বিশেষজ্ঞ তিন আলেমই মসজিদ কমিটি গঠনে প্রায় অভিন্ন মত দিয়েছেন | গ্রাফিক্স : বাংলাদেশের খবর
বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মসজিদ রয়েছে। এই অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এসব মসজিদের মিম্বার। মিম্বার থেকে মসজিদের খতিব ইসলাম প্রচারের পাশাপাশি মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, ইসলামি সভ্যতা-সংস্কৃতি, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য, হালাল-হারাম ও মানুষের জীবনঘনিষ্ট নানা বিষয়ে আলোচনা করেন।
মিম্বারে আলোচনার ক্ষেত্রে খতিবের স্বাধীনতা অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কিন্তু আমাদের মসজিদগুলো সমাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। মসজিদ পরিচালনায় সামাজিক ব্যক্তিরা যুক্ত থাকেন। এজন্য অনেক সময় খতিবদের মসজিদ পরিচালনায় যুক্ত ব্যক্তিদের মর্জি অনুযায়ী কথা বলতে বাধ্য করা হয়। বিগত সরকার দীর্ঘ দিন ক্ষমতা ধরে রাখায় বিষয়টি প্রকট আকার ধারণ করেছিল।
দেশের অসংখ্য মসজিদ-মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছিল তখনকার ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। পরিচালনা কমিটিতে শুধু সরকারি দলের লোকেরাই ঠাঁই পেতেন। এ কারণে হক ও সত্য বলায় স্বাধীনচেতা অনেক খতিবকে চাকরিচ্যুত পর্যন্ত করা হয়। এমনই একজন মুফতি আব্দুল বাতেন কাসেমী। তিনি রাজধানীর মিরপুর-১১নং বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতিব।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকার পতনের পর তিনি তার পদ ফিরে পান। ফের ওই মসজিদটিতে খতিব হিসেবে নিযুক্ত হন। আওয়ামী শাসনামল ও এর পরবর্তী সময়ে মিম্বারে খুতবা দেওয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য এসেছে কিনা- এ বিষয়ে তার কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘ওই সময় শুধু আমিই নই; কোনো আলেম ও খতিবেরই হক কথা বলার স্বাধীনতা ছিল না, যা এখন আছে।’
বিগত সময়ের স্মৃতিচারণ করে বর্ষীয়ান এ আলেম বলেন, ‘তৎকালীন আওয়ামী মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী পবিত্র হজ ও মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে কটূক্তি করলেন, তখন আমি মিম্বারে মুসল্লিদের সামনে তুলে ধরেছিলাম যে, এটা আল্লাহ ও ঈমানবিরোধী কাজ। এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক করা আমার দায়িত্ব ছিল। কিন্তু দায়িত্ব পালন করাটাই আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। ওই সময়কারের আওয়ামীপন্থী কমিটি আমাকে খতিবের পদ থেকে অব্যাহতি দেয়।’
মুফতি আব্দুল বাতেন কাসেমীর মতে, ‘লতিফ সিদ্দীকীর বিষয়টি নিয়ে মিম্বারে কথা বলা রাজনৈতিক বক্তব্য ছিল না; বরং সেটি ছিল ঈমানি বিষয়।’ এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘খতিবদের বাকস্বাধীনতা সম্পূর্ণরূপে কেড়ে নেওয়ার মূল কারণ ছিল কমিটি দলীয়করণ করা। তারা ঈমানি বয়ানকে দলীয় বক্তব্য আখ্যা দিয়ে আমার বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেয়।’
মুফতি কাসেমী বলেন, ‘মসজিদ সবার। এখানে কোনো শ্রেণি ভেদাভেদ নেই। সকলের জন্য মসজিদে দোয়া করা হবে। দলীয় নেতাকর্মীদের জন্য যে বিশেষ দোয়ার প্রচলন, এটির বিলুপ্তি প্রয়োজন।’
বুযুর্গ এ আলেম বলেন, ‘যারাই ক্ষমতায় আসুক। তারা তাদের মতো দেশ চালাবে। কিন্তু আমাদের দাবি হলো মিম্বারে কোরআন-সুন্নাহর কথা বলার স্বাধীনতা থাকতে হবে।’
আর মসজিদের কমিটি দ্বীনদার ও আল্লাহভীরু হলেই এই স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব বলে মনে করেন মুফতি আব্দুল বাতেন কাসেমী। তিনি বলেন, ‘এজন্য কমিটির সদস্যরা নির্দলীয় হলে সবচেয়ে ভালো। আর যদি দলীয় হয়, তাহলে সর্বদলীয় হলে তারা এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। আর এতে মিম্বারের স্বাধীনতা সুরক্ষিত থাকবে।’
মুফতি কাসেমী জানান, তিনি নতুনভাবে ফিরে আসার পর সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে মিম্বারে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারছেন। বর্তমান কমিটি তাকে আশ্বস্ত করে বলেছে, ‘আপনি কোরআন-হাদিসের স্পষ্ট কথাগুলো বলবেন, এতে কেউ আপনাকে বাধা দেবে না।’
মসজিদ কমিটি গঠনে মুফতি আব্দুল বাতেনের মতামতকেই সমর্থন করেন আল জামেয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারীর সিনিয়র মুহাদ্দিস ও চট্টগ্রামের মসজিদে আবু বকরের খতিব মাওলানা আশরাফ আলী নিজামপুরী।
তিনি বলেন, ‘মসজিদ কমিটির সদস্যদের খাঁটি দ্বীনদার হওয়া আবশ্যক। যারা কমপক্ষে সুন্নতমতো দাড়ি রাখেন এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে এসে আদায় করেন। এতে খতিবদের স্বাধীনতা থাকবে।’
মাওলানা নিজামপুরীর দাবি, ‘বিগত সরকারের আমলে মসজিদের মিম্বারে খতিবদের কথা বলার স্বাধীনতা ছিল না। মিম্বারের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বিগত সরকারের আমল এবং বর্তমান সময়ের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। আগে খতিবরা কমিটির ভয়ে, আওয়ামী নেতাকর্মীদের ভয়ে কোরআন-হাদিসের কথা ও সত্য কথা বলতে পারেননি। তবে এখন সেই পরিস্থিতি নেই।’
মিম্বারে নিজের বয়ানের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে গবেষক এ আলেম বলেন, ‘আগে আমরা হক কথা বলতে ভয় পেতাম। কোন সময় আমাদের উঠিয়ে নিয়ে যায়, কখন আমাদের গুম করে ফেলা হয়- এমন আতঙ্কে থাকতাম। আলহামদুলিল্লাহ, সেই আতঙ্ক এখন আর নেই।’
তবে আগের সময় ও বর্তমান সময় বিবেচনা করে মিম্বারে কথা বলেন না রাজধানীর মগবাজারে অবস্থিত শাহনুরী (রহ.) জামে মসজিদের খতিব মাওলানা ছানাউল্লাহ জামালি। মিম্বারে নিজের বয়ানের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমি আগেও যেভাবে কথা বলতাম এখনো সেভাবেই কথা বলি। আমি সাধারণত সমাজের প্রয়োজনীয় বিষয় ও সমাধান নিয়ে কথা বলি। কাউকে উদ্দেশ করে কিছু বলি না।’
তিনি বলেন,‘আমি কাজ নিয়ে কথা বলি। কে কাজ করেছে তাকে নিয়ে বলি না। আমি বলি কাজটি হালাল নাকি হারাম। এবার কাজটা যেই করুক, সেটা হালাল হলে হালাল, হারাম হলে হারাম। এভাবে সবসময় সঠিকটা বলার চেষ্টা করি। আর আমার মসজিদের পরিবেশ আগেও যেমন ছিল এখনও তেমনই।’
মসজিদ কমিটি কেমন হবে- এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাওলানা জামালি মুফতি আব্দুল বাতেন কাসেমী ও মাওলানা আশরাফ আলী নিজামপুরীর মতোই অভিন্ন মত দেন। তিনি বলেন, ‘এখানে দলীয় ব্যাপারটি না দেখে, দেখা উচিত যে, সদস্যরা ভালো মানুষ কি-না। আমি মনে করি, তাহলেই মিম্বারের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন থাকবে।’
ওএফ/