Logo

রাজনীতি

৯ মাসেই শতকোটি টাকা চাঁদাবাজি

মঈন খানের ‘পিএস’র পেটে পলাশের মিল-কারখানা

Icon

বাংলাদেশের প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ এপ্রিল ২০২৫, ১৬:১৭

মঈন খানের ‘পিএস’র পেটে পলাশের মিল-কারখানা

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হাসিনা সরকারের পতনের পরপরই একটি গোষ্ঠী আধিপত্য বিস্তারে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগের ছেড়ে যাওয়া স্থানের দখল নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে তারা। ‘স্বৈরাচার’ পতনের ‘আশীর্বাদে’ বিভিন্ন পরিচয়ে গড়ে তুলছেন নিজস্ব সিন্ডিকেট। তাদের একজন নরসিংদীর পলাশ উপজেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন ভুঁইয়া মিল্টন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খানের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিএস) পরিচয়ে ইতোমধ্যেই একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করেছেন পলাশ উপজেলায়। গত ৯ মাসে সিএনজি-ট্যাম্পুস্ট্যান্ড থেকে শুরু করে পলাশ-ঘোড়াশালের বিভিন্ন বাস-ট্রাকস্ট্যান্ডের দখলসহ মিল-কারখানায় চাঁদাবাজির রাজত্ব কায়েমের অভিযোগ উঠেছে মিল্টন সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে।

তার বিরুদ্ধে সিন্ডিকেটভিত্তিক দখল-চাঁদাবাজির অভিযোগ করছেন একই উপজেলা বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরাই। মিল্টনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন সৃষ্টির অভিযোগ করে উপজেলা বিএনপির নেতারা বলেন, মঈন খানের ‘পিএস’ পরিচয়ে একক বলয় গড়ে তুলেছেন তিনি। খোদ দলীয় নেতাকর্মীরাও এই সিন্ডিকেটের কাছে কোণঠাসা। মিল্টন সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কথা বললেই দেওয়া হচ্ছে হুমকি, চালানো হচ্ছে হামলা। তার এসব কর্মকাণ্ডে মঈন খানের মতো পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদের ভাবমূর্তিও নষ্ট হচ্ছে বলে দাবি নেতাকর্মীদের।

স্থানীয় নেতাকর্মীরা জানান, ড. মঈন খান বর্তমানে বিদেশে অবস্থান করছেন। তার অবর্তমানে পলাশ-ঘোড়াশালের ‘কুতুব’ বনে গেছেন মিল্টন। উপজেলার ১২৮টি মিল-কারখানা মিল্টন সিন্ডিকেটের দখলে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, বিভিন্ন ব্যক্তি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়মিত মোটা অঙ্কের চাঁদাও আদায় করেন তার শিষ্যরা।

তার বিরুদ্ধে সোমবার (২১ এপ্রিল) দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) এ সংক্রান্ত একটি অভিযোগও দায়ের করেন স্থানীয় ব্যবসায়ীদের একজন।  

পলাশ উপজেলা বিএনপির নেতাকর্মীরা বলছেন, ৫ আগস্টের পরই উপজেলা ছাত্রদলের তিন নেতা ও যুবদল নেতা ইয়াবা মনিরকে দিয়ে চাঁদাবাজি শুরু করেন মিল্টন। ঘোড়াশাল সার কারখানা, প্রাণ আরএফএল, হামীম, আকিজ, দেশবন্ধুসহ সরকারি ও বেসরকারি ১২৮টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানই এখন তার নিয়ন্ত্রণে।

চাঁদাবাজির শুরুতেই নিয়ন্ত্রণে নেন ঘোড়াশাল সার কারখানা। সবচেয়ে বেশি টাকা আসে সেখান থেকেই। সার কারখানা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে রয়েছেন তারই চার ভাই— শামীম, আমিনুল, সাখাওয়াত ও সোহেল।

জানা গেছে, দুটি ফার্মের মাধ্যমে মিল্টন সিন্ডিকেট ঘোড়াশাল সার কারখানার টেন্ডার নিজেদের কব্জায় রাখে। জামালপুরের সরিষাবাড়ীর মেসার্স জাহাঙ্গীর এন্টারপ্রাইজ আওয়ামীপন্থি ফার্ম হিসেবে পরিচিত থাকলেও ক্ষমতার দাপটে মিল্টন ওই ফার্মের সকল কাগজপত্র অ্যাফিডেভিট করে নিজের নামে নিয়ে নেন।

সার কারখানার যাবতীয় টেন্ডার নিয়ে কাজ করছে তার সিন্ডিকেট। ওই ফার্মের অধীনে বর্তমানে ৭০০ শ্রমিক লোড-আনলোডের কাজ করছে। এছাড়া সারকারখানা থেকে দৈনিক ৩০০ ট্রাক মালামাল পরিবহন হয়। প্রতি গাড়ি থেকে ৭০০ টাকা হারে দৈনিক ২ লাখ ১০ হাজার টাকা করে চাঁদা আদায় করে মিল্টন সিন্ডিকেট।

জেরিন সিকিউরিটি নামের দ্বিতীয় ফার্মটিও আওয়ামীপন্থি। এই ফার্ম রামপাল প্রকল্পের কাজ করতো। মিল্টন এই ফার্মটিও নিজের নামে লিখে নেন। এই ফার্মের মাধ্যমেই সার কারখানায় ৩০০ অদক্ষ শ্রমিক কাজ করছে।

দুদকের অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ঘোড়াশাল সার কারখানার পরিত্যক্ত মিলের মালামালও সরিয়ে নিচ্ছে মিল্টন সিন্ডিকেট। যেখানে হাজার কোটি টাকা মূল্যের পরিত্যক্ত মালামাল পড়ে আছে। এর মধ্যে— লোহা, তামা, কপার, কয়েল, ইলেকট্রিক তার অন্যতম। ওই মিল থেকে মাটি, কার্টন বের করতে যে টেন্ডার হয়, ক্ষমতার প্রভাবে সেটিও ভাগিয়ে নেন মিল্টন। পরিত্যক্ত কারখানার নিরাপত্তা জোরদার ও চুরি ঠেকাতে কর্তৃপক্ষ পুলিশ ও ২০০ আনসার মোতায়েন করে। কিন্তু টেন্ডারের মাল পরিবহনের আড়ালে ট্রাকে করে লোহা ও অন্যান্য মালামাল বাইরে নিয়ে বিক্রি করে দিচ্ছে মিল্টন সিন্ডিকেট।

পলাশ থানায় এ সংক্রান্ত ঘটনায় একটি চুরির মামলাও হয়েছে। কিন্তু পুলিশ বা কারখানা কর্তৃপক্ষ এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। এ ঘটনায় মিল্টনের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণে একটি কল রেকর্ড বাংলাদেশের খবরের হাতে এসেছে।

যেখানে তার সিন্ডিকেটের এক সদস্যকে বলতে শোনা যায়, ‘পার্টির কাছে মাল বিক্রি করো ১৪-১৫ লাখ টাকা, আমাকে দিচ্ছো ২ লাখ টাকা। কত দিন মাল বন্ধ থাকে, কোন দিন কত ট্রাক মাল গেছে সব হিসাব আমার কাছে আছে।’

এমন একাধিক কল রেকর্ড রয়েছে এই সিন্ডিকেটের। যা তাদের চাঁদাবাজির ঘটনা প্রমাণে যথেষ্ট বলে দাবি করছেন স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীরা।

গত ৯ মার্চ ঘোড়াশাল সার কারখানায় সারের বস্তা সেলাইয়ের (ব্যাগিং) একটি টেন্ডার হয়। নিয়ম অনুযায়ী কমপক্ষে ৩টি ফার্মের শিডিউল জমা দেওয়ার কথা থাকলেও মিল্টনের দুটি ফার্মই শিডিউল জমা দেয়। অন্য কাউকে টেন্ডার ড্রপ করতে দেয়া হয়নি— অভিযোগ বিএনপির নেতাকর্মীদের।

তারা বলছেন, কারখানার এমডি, জিএম ও অ্যাডমিনের যোগসাজশেই এই কাজটি বাগিয়ে নেয় মিল্টন সিন্ডিকেট। সার কারখানার এমডি, জিএমসহ কারখানার ১২০০ লোক এই সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে।  

ওই টেন্ডারে অংশ নিতে চাওয়ায় উপজেলা যুবদলের এক নেতার বাসায় হামলার ঘটনাও ঘটে। হামলার সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, কয়েকজন দরজা ভেঙে ওই নেতার বাসার ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করে। এ সময় বাসার ভেতরে থাকা ওই যুবদল নেতাকে পিস্তলও দেখান হামলাকারীরা। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় থানায় গিয়ে সাধারণ ডায়রি (জিডি) ওই যুবদল নেতা। জিডি করে ফেরার পথে তার বাসার নিচেই ফের হামলার ঘটনা ঘটে। এ সময় গুরুতর আহত হন সেনাবাহিনীর (অব.) সার্জেন্ট মোজাম্মেল হক। তিনি বর্তমানে কুয়েত সেনাবাহিনীতে কর্মরত রয়েছেন।

অভিযোগ উঠেছে, তার কাছেও মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করে মিল্টন সিন্ডিকেট। তার মাথায় চাইনিজ কুড়াল দিয়ে আঘাত করা হয়। এ ঘটনায় সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা মামলা করেন। এখন মামলা তুলে নেওয়ার জন্য তার পরিবারকে হুমকি দিচ্ছে মিল্টন সিন্ডিকেট। মামলায় সিন্ডিকেট সদস্য ছাত্রদলের তিন নেতাকেও আসামি করা হয়। যাদের পুলিশ খুঁজছে। যদিও ঘটনার পর থেকেই গা ঢাকা দিয়েছেন তারা।

সাবেক সেনা কর্মকর্তার পরিবারকে ফোনে চাঁদা চেয়ে হুমকির কল রেকর্ডও বাংলাদেশের খবরের হাতে এসেছে। চাঁদা না দিলে ওই সেনা কর্মকর্তার ভাবির সন্তানকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়।

উপজেলা বিএনপির একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ডাঙ্গা ইউনিয়নে মিল্টন সিন্ডিকেটের হয়ে বিভিন্ন কারখানাসহ সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করছেন যুবদল নেতা ‘ইয়াবা মনির’। একই সিন্ডিকেটের হয়ে ঘোড়াশালে চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ করছেন মহিউদ্দিন চিশতীয়া। আর পাঁচদোনা এলাকার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করেন পিএস-২ ‘চোরা শাকিল’। চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ ও বিভিন্ন কারখানার কাজ ভাগানোর দায়িত্বে রয়েছে তার পিএস-১ মাইনুদ্দিন।  

স্থানীয় বিএনপির একাধিক সূত্র জানায়, পূজা কমিটির সভাপতি স্বপনকেও থানায় আটকে রেখে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করেন মিল্টন। এ ঘটনায় জড়িত পলাশ থানার তৎকালীন ওসিকে বদলি করা হয়েছিল।

মিল্টন সিন্ডিকেটের দিকে ইঙ্গিত করে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘পলাশ-ঘোড়াশালে কোনো পিএস পলিটিক্স চলবে না। পলাশকে দুনিয়া ভাববেন না। শেখ হাসিনাকে বিতাড়িত করেছি। নরসিংদী-২ এ যদি থাকতে চান, তাহলে চাঁদাবাজি বাদ দিয়ে মানুষের পক্ষে থাকেন। যদি মানুষকে জুলুম করেন তাহলে নরসিংদী-২ ছাড়া করব আপনাদের। পিএস সব উড়ে যাবে এখান থেকে।’

জানতে চাইলে সারোয়ার তুষার বলেন, ‘সেদিন বক্তব্যে বলেছি, নরসিংদীতে কোনো পিএস পলিটিক্স চলবে না। কারোর নামও উল্লেখ করিনি। এতেই তারা আমার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে গেছেন। সম্প্রতি আমি বিভিন্ন জায়গায় বলেছি- চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, মাদক এগুলোর যে অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে পলাশ—এগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কথা বললেই ওনারা ক্ষিপ্ত হন। এখন নামে-বেনামে বিভিন্ন আইডি থেকে আমাকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। আমাকে নাকি প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।’

তিনি বলেন, ‘আপনি যা শুনেছেন আমিও তা শুনেছি। তাদের কর্মকাণ্ড এখন পুরো পলাশ-ঘোড়াশালের মানুষের মুখে মুখে, ওপেন সিক্রেট। আমি একটা স্ক্রিনশট দেখলাম, কোনো একটা বিষয়ে ১৭ লাখ টাকা চালাচালি নিয়ে। এছাড়া সার কারখানাসহ বিভিন্ন কারখানা থেকেও তারা এসব করছে। যেগুলো কোথাও কোনো নিউজই হয়নি।’

পলাশ উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর সাইফুল ইসলাম বাংলাদেশের খবরকে বলছেন, ‘ড. মঈন খানের পিএস মিল্টন না, তিনি স্যারের সাথে বিভিন্ন কাজ করেন। স্যারের খান ফাউন্ডেশনে কাজ করে।

সার্বিক অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘স্যারও দেশে নেই, স্যার আমেরিকায়। তাছাড়া আমরা এসব অভিযোগের বিষয়ে এখনো ওয়াকিবহাল না। তবে অভিযোগ থাকলে তা ওনাকে দেওয়া হলে বিষয়টি তিনি দেখবেন।’

ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘দলীয়ভাবে বা অন্যকোনোভাবে এখনো আমার কাছে অভিযোগ আসেনি।’

মিল্টনের বিষয়ে জানতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খানের সাথে বিভিন্ন উপায়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু দেশের বাইরে থাকায় তার কাছ থেকে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

চাঁদাবাজি ও দুদকে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চেয়ে বাহাউদ্দিন ভুঁইয়া মিল্টনের মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। ক্ষুদেবার্তা পাঠালে তারও উত্তর দেননি তিনি। 

এনএমএম/এমএইচএস/ওএফ

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর