Logo

ধর্ম

ভালোবাসা দিবসের বহুমাত্রিক ধ্বংসাত্মক কুপ্রভাব

আবু সাঈদ

আবু সাঈদ

প্রকাশ: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৫:৫১

ভালোবাসা দিবসের বহুমাত্রিক ধ্বংসাত্মক কুপ্রভাব

ইসলাম প্রকৃতির সাথে সামাঞ্জস্যপূর্ণ ধর্ম। সকল প্রাকৃতিক ও জৈবিক চাহিদা পূরণের বৈধ উপায় রয়েছে ইসলামে। শারীরিক ও জৈবিক চাহিদা মানুষের প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ অনুভব তার সৃষ্টিগত দুর্বলতা। শারীরিক চাহিদা পূরণের জন্য ইসলাম দিয়েছে প্রত্যেক নর-নারীকে বিবাহের বিধান। 

কিন্তু ইসলাম ব্যতীত অন্য অনেক ধর্মে মানুষের সহজাত এই চাহিদা ও দুর্বলতাকে বিবেচনা করা হয়নি। অপ্রাকৃতিক নিয়ম বা রীতিনীতিকে  ধর্মীয় বিধান আকারে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে মানুষের ঘাড়ে। প্রকৃতিবিরোধী সেসব বিধান পালনে বাহ্যিকভাবে অনেকের আনুগত্য দেখা গেলেও গোপনে গোপনে প্রতারণা ও নিয়মভঙ্গের চর্চা মহামারী আকার ধারন করে। 

হিন্দু এবং খ্রিস্ট ধর্মের বৈরাগ্যবাদিতা এমনই একটি প্রকৃতি বিরোধী বিধান। এসব ধর্মে পুরোহিত, পাদ্রী বা ধর্ম যাজকদের জন্য বৈরাগ্যবরণ বাধ্যতামূলক। নারী সংশ্রব গ্রহণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ তাদের জন্য। কিন্তু অন্ধ হয়ে থাকলেই কি আর প্রলয় বন্ধ হয়ে যায়? কেতাবি নিয়ম আর সামাজিক রীতিনীতি কি সহজাত জৈবিক চাহিদাকে দমিয়ে রাখতে পারে? তাই পুরোহিত ও পোপদের দ্বারা নারীর শ্লীলতাহানি এবং অবৈধ যৌনসম্পর্কের চাঞ্চল্যকর অনেক সংবাদ প্রায়ই আমাদেরকে হতবাক করে। এমনই এক ঘটনার নায়ক সেন্ট ভ্যালেন্টাইন। 

খ্রিস্টীয় ২৬৯ মতান্তরে ২৭০ সালের কথা। ভ্যালেন্টাইন নামে এক ব্যক্তি ছিল। যে ছিল খ্রিস্ট ধর্মের অনুসারী। একজন ধর্মযাজক। ভ্যালেন্টাইন নামের সেই দুশ্চরিত্র, লম্পট ধর্মযাজক বিবাহ বহির্ভূত অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। গীর্জার মধ্যেই সে ধর্ষণ-ব্যাভিচারে লিপ্ত হয়! নারী বৈরাগীদের সাথে গড়ে তোলে অবৈধ সম্পর্ক! 

এর মাধ্যমে একই সাথে সে দুটি অপরাধ করে-
১। বিবাহ বন্ধন ছাড়াই পরনারীর সাথে সম্পর্কে  জড়ায়। অথচ ইসলাম ধর্মের মতো প্রতিটি ধর্মেই ব্যাভিচার এবং বিবাহ বহির্ভূত যৌনসম্পর্ক একটি গুরুতর অপরাধ। কোনো ধর্মই জেনা-ব্যাভিচার সমর্থন করে না! 

