Logo

ধর্ম

আদর্শ মুসলিম সমাজের বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলি কী?

আবু সাঈদ

আবু সাঈদ

প্রকাশ: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৫:৪৪

আদর্শ মুসলিম সমাজের বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলি কী?

আমরা মানুষ। আশরাফুল মাখলুকাত। জাতি হিসেবে মুসলমান হওয়ায় মানবগোষ্ঠির মাঝেও আমরা সেরা। আল্লাহর মনোনীত ধর্ম ইসলামের অনুসারী। মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ জীবনযাপন মানুষের বৈশিষ্ট্য। একাকি বা বিচ্ছিন্নভাবে বাঁচতে পারে না তারা। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে দিয়েছেন সমাজবদ্ধ ও পারস্পরিক সহযোগিতাপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। একজনের জন্য অপরজনকে বানিয়েছেন পরিপূরক বা সম্পূরক। পারস্পরিক সহযোগিতা ও কল্যাণকামিতা মানব সমাজের মূল ভিত্তি। আল্লাহ তায়ালা কোরআনে কারিমে বলেন, ‘আমি তাদের মধ্যে তাদের জীবিকা বণ্টন করেছি পার্থিব জীবনে এবং একের মর্যাদাকে অপরের ওপর উন্নীত করেছি, যাতে একে অপরকে সেবক রূপে গ্রহণ করে।’ (সুরা যুখরুফ, আয়াত : ৩২)

অন্য এক আয়াতে এসেছে, ‘মুমিনরা পরস্পরে ভাই ভাই। অতএব তোমরা পরস্পরে সমঝোতা করে চলো এবং আল্লাহকে ভয় কর। যেন তোমাদের ওপর রহমত বর্ষণ করা হয়।’ (সুরা হুজুরাত, আয়াত : ১০)

তামিমে দারি (রা.)-এর বর্ণনায় হাদিস শরিফে হজরত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘দ্বীন হচ্ছে কল্যাণকামিতার নাম। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, কার জন্য? রাসুল (সা.) বললেন, আল্লাহ ও তাঁর কিতাবের জন্য, রাসুলের জন্য, মুসলিমদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ও সাধারণ মুসলমানদের জন্য।’ (মুসলিম : ১০০)

আরেক হাদিসে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘একজন মুমিন আরেকজন মুমিনের জন্য ইমারত স্বরূপ, যার এক অংশ অপর অংশকে শক্তিশালী করে থাকে।’ (বুখারি)

অন্য বর্ণনায় তিনি বলেন, ‘মুমিন সম্প্রদায় একজন ব্যক্তির সমতুল্য। যদি তার চক্ষু পীড়িত হয়, তাহলে তার সমগ্র দেহ পীড়িত হয়ে পড়ে। যদি তার মাথা আক্রান্ত হয়, তাহলে সমগ্র শরীরই আক্রান্ত হয়ে পড়ে।’ (মুসলিম)

তিরমিজি শরিফের এক হাদিসে এসেছে, আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এক মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই। সে তার সাথে কোনোরকম বিশ্বাসঘাতকতা করবে না, তার প্রসঙ্গে মিথ্যা বলবে না, তার বিপদে সাহায্যের হাত গুটিয়ে রাখবে না। প্রত্যেক মুসলমানের মান-সম্মান, ধন-সম্পদ ও জীবনের উপর হস্তক্ষেপ করা অপর মুসলমানের জন্য হারাম। (তিরমিজি) 

শত্রুতা, হিংসা-বিদ্বেষ, স্বার্থপরতা, হানাহানি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের উল্লিখিত নির্দেশনার পরিপন্থি। এগুলো সমাজ ব্যবস্থার বিনাশ সাধন করে। 

মুহাজির এবং আনসার সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম ছিলেন ইসলামের দুটি ডানার ন্যায়। তাদের দ্বারা গঠিত মদিনার সমাজ ছিল একটি আদর্শ মুসলিম সমাজ। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দীক্ষা পেয়ে সাহাবায়ে কেরাম এমন সোনার মানুষে পরিণত হয়েছিলেন যে, তারা যে সমাজে বসবাস করেছেন, সে সমাজ হয়ে গেছে আদর্শ সমাজ। তাদের দ্বারা যে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়েছে, সে রাষ্ট্র হয়ে গেছে আদর্শ রাষ্ট্র। তাদের পরিবারগুলো ছিল মানবসভ্যতার জন্য আদর্শ পরিবার। এজন্যই তো আল্লাহ তায়ালা সাহাবিদের ঈমানের মতো ঈমান আনার নির্দেশ দিয়েছেন। সাহাবিদের সুন্নাহ ও আদর্শকে শক্তভাবে আকড়ে ধরার নির্দেশ দিয়েছেন স্বয়ং রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

মক্কা থেকে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরত করে মদিনায় আসার পর মদিনার আনসার সাহাবিগণ সর্বোচ্চ সামাজিক দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়েছিলেন। সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের অনুপম আদর্শ স্থাপন করেছিলেন। মুহাজির ও আনসারদের সম্মিলনে প্রীতি ও বন্ধনের যে সমাজ গড়ে ওঠেছিল, ইতিহাসে এর কোনো নজির নেই। আল্লাহ তায়ালা তাদের সেই সামাজিক দায়বোধ, দায়িত্ববোধ ও আন্তরিকতার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে কুরআনে কারীমে ইরশাদ করেন, ‘তারা নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও অন্যদের অগ্রাধিকার প্রদান করে।’ (সুরা হাশর, আয়াত : ৯)

একটি আদর্শ মুসলিম সমাজ গড়ে তোলার জন্য আবশ্যক হলো সমাজের প্রতিটি সদস্য অপর মুসলমান ভাইয়ের হক সম্পর্কে জানা এবং সেগুলো আদায়ে যত্নবান হওয়া। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে একজন মুসলমানের উপর অপর মুসলিম ভাইয়ের গুরুত্বপূর্ণ যেসব হক রয়েছে, সেগুলোর অন্যতম কয়েকটি হলো-

১। নিজের জন্য যা পছন্দ করবে অপর মুসলিম ভাইয়ের জন্যও তাই পছন্দ করা। নিজের জন্য যা অপছন্দ করবে অপর মুসলিম ভাইয়ের জন্যও তা অপছন্দ করা।

২। সাধ্যানুযায়ী মুসলমান ভাইয়ের সাহায্য সহযোগিতা করা। কোনো মুসলমান কোনো সংকটে পড়লে তাকে উদ্ধারে সচেষ্ট হওয়া।

৩। কারো ওপর জুলুম না করা। জালেমকে জুলুম থেকে নিবৃত্ত করা। মাজলুমকে জালিমের হাত থেকে রক্ষা করা।

৪। মুসলমানকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকা। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, প্রকৃত মুসলমান তো সেই, যার হাত ও যবান থেকে অপর মুসলমান নিরাপদ থাকে।

৫। কাউকে গালিগালাজ না করা। হাদিসে এসেছে, মুসলমানকে গালি দেওয়া পাপ এবং তাকে হত্যা করা কুফুরি।

৬। প্রত্যেক মুসলমানের ইজ্জত, সম্পদ ও রক্তের সুরক্ষা বিধান করা। কোনো মুসলমানের ইজ্জতহানি, সম্পদহরণ ও রক্তপাত সম্পূর্ণ হারাম এবং কবিরা গুনাহ।

৭। নিজেরা নিজেদেরকে প্রতিপক্ষ না বানানো। পরস্পরে সহনশীল ও সহমর্মী হওয়া।

৮। ঝগড়া-ফাসাদকে উসকে না দেওয়া। পরনিন্দা, পরচর্চা না করা। নিজের দোষের দিকে তাকানো। অন্যের দোষকে ছোট করে দেখা। 

৯। কোনো মুসলমান ভাইকে তুচ্ছ জ্ঞান না করা। আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, একজন ব্যক্তির অকল্যাণের জন্য এটুকুই যথেষ্ট যে, সে তার মুসলমান ভাইকে তুচ্ছ জ্ঞান করে।

১০। এছাড়াও আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা, প্রতিবেশীর হক আদায়ে সচেষ্ট থাকা, অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া, জানাযা ও কাফন-দাফনে শরীক হওয়া ইত্যাদি সামাজিক সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে।

মুসলমান হিসেবে আমাদের উচিত, ইসলামের দাওয়াত সর্বত্র পৌঁছে দেওয়ার কাজে পরস্পরে সহযোগী হওয়া। ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকা। আল্লাহর দ্বীনকে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টায় ব্রতী হওয়া। সৎকর্মপরায়ণশীল পূর্বসূরীর অনুসরণ করা। তাহলেই ফিরে পাবো আমরা হারানো গৌরব। সক্ষম হবো ছিনিয়ে আনতে পূণ্যভূমি ভূদস্যুদের হাত থেকে। মুক্ত করতে পারবো মসজিদে আকসা। সমুন্নত করতে পারবো খোদার দ্বীন। আল্লাহ তাআলা মুমিনদের সাহায্য করতে সক্ষম।

লেখক: মুহাদ্দিস, মাদ্রাসা দারুর রাশাদ

বাংলাদেশের খবরের ইসলাম বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- [email protected]

বিএইচ/

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর