-67d48adf5ad71.jpg)
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর পাল্টে গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) দৃশ্যপট। দীর্ঘ ১৫ বছর পর ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের আধিপত্যের অবসান ঘটেছে। বিরাজ করছে রাজনৈতিক সহাবস্থান।
এরই মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের দাবি ওঠে। শিক্ষার্থীদের চাপের মুখে ঢাবি প্রশাসনও এতে সম্মত হয়। এরপর কয়েক দফায় ডাকসু নির্বাচন নিয়ে সাবেক নেতা, সাংবাদিক ও শিক্ষকদের মধ্যে বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়। তবুও আগামী ডাকসু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা কাটেনি। শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হয় কিনা, সে বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলো।