Logo
Logo

ধর্ম

পূর্বসূরী আলেমরা ওয়াজের অগ্রিম চুক্তিকে ঘৃণা করতেন

Icon

বেলায়েত হুসাইন

প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৬:৫৫

পূর্বসূরী আলেমরা ওয়াজের অগ্রিম চুক্তিকে ঘৃণা করতেন

গ্রাফিক্স : বাংলাদেশের খবর

ড. এবিএম হিজবুল্লাহ কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রফেসর। দেশের প্রবীন আলেম হিসেবেও সর্বজন শ্রদ্ধেয়। অভিজ্ঞতায় ভরপুর বর্ষীয়ান এ স্কলারের সঙ্গে দেশের প্রচলিত ওয়াজ মাহফিলসহ প্রাসঙ্গিক নানা বিষয়ে কথা বলেছে বাংলাদেশের খবর। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বেলায়েত হুসাইন।  

বাংলাদেশের খবর : নিশ্চয়ই ভালো আছেন? আপনার দীর্ঘ জীবনে অসংখ্য ওয়াজ মাহফিল দেখেছেন। অতীত এবং বর্তমানের মাহফিলগুলোর মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য দেখতে পান?

ড. এবিএম হিজবুল্লাহ : আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহ ভালো রেখেছেন। জি, প্রচুর পার্থক্য রয়েছে। আমার শৈশব, কৈশর ও যৌবনের মাহফিলগুলো দেখেছি। শৈশবে যাদের ওয়াজ শুনেছি, তাদের নাম খুব বেশি মনে নেই। তবে তাদের স্মৃতি মধুর। সেই সময় আউটার স্টেডিয়ামের খোলা ময়দানে আন্তর্জাতিক কারীদের কেরাত শুনেছি। তবে কৈশর ও যৌবনে যাদের ওয়াজ শুনেছি এবং যাদের ওয়াজ শুনে আপ্লুত হয়েছি, তাদের ওয়াজ ছিল সাদামাটা। বেশিরভাগ ব্ক্তার কোনো সুর ছিল না। ছিল না কোনো হুমকি-ধমকি। চিল্লাচিল্লি ছিল না। ফালতু ও বানোয়াট গল্পের জমজমাট আসর ছিল না। বাতিলের বিরূদ্ধে গঠনমূলক সমালোচনা ছিল। ছিল হুঁশিয়ারি, কিন্তু ছিল না বাড়াবাড়ি। কোরআন ও হাদিসের কাহিনী ছিল। ছিল নিখাদ হাসি-কান্না। শ্রোতfদের দিল তাতে আকর্ষিত হতো। নুরানী আবহে আলোকিত হতো। রূহিানিয়াতে ভরা ছিল। কলব থেকে নির্গত হত, কলবে গিয়ে আঘাত হানত। আকিদা ও আমলের বর্ণনায় ভরপুর ছিল। রাজনৈতিক আলোচনাগুলোও ছিল যেন ওয়াজ মাহফিল। কোরআন-হাদিসের আলোকে যুক্তিতর্কের মাধ্যমে বিরোধীদের খণ্ডন করা হতো। ওয়াজ মাহফিলগুলো নিয়ন্ত্রিত হত দ্বীনী মেজাযে।

বাংলাদেশের খবর : ইসলাম প্রচারের নানা মাধ্যম রয়েছে। ওয়াজ মাহফিলও সেগুলোর একটি। আপনার চোখে ওয়াজ মাহফিল সাধারণ মানুষের মধ্যে কতটুকু দ্বীনি প্রভাব ফেলে এবং আমাদের সমাজে এর গুরুত্ব কেমন?

ড. এবিএম হিজবুল্লাহ : দ্বীন প্রচারের অন্যতম একটি মাধ্যম ওয়াজ মাহফিল। সাধারণ মানুষের মাঝে এর প্রচণ্ড প্রভাব রয়েছে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- আমাদের পাক-ভারত উপমহাদেশে ওয়াজ মাহফিলের মাধ্যমেই দ্বীন ও ইসলামের প্রচার-প্রসার ঘটেছে। শুধু এখানেই শেষ নয়; আরব আফ্রিকাসহ ইউরোপের দেশগুলোতেও দাওয়াতি মাধ্যম হিসেবে ওয়াজ মাহফিলকেই বেছে নেওয়া হয়েছে। ইসলামের প্রথম দিকে জিহাদের পাশাপাশি দাওয়াতি কার্যক্রমও পরিচালিত হতো। সুফী-দরবেশগণের মাধ্যমে ইসলামের আলোয় আলোকিত হয় বিশ্ব। তাতারিদের ভয়ঙ্কর আক্রমণে মুসলিম মনীষীরা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েন। ভারতবর্ষে তাদের আগমন ঘটে। তারা ওয়াজ মাহফিলের মাধ্যমে দ্বীনের আলো ছড়িয়ে দেন। 

আমাদের দেশও এর ব্যতিক্রম নয়। তখন ছিল উম্মুক্ত মাহফিল। তবে কিছুটা ব্যতিক্রম হয়েছে মাত্র। এখন সাধারণ মাহফিলের পাশাপাশি মাদ্রারাসাগুলোর বার্ষিক মাহফিলগুলোও ভালো ভূমিকা রাখছে। আগে মেয়েদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা ছিল না বললেই চলে। এখন এলাকাবাসীর উদ্যোগে আয়োজিত মাহফিলগুলোতে মেয়েদের জন্য সুন্দর ব্যবস্থা রাখা হয়। কোনো কোনো মাদ্রাসাও এমন ব্যবস্থা করে থাকে। আলহামদুলিল্লাহ! বলা যায়, সমাজ সংস্কারে ওয়াজ মাহফিলের অনেক গুরুত্ব রয়েছে। কোরআনিক বর্ণনায় ওয়াজ সংক্রান্ত বেশ কিছু আয়াত রয়েছে। ‘তাদেরকে উপদেশ দিন; কেননা উপদেশ ঈমানদাদের উপকৃত করে।’ (সুরা জারিয়াত)। মক্কার দারুল আরকামের কথা ইতিহাসের পাতায় সংরক্ষিত আছে। 

বাংলাদেশের খবর :  একজন বয়োজ্যেষ্ঠ ও প্রবীণ আলেম হিসেবে বর্তমান বক্তাদের প্রতি আপনার যদি কোনো ম্যাসেজ থাকে, সেটি বলবেন আশা করি!

ড. এবিএম হিজবুল্লাহ : আসলে এ সম্পর্কে কী বলবো বুঝতে পারছি না। এতটুকু বলতে পারি- বক্তাগণ যদি নিজেদের উস্তায ও আকাবিরদের থেকে শিক্ষা নেন তাহলে অনেক কিছু শিখতে পারবেন। এতে নিজের আমলের যেমন উন্নতি হবে, তেমনি ইলমের প্রচার-প্রসারে শ্রোতাগণ উপকৃত হবেন। অনেক উসতাযকে দেখেছি- রাতের যে প্রহরেই মাহফিল শেষ হোক, শেষ রাতের সালাত মিস করতেন না। ফরজ ছুটে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তাই পয়েন্ট আকারে কয়েকটি কথা বলি, যা আমার নিজের জন্যও প্রযোজ্য। এক. ইখলাস থাকতে হবে। দুই. বেহুদা ও ফালতু কথা বলে সময় নষ্ট করা যাবে না। তিন. শ্রোতার সংখ্যা হিসাব করা যাবে না। একজন আল্লাহওয়ালার কথা শুনেছি, সময় হওয়ার পর তিনি বললেন, (বিশ্বস্তসূত্রে শ্রুত) ‘আঁর সময় ওই গিয়্যে। বয়ান শুরু কইজ্জুম না?’ উত্তরে বলা হলো, হুজুর! লোক সংখ্যা কম। একটু পরে আমরা শুরু করি। তিনি বললেন, ‘ও বা! মানুষ দিয়ারে ক্যান হইব? আঁই বে আমল। আঁই নিজেরে নসিহত কইজ্জুম।’ আহ! চার. আওয়াজকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। হাদিসের আলোকে ছোট আওয়াজ দিয়ে শুরু করবে। দরদমাখা দিল দিয়ে কথা বলবে। প্রয়োজনে উঁচু হবে, নিচু হবে। পাঁচ. সন্মানি বা হাদিয়ার ব্যাপারে কোনো শর্তারোপ না করাই বাঞ্চনীয়। 

বাংলাদেশের খবর : ইদানিং কিছু বক্তা ও কারীদের দেখা যায়, তারা মাহফিলের আগেই ডেট কনফার্ম বাবদ নির্দিষ্ট অংকের একটা অর্থ নেন। শুধু তাই নয়; বরং এদের অনেকে আবার ওয়াজের পারিশ্রমিকও অগ্রিম নিয়ে থাকেন। এ ব্যাপারে ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি ও হুকুম কী? 

ড. এবিএম হিজবুল্লাহ : বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। কোরআনে কারিম ও হাদিসে কি এর কোনো সূত্র নেই? আফসোস! নবীগণ বলছেন, ‘তোমাদের নিকট প্রতিদান চাই না। আমার প্রতিদান তো আল্লাহর জিম্মায়।’ জি, প্রয়োজনের খাতিরে উলামায়ে কেরাম খিদমতে দ্বীনের বিনিময় গ্রহণের অনুমতি দিয়েছেন। ঠিক আছে, কিন্তু তাই বলে কি যেভাবে খুশি সেভাবে আদায় করতে হবে? অনেক ক্ষেত্রে আয়োজক বক্তাদের নিকট যিম্মি হয়ে যান। বিভিন্ন কারণে অতিরিক্ত পারিশ্রমিক দিতে তারা বাধ্য হন। 

অবশ্য এ ক্ষেত্রে আয়োজকদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ রয়েছে। তারাও বক্তার ব্যক্তিত্বকে সন্মান প্রদর্শনে ব্যর্থ হন। অনেক জায়গায় ভিন্ন রকমের কথাবার্তাও শোনা যায়। আমি এমনও খবর পেয়েছি, বক্তাকে সন্মানি যা দেওয়া হয়, তাতে বক্তার রাহ খরচও (ভাড়া ইত্যাদি) হয় না। তখন বক্তারা বাধ্য হয়েই আগাম অর্থ দাবি করেন। 

আমি আমার অনেক আকাবির ও উস্তাযকে দেখেছি, যারা অগ্রিম চুক্তি করাকে ঘৃনা করতেন। এমন কথা কেউ বললে সেখানে যেতেনই না। তারা যেখানে যেতেন হাদিয়া বা সন্মানি দিলে চোখ বন্ধ করে নিয়ে নিতেন। কমবেশি দেখতেন না। মাদ্রারাসার মাহফিলগুলোতে কেউ বা খাম খুলে দেখে গাড়ি ভাড়া এবং সামান্য কিছু নিজের জন্য রেখে বাকিটা ফেরত দিয়ে বলতেন, মাদ্রাসার অনেক ব্যয়। সেখানে খরচ করুন, প্রয়োজনে কিতাব ক্রয় করুন। 

বাংলাদেশের খবর : বক্তা নির্বাচনের ক্ষেত্রে মাহফিল আয়োজকদের কী বিশেষ কিছু করণীয় আছে? আশা করি জানাবেন! 

ড. এবিএম হিজবুল্লাহ : জি, ইতোপূর্বে বক্তাদের সম্পর্কে যে কথাগুলো বলেছি সেগুলোর আলোকে বক্তা নির্বাচন করলে খুবই ভালো হয়। 

বাংলাদেশের খবর : আমাদের সমাজের অনেক মানুষ ওয়াজ শোনেন কিন্তু দেখা যায়- তাদের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন হচ্ছে না, জীবনকে ইসলামি শরিয়ত মোতাবেক পরিচালনা করছেন না। এর কারণ কী? তাদের প্রতি আপনার কী নসীহত?

ড. এবিএম হিজবুল্লাহ : প্রকৃতপক্ষে এর কারণ হিসেবে অনেকে মনে করেন ওয়াজ তো হয়, কিন্তু ওয়াজে তো দরদ বা অন্তর্মুখী কোনো প্রভাব থাকে না। আগেই বলেছি, ওয়াজ হতে হবে দিল থেকে, ইখলাসের সাথে। সাথে সাথে দোয়াও থাকতে হবে। পাশাপাশি শ্রোতাদেরকে ইখলাসের সাথে আমলের নিয়তে বসতে হবে, শুনতে হবে। একতরফা হলে হবে না। দেখুন, নবীগণের ইখলাস ও দরদ কম ছিল? কিন্তু তারপরও তো দেখা যায় উম্মতের দিলে তা প্রভাব বিস্তার করছে না। আসলে এটা সম্পূর্ণরূপে রাব্বুল আলামিনের ইখতিয়ার। তবে এটা অবশ্যই বলা যায়- শ্রোতারা যদি ইখলাসের সাতে শোনেন আর বক্তাগণের মাঝেও দরদ ও ইখলাস থাকে তাহলে অবশ্যই শ্রোতারা আকষির্ত হবেন ইনশাআল্লাহ। দেখুন, এই ওয়াজ মাহফিলের মাধ্যমেই আল্লাহর অনেক বান্দা হিদায়াতপ্রাপ্ত হয়েছেন। একটু স্মরণ করতে পারি, হজরত আবু বকর, ওমর, উছমান, আলী, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, বেলাল, আম্মার (রা.) কীভাবে হিদায়াতপ্রাপ্ত হয়েছেন এবং ঈমান ও আমালের উপর দৃঢ় ছিলেন। আমলে আখলাকে আমুল পরিবর্তন এনেছেন। 

বাংলাদেশের খবর : মাহফিলগুলোতে মাইকিং সিস্টেম নিয়ে আপনার অভিমত কী?

ড. এবিএম হিজবুল্লাহ : একটি ভালো বিষয় উত্থাপিত হয়েছে। আমি অনেক স্থানেই দেখেছি মাহফিল হচ্ছে এক জায়গায়, আর বিশাল এলাকাজুড়ে রয়েছে মাইকের ব্যবস্থাপনা। যদি মোড়ে মোড়ে মাইকের ব্যবস্থাই থাকে, তাহলে প্যান্ডেল করে মানুষকে সমবেত করার প্রয়োজন কী? ঘরে, দোকানে ও বাজারে বসেই তো ওয়াজ শোনা যায়। প্রকৃতপক্ষে এটা একেবারেই অনুচিত। যতটুকু প্রয়োজন মাইকের ব্যবহার ততটুকুই থাকুক। প্যান্ডেলকে কেন্দ্র করে সাউন্ড সিস্টেমে বাধা নেই। কিন্তু দূরে দূরে মাইক দিয়ে মানুষকে কষ্ট দেওয়ার কোনো মানে হয় না। যার শোনার ইচ্ছে সে প্যান্ডেলে আসুক। আওয়াযে অনেক শিশু ঘুমের ঘোরে আঁতকে উঠে। বৃদ্ধ ও অসুস্থদের বিশ্রামের ব্যঘাত ঘটে। এগুলো একপ্রকার শব্দুদুষণ ও শব্দ নির্যাতন। বিষয়টি মাথায় রাখলে খুবই ভালো হয়। পাশাপশি এখন ভিডিওর একটা সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে। জানি না এগুলো দ্বারা মানুষ কতটুকু উপকৃত হচ্ছে। তবে এটা বলতে দ্বিধা নেই এর দ্বারা অনেক বিভ্রান্তিও ছড়াচ্ছে। আল্লাহ হেফাজত করুন। 

বাংলাদেশের খবর : মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য শুকরিয়া। আপনার দীর্ঘায়ু কামনা করছি।

ড. এবিএম হিজবুল্লাহ : আপনাকে এবং পত্রিকা সংশ্লিষ্ট সবাইকে কিছু বলার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আন্তরিক মুবারাকবাদ। আল্লাহ আপনাদেরকে উত্তম বিনিময় দান করুন। 

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর