প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক, কোন আলেম কী প্রস্তাব দিলেন
বেলায়েত হুসাইন
প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮:৩৩
গ্রাফিক্স : বাংলাদেশের খবর
চলমান বিভিন্ন বিষয়ে মতবিনিময় ও জাতীয় ঐক্য নিয়ে বিভিন্ন ধর্মের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গত বৃহস্পতিবার (৫ ডিসেম্বর) ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন দেশের শীর্ষস্থানীয় বেশ কয়েকজন আলেম। প্রধান উপদেষ্টার প্রতি তাদের কার কী প্রস্তাব ছিল, তা সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।
মাওলানা আব্দুল মালেক
খতিব, জাতীয় মসজিদ বাইতুল মোকাররম
দেশের বরেণ্য এ আলেম বলেন, আমাদের দেশে সম্প্রীতি আছে। এটাকে যদি বাকি রাখতে চাই, তাহলে যারা তা নষ্ট করে, তাদের বিষয়ে আমাদের অনমনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এখন যে সংখ্যালঘুর কথা আমরা বারবার বলছি। এ বিষয়ে ইসলামের নির্দেশনা হলো- আবু বকর (রা.) বলেছেন, তোমাদের মাঝে সে সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী সে আমার কাছে দুর্বল, যদি সে জালেম হয়। আর যে সবচেয়ে দুর্বল সে আমার কাছে শক্তিশালী, যদি সে মজলুম হয়। এটাই হলো শিক্ষা। জালেম এবং মজলুম, এদের মধ্যে মজলুম যে-ই হোক, তার পক্ষে আমাদের থাকতে হবে। আর জালেম, সে যত বড় হোক, যত সংখ্যাগরিষ্ঠ হোক, তাকে তার জুলুম থেকে বিরত রাখতে হবে- এটাই দায়িত্ব।
তিনি আরও বলেন, ধর্মীয় সম্প্রীতির কথা বলে ধর্মকে গুলিয়ে ফেলা কিন্তু ধর্মীয় সম্প্রীতি না, ধর্মের অপব্যাখ্যা। একটা ধর্মে একটা বিষয় নেই, সেটাকে সেই ধর্মের ওপরে চাপিয়ে দেওয়া, অন্যদের খুশি করতে নিজের ধর্মের মধ্যে বাড়ানো-কমানো- এটার নাম কখনও ধর্মীয় সম্প্রীতি হতে পারে না। প্রত্যেকটি বিষয়কে স্ব স্ব জায়গায় রাখতে হবে, স্ব স্ব জায়গায় রাখলেই তার উপকারিতা আমরা পাব।
শায়খ আহমাদুল্লাহ
বিশিষ্ট ইসলামি দাঈ ও চেয়ারম্যান, আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশন
তিনি বলেন, আমাদের দেশে গ্রাম থেকে শহরে অনেক সমস্যা দেখা যায়, যেমন- ভাইয়ে ভাইয়ে কলহ ইত্যাদি, এটা পৃথিবীর অনেক দেশে নেই। আমাদের এখানে যে রাজনৈতিক কোন্দল, সেটি পৃথিবীর অনেক দেশে হয় না। আমাদের দেশে যত কোন্দল, কলহ, অসম্প্রীতি ইত্যাদি আছে, সেগুলোর সঙ্গে যদি আমরা ধর্মীয় সম্প্রীতি তুলনা করি, তাহলে আমি মনে করি, সব কলহের তুলনায় ধর্মীয় কলহ নেই বললেই চলে। আর আমরা শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে কাজ করছি এবং ওলামায়ে কেরাম শান্তি বিঘ্নিত হবে, এমন কোনো পদক্ষেপ নেন না। তাই আমার মনে হয়, আমাদের এটা অব্যাহতভাবে চালিয়ে নিতে হবে এবং ভিন্নধর্মাবলম্বী ভাইবোনদের প্রতি আহ্বান আপনারা প্রোপাগাণ্ডায় কান দেবেন না।
মাওলানা সাজিদুর রহমান
মহাসচিব, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ
তিনি বলেন, আমরা সম্প্রীতির সঙ্গে সব ধর্মের মানুষ একসঙ্গে বসবাস করছি। তার জ্বলন্ত উদাহরণ আলিফ হত্যার পরও আমাদের ধৈর্য। এরপরও যারা সম্প্রীতি নষ্ট করার চেষ্টা করবে, তাদের শক্তহাতে দমন করতে হবে। এজন্য যেকোনো সহযোগিতা করতে হেফাজতে ইসলাম ও আলেমরা সরকারের সঙ্গে আছে।
মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব
সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ
তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদরে পতনের পর বাংলাদেশকে অকার্যকর রাষ্ট্র বানানোর জন্য সবচেয়ে বড় ট্রাম্পকার্ড হলো সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন ইস্যু। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই এই ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে গেছে। পরাজিত শক্তি ভারতে বসে দেশকে অস্থিতিশীল করার পায়তারা করছে। তাই আমার কথা হলো- এসব ক্ষেত্রে কঠোর হতে হবে। যারাই রাষ্ট্রদ্রোহী কাজ করবে, তাদের কঠোরভাবে দমন করতে হবে এবং ভারতে মুসলিমদের ওপর যে ধারাবাহিক নির্যাতন হচ্ছে, এ ব্যাপারে প্রতিবাদ করতে হবে।
মাওলানা মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানি
সভাপতিমণ্ডলির সদস্য, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ
তিনি বলেন, ইসলামের শিক্ষা হলো- দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ এবং কোরআনে ভালো কাজের সহযোগিতা করতে বলা হয়েছে। আর আমরা সব ধর্মের মানুষ এক পরিবারের মতো বসবাস করি। কিন্তু প্রতিবেশী দেশ ফ্যাসিস্ট হাসিনার মাধ্যমে বিভিন্নভাবে উস্কানি দিয়ে আমাদের দেশের ক্ষতি করতে চাইছে। এজন্য আন্তর্জাতিকভাবে ভারতের বিপক্ষে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে।
মাওলানা মাহফুজুল হক
মহাসচিব, বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড (বেফাক)
স্বাধীনতা পর থেকে আমাদের দেশে ধর্মীয় সম্প্রীতি কখনোও বড় ধরনের সমস্যা অবস্থা দেখিনি। কিন্তু বিভিন্ন মহল এ বিষয়ে সামনে এনে উদ্দেশ্য হাসিল করতে চায়। এজন্য রাষ্ট্রের গোয়েন্দা বিভাগের মাধ্যমে দ্রুত সময়ের মধ্যে কারণগুলো চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। একই সঙ্গে পার্শ্ববর্তী দেশটি মুসলিমদের ওপর অব্যাহতভাবে যেরকম জুলুম চলছে সে বিষয়ে আমাদের সোচ্চার হওয়া দরকার এবং মিডিয়ার মধ্যমেও বাস্তব চিত্র তুলে ধরলে আমার এ সংকট কাটিয়ে উঠতে পারব।
মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন রাজি
মহাসচিব, ইসলামি ঐক্যজোট
তিনি বলেন, ইসলাম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলে আর আমাদের দেশে সেটা আছে। কিন্তু সম্প্রীতি বিনষ্টের যে গুজব উঠেছে, তার পেছনে ফ্যাসিবাদের ষড়যন্ত্র রয়েছে। এগুলো ধর্মের কারণে নয়। এরপরও কোথাও যদি কোনো ভিন্নধর্মী ভাইবোনেরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন, আমাদের জানালে আমরা তাদের পাশে দাঁড়াব।
মুফতি মোহাম্মদ ওসমান গণী সালেহী
প্রধান ফকিহ, দারুন নাজাত সিদ্দিকিয়া কামিল মাদ্রাসা ও প্রধান মুবাল্লিগ, ছারছীনা দরবার শরিফ
তিনি বলেন, সম্প্রীতির মডেল ছিলেন প্রিয়নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)। তিনি যে আদর্শ আমাদের দেখিয়েছেন, আমরা যদি তা বাস্তবায়ন করতে পারি, তাহলে সব ধর্মের মানুষ সম্প্রীতির সঙ্গে বাস করতে পারব। আর ইসলাম কখনো অন্য ধর্মের মানুষের ওপর নিপীড়নের কথা বলে না। আমি মনে করি- আমাদের দেশের ভিন্নধর্মাবলম্বীরা মায়ের কোলে শিশু যেমন নিরাপদ থাকেন, তারাও বাংলাদেশে তেমনই নিরাপদ আছেন। এজন্য আমাদের গুজবে কান দেওয়া উচিৎ হবে না।
শায়খ আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাজ্জাক
প্রধান সম্পাদক, মাসিক আল-ইতিছাম
তিনি বলেন, আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আছে। এরপরও এ বিষয়ে আমাদের কথা বলতে হচ্ছে কেন? এজন্য আমাদের সাম্প্রদায়িক ইস্যুর মূলে হাত দিতে হবে। নইলে সমাধানে পৌঁছতে পারব না। তা হলো- প্রকৃতপক্ষে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশে সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত। পৃথিবীর ইতিহাসে এভাবে কোনো ইবাদতখানা ভাঙা হয়নি, যেভাবে ভাঙা হয়েছে বাবরি মসজিদ। এরকম আরও অসংখ্য ঘটনা আছে, যেগুলো আমাদের প্রতিবেশী দেশে সংঘটিত হয়েছে। এজন্য সেখানে যে সংখ্যালঘু নির্যাতন হচ্ছে, সেটা নিয়ে আমাদের আওয়াজ ওঠাতে হবে, তাহলেই এর সমাধান হবে।
বিএইচ/