ছবিতে বেলায়েত হোসেন।
ভাষা আল্লাহর অনেক বড় নেয়ামত। মক্কা মুকাররমা বহুভাষী মানুষের মিলনমেলা। এখানে সমাগত ভিনদেশিরা মূলত আরবি, উর্দু-হিন্দি ও ইংরেজিতেই বেশি কথা বলেন। উপরের কোনো ভাষাতেই দক্ষ না আমি, এমনকি আমার মাতৃভাষা বাংলাতেও নয়। তবে কওমি মাদ্রাসায় পড়ার কারণে আরবি ও হিন্দি-উর্দু মোটামুটি জানি। আর প্রাথমিক স্তরের হলেও ইংরেজিতে আমার ‘পাণ্ডিত্য’ আছে। ‘হাউ আর ইউ-আই এম ফাইন’ ইত্যাদি বলতে পারি।
এই ভাষাগুলোর সঙ্গে অল্প-বিস্তর যেহেতু পরিচয় আছে, এ জন্য পবিত্র স্থানটিতে সফররত ভিনদেশিদের অনেকের সঙ্গে মনের ভাব ও ভাবনা আদান-প্রদান করতে পারছি। মায়ের ভাষা ছাড়া অন্য ভাষাতে মনের কথা প্রকাশ করতে পারছি। এটা যখন ভাবি, তখন কৃতজ্ঞতায় শুধু মহান স্রষ্টা আল্লাহর কথাই স্মরণ করি।
আমার ধারণা, বিদেশি ভাষাগুলোর মধ্যে খুব সামান্য হলেও আমার আরবিটা মোটামুটি শুদ্ধ। জেদ্দা বিমানবন্দরে এক লঘু ‘অন্যায়ে’ আধা ঘণ্টার মতো একজন কাস্টম অফিসারের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। তিনি আমার আরবিতে মুগ্ধ হয়েছেন এবং সুন্দরভাবে কথা বলায় খুব কোমল আচরণ করেছেন। তার ভাষায় আমার আরবি নাকি ‘ফুসহাহ’, মানে শুদ্ধ। একই ‘অপরাধে’ উর্দুভাষী এক ভাইকেও দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল, তার প্রতি কাস্টম অফিসারের ব্যবহার ছিল রূঢ়।
ফজরের নামাজের সময়ে মরক্কান এক নারীকে আমাদের এক সফরসঙ্গী বাংলায় জিজ্ঞেস করছিলেন যে, তুমি এত ছোট বাচ্চা নিয়ে এসেছ? কিন্তু তিনি তো বাংলা বোঝেন না। আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে তাকালেন। তার সঙ্গে কথা হলো। জানালেন, তার পিতৃভূমি ‘মাগরিব’ (মরক্কো)। বিয়ে হয়েছে মালদ্বীপ। স্বামী ও ৩-৪ বছরের সন্তান আব্দুল্লাহকে নিয়ে ওমরায় এসেছেন। এরপর তাদের নিয়ে মাতৃভূমিতে যাবেন।
মালদ্বীপে বসবাসকারী মরক্কান ওই নারী জানালেন, দ্বীপ দেশটিতে অনেক বাংলাদেশি থাকেন। মনে হলো, কাছাকাছি দেশের কারো সঙ্গে আরবিতে কথা বলে তিনিও আনন্দবোধ করছেন। বিদায়বেলায় আমি বললাম, ‘ইলাল লিক্বা (ফের দেখা হবে)।’ প্রতিউত্তরে একই আশাবাদ ব্যক্ত করলেন তিনিও।
ফজরের পর পাকিস্তানের সিন্ধুর এক লোক আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইমাম সাহাব কৌন সুরা ছে পড়হা?’ বললাম, ‘সুরা মারইয়াম ছে।’ এরপর আরও কথা হলো। তিনি দুবাইয়ে থাকেন। দুই-তিন দিন হয়েছে পবিত্র সফরে এসেছেন। তিন-চার দিন আগে মক্কায় ওমরাহ পালনরত অবস্থায় তার বাবা ইন্তেকাল করেছেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।)
ওমরা শেষে তিনি সপরিবারে মাতৃভূমি পাকিস্তানে যাবেন এবং বৃদ্ধ মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ফের দুবাইয়ে ফিরে যাবেন বলেও জানালেন। আমার মুখের ভাঙা ভাঙা উর্দু শুনে জানতে চাইলেন, ‘তুম কাহাঁ ছে?’ বললাম, ‘এক জামানে মে জো দো দেশ এক থা, ওহাঁ ছে।’ বুঝলেন বাংলাদেশি। দোয়া চাইলেন। আমিও চাইলাম। ‘ফের মিলেঙ্গে’ বলে তার থেকেও আন্তরিকভাবে বিদায় নিতে হলো।
সৌদি এয়ারলাইন্সের একটি বিমানে এসেছি আমরা। চা-কফি-কুল ড্রিংকসের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু সেটা বিতরণের আগেও নির্দিষ্ট স্থান থেকে কিছু যাত্রী চা-কফি চেয়ে নিচ্ছিলেন। মা ও আমি দুজনেরই মাথা ব্যথা। তাই আমিও লাইনে দাঁড়ালাম কফি নিতে। কিন্তু ক্রুরা সিরিয়াল মেইনটেন করছিল না। মনে হচ্ছিল, যাকে পছন্দ হচ্ছে, তাকেই শুধু দিচ্ছে। আর বুঝলাম, বাংলা হয়তো ওরা বুঝতে পারছে না কিংবা উপেক্ষা করছে। আমি বললাম, ‘মাই মাদার ইজ ভেরি টায়ার্ড।’ এরপর কয়েকজনকে টপকে ‘তিতা’ কিন্তু খুব কাঙ্ক্ষিত এক কাপ কফি দিল। খেলাম এবং আরাম বোধ করলাম। মনে হলো, ‘আমি ইংরেজিও পারি।’ হা হা হা।
দুই দিন হলো রাসুল (সা.)-এর মাতৃভূমিতে এলাম। সামান্য অভিজ্ঞতা, তাতে মনে হলো, হারাম শরিফের পুলিশ ‘ইয়া আল্লাহ হাজ্জি’ ছাড়া কিছু বলতেও পারে না, বোঝেও না। একবার এশার নামাজ মসজিদের বাইরে পড়ব মনস্থির করলাম। বেশি হাঁটায় পায়ের পুরনো একটি ব্যথা বেড়ে গিয়েছে। তাই বাইরের দিকে নামাজের জন্য দাঁড়াব। পুলিশ বাধা দিল। বললাম, ‘কুল্লুনা দুআফা; খাচ্ছাতান ফি রিজলি আলাম’ (আমরা দুর্বল, বিশেষ করে আমার পায়ে ব্যথা)। কিন্তু পুলিশের ওই সদস্য কিছুই বুঝলেন না। ‘তাহাররাক তাহাররাক’ (চলো চলো) বলে আমাদের সরিয়ে দিল।
এরই মধ্যে এরকম আরও অসংখ্য অভিজ্ঞতা জমা পড়েছে স্মৃতির খাতায়, আরও জমবে ইনশাআল্লাহ। সেই পর্যন্ত সৌদি পুলিশের ভাষায় আমিও আপনাদের বলছি, ‘তাহাররাক তাহাররাক’। মানে আমার সফরসঙ্গী হয়ে আপনিও চলুন, আপনিও চলুন।
বেলায়েত হোসেন : রিলিজিয়াস এডিটর, বাংলাদেশের খবর
এমজে/এমআই