে জনপ্রিয় প্রার্থী পাওয়ার পাশাপাশি কোন্দলও কমবে বলে মনে করছে দলের শীর্ষ পর্যায়। আগামী নির্বাচনের আগে তৃণমূলকে ঐক্যবদ্ধ করে একক প্রার্থী চূড়ান্ত করাই আওয়ামী লীগের লক্ষ্য।