২। আবার খ্রিস্টধর্মে যেহেতু ধর্মযাজকদের জন্য বৈরাগ্যবরণ আবশ্যক ছিল। তাদের বিয়ে করার বা নারী সংশ্রব গ্রহণ করার কোনো নিয়ম নেই। একজন ধর্মযাজক হিসেবে সে এই বিধানকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেছিল। 

এই দুই অপরাধে তাকে বন্দী করে রোমের তৎকালীন সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস। কিন্তু সেন্ট ভ্যালেন্টাইন ছিল চরম পর্যায়ের লম্পট। জেলে গিয়েও তার লাম্পট্য থেমে থাকেনি। জেলখানাতেই সে কারারক্ষীর মেয়ের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়ায়। তার এহেন অপরাধ প্রবণতা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণহীনতা দেখে সম্রাট তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। ১৪ ফেব্রুয়ারি তার দণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয়। 

ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুর পর তার কিছু অন্ধভক্ত এবং তার মতো দুশ্চরিত্র ইন্দ্রপূজারীরা দিবসটিকে ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইনস ডে’ নামে উদযাপন শুরু করে। উদযাপনের ঘোষণা করে পোপ সেন্ট জেলাসিউও ১ম জুলিয়াস!

দণ্ডিত বানরের লেজকাটার গল্পের মতোই ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’র গল্প। অপরাধের দায়ে লেজকাটার লজ্জা ঢাকার জন্য যেভাবে লেজকাটাকেই শ্রেষ্ঠত্বের খোলস পরানোর চেষ্টা করা হয়েছিল বানরের গল্পে, তেমনি চতুরতার সাথে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের অপরাধ এবং নোংরামি আড়াল করার জন্য গল্পটা বিকৃত করা হয়। দুশ্চরিত্রপনাকে ভালোবাসার জন্য আত্মত্যাগের নাম দিয়ে চালিয়ে দেওয়া হয় সমাজে। একটি কলঙ্কিত ইতিহাসকে পরানো হয় মর্যাদার বসন।  

অন্যান্য দেশে দিবসটি ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ নামেই উদযাপিত হয়। যা থেকে বিকৃত হওয়ার পরও মূল ঘটনার কিছুটা যোগসূত্র পাওয়া যায়। খ্রিস্টধর্মের সাথে এর সম্পৃক্ততার ইঙ্গিত মেলে। কিন্তু বাংলাদেশে তো এক্ষেত্রে বিকৃতির সকল সীমা অতিক্রম করা হয়েছে। দিবসটিকে সেক্যুলারাইজড এবং সর্বধর্মী করার জন্য খ্রিস্টান ধর্মযাজকের নাম আড়াল করে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে ‘ভালোবাসা দিবস’ নামে। যা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং সুস্পষ্ট নিকৃষ্টতম বিকৃতি। ভ্যালেন্টাইন শব্দের সাথে কি ভালোবাসার দূরতম কোনো সম্পর্ক আছে? 

বাংলাদেশে ভ্যালেন্টাইন সংস্কৃতির আমদানি হয় ১৯৯৩ সালে, যায়যায়দিন পত্রিকার সম্পাদক শফিক রেহমানের হাত ধরে। অপরিণামদর্শী সেক্যুলার মিডিয়াগুলো টিআরপি বাড়ানোর জন্য এবং বেহায়াপনা ছড়িয়ে সহজে অর্থ উপার্জনের লালসায় এর ব্যাপক কভারেজ দেয়। উঠতি বয়সের যুবক-যুবতিরা লুফে নেয় এই সংস্কৃতি। নিজেদের অবৈধ কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার মোক্ষম সুযোগ হয়ে ধরা দেয় তাদের কাছে ভালোবাসা দিবস। অল্পকিছু দিনের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে পশ্চিমা সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণপ্রিয় এদেশের তরুণ সমাজের কাছে। 

Valentine অর্থ কি ভালোবাসা? এটা কোন ডিকশনারিতে আছে? কোনো ডিকশনারিতেই Valentine অর্থ ভালোবাসা দেওয়া নেই! যদি Valentine এর অর্থ ভালোবাসা হত, তাহলে তো ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ করতে I Love You এর পাশাপাশিI Valentine You’-ও বলতো কেউ কেউ। এমনটা তো কেউ করে না! বোঝা গেল, Valentine অর্থ ভালোবাসা নয়। অথচ Valentine day অর্থ-ভালোবাসা দিবস! কী অদ্ভুত ব্যাপার! 

ভালোবাসার সাথে দিনটির ন্যূনতম কোনো সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও এই দিনটিকেই উৎযাপন করা হয় ভালোবাসা দিবস নামে। একজন খ্রিস্টান পাদ্রীর স্মরণে! যাদের জীবনে পবিত্র ভালোবাসা বলে কিছুই নেই! যারা জীবনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় না! যাদের জীবনই কাটে অবৈধ প্রেম আর শারীরিক সম্পর্কের মাঝে! একজন পাদ্রীর স্মরণে মুসলমানদের ভালোবাসা দিবস পালন অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়। 

এখন তো শুধু ১৪ ফেব্রুয়ারিতেই এর নোংরামি সীমাবদ্ধ নয়। দিবসটির নোংরামি গ্রাস করেছে পূর্বের এবং পরের আরও অনেকগুলো দিন। এদিবস কেন্দ্রিক উন্মাদনা-উন্মত্ততা চলতে থাকে বিভিন্ন নামে বেশ কিছুদিন আগে থেকেই। ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রত্যেকটি দিনকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করে চলতে থাকে সিরিজ গোনাহের রমরমা আয়োজন।

৭ ফেব্রুয়ারি- রোজ ডে,

৮ ফেব্রুয়ারি- প্রোপোজ ডে,

৯ ফেব্রুয়ারি- চকলেট ডে,

১০ ফেব্রুয়ারি- টেডি ডে,

১১ ফেব্রুয়ারি- প্রমিজ ডে,

১২ ফেব্রুয়ারি- হাগ ডে,

১৩ ফেব্রুয়ারি- কিস ডে,

১৪ ফেব্রুয়ারি- ভ্যালেন্টাইন’স ডে, 

এই যে দিবস এবং দিবসগুলোতে যা করা হয় সবগুলোই অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, অন্যায় এবং গোনাহকে মোহনীয়করণ ও স্বাভাবিকিকরণ প্রক্রিয়া। যা ইসলামের দৃষ্টিতে জঘন্য অপরাধ এবং আল্লাহর বিধানের প্রতি ধৃষ্টতা।  

ভালোবাসা দিবসের বহুমাত্রিক ধ্বংসাত্মক কুপ্রভাব  
গণতান্ত্রিক সেক্যুলার দেশগুলোতে ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে সম্মতিক্রমে এমনিতেই সকল প্রকার অনৈতিক কাজের স্বাধীনতা দিয়ে রাখা হয়েছে। এর মাঝে নতুন মাত্রা এবং চরম উন্মত্ততা যোগ করেছে ভালোবাসা দিবসের উদযাপন। অন্যান্য দিনের অনৈতকতা ও এ দিনের অনৈতিকতার মধ্যে পার্থক্য হলো, বছরের অন্যান্য দিন সামাজিকতার কারণে হলেও যে কাজগুলো করতে একটু রাখঢাক করা হত, এদিনে সেগুলো ওপেনলি করার একটি লাইসেন্স মিলে যায়। 

বছর কয়েক আগে একজন তরুণী এরকমই কোনো এক দিনে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিল যে, ‘আজ তার জীবনে প্রথমবারের মতো ভার্জিনিটি লস্ট করবে। আর সেজন্য সে খুব খুশি!’ আরেক তরুণী প্রকাশ্যে তার বয়ফ্রেন্ডকে চুমু খাওয়ার ঘোষণা করেছিল। নির্লজ্জতা ও  বেহায়াপনার সীমা আর কীভাবে অতিক্রম করা যায়! 

ভালোবাসা দিবসকেন্দ্রিক সরাসরি যেসব গোনাহ সংঘটিত হয়, সেগুলোর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো- 

১। বিজাতীয় সংস্কৃতি পালন ও হারাম সম্পর্কে জড়ানোর গোনাহ। 

২। এই দিবসে এসব গোনাহ প্রকাশ্যে, লোকালয়ে করা হয়। যা আরেকটি গোনাহ। 

৩। ভালোবাসা দিবস উদযাপনের নামে গোনাহের কাজকে উদযাপন করা, উৎসবে রূপ দেওয়া আরেক গোনাহ। 

৪। প্রকাশ্যে গোনাহ করার কারণে তাদের গোনাহের দৃশ্য দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যারা এই গোনাহের কাজটা করবে কিংবা করার জন্য আগ্রহবোধ করবে, সেই গোনাহের দায়ও প্রকাশ্যে গোনাহকারীর ওপর বর্তাবে।

রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

اَلدَّالُّ عَلَى الشَّرِّ كَفَاعِلِه.

‘যে গোনাহের কাজে উৎসাহ দেয় বা গোনাহের কাজের রসদ জোগায় সেও সমান পাপী।’

৫। স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা দোষণীয় নয়। তাদের ঘনিষ্ঠতাও নিষিদ্ধ নয়; বরং পূণ্যের কাজ। তবে সেটিও অন্যের সামনে প্রকাশ করা, অন্যের সাথে শেয়ার করা অশ্লীলতা ও পাপ। বিবাহিত অনেক যুগল যেটা এদিন উপলক্ষে করে থাকে। 

৬। অবিবাহিত যুবক-যুবতি যারা এই দিনে অবৈধ সম্পর্কের ভিত্তিতে শারীরিক সম্পর্কে জড়ায়; তাদের অধিকাংশেরই বিবাহ হয় পারিবারিকভাবে অন্য ছেলে/মেয়ের সাথে। ফলে তারা তাদের ভবিষ্যৎ স্বামী/স্ত্রীর খেয়ানত করছে। 

৭। সম্পর্কের পবিত্রতা নষ্ট হচ্ছে। সততা-সতিত্ব বিসর্জন দিচ্ছে হাজার হাজার অপরিণামদর্শী যুবক-যুবতি। 

৮। ভালোবাসার নামে শারীরিক সম্পর্ক, অবৈধ গর্ভধারণ, অপরিণত গর্ভপাত, (এবোর্শন) আত্মাহত্যা ও মৃত্যুঝুঁকি বাড়াচ্ছে তরুণীদের। 

৯। সমাজের পবিত্রতা নষ্ট করছে। শালীনতা ব্যহত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। 

১০। অবৈধ মেলামেশার পর সামাজিক মর্যাদা বজায় রাখতে গিয়ে অনেক পরকল্পিত হত্যার মতো ঘটনাও নিয়মিত ঘটছে। 

হে অন্ধ অনুকরণপ্রিয় মুসলিম যুবক-যুবতি! উপরে যেসকল অপরাধ ও গোনাহের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলো হারাম হওয়ার বিষয়ে কোরআন ও হাদিসের অকাট্য প্রমাণাদি বিদ্যমান। এমনকি সুস্থ বিবেক দিয়ে চিন্তা করলে আপনার কাছেও এগুলোর অনিষ্টতা পরিষ্কার হয়ে যাবে। ভালোবাসা সাবজেক্টিভ (আত্মবাদী বা আত্মীয়মূলক) একটি বিষয়। ভালোবাসা অবজেক্টিভ তথা দিবস আকারে ঘোষণা দিয়ে বিশ্বব্যাপী উদযাপনের বিষয় নয়। বাসার বাইরে গিয়ে বিবাহবহির্ভূত যে ভালোবাসার প্রদর্শন ভালোবাসা দিবসে করা হয়, সেটি ভালোবাসা নয়। বরং সকল মন্দের বাসা।

অতএব, আসুন আমরা ‘জাজমেন্ট ডে’র কথা স্মরণ করে ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’র  মাল্টিপল (বহুমাত্রিক) গোনাহ থেকে বিরত থাকি। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন! আমীন!

  • বাংলাদেশের খবরের ইসলাম বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- [email protected] 

লেখকের মেইল : [email protected]

বিএইচ/

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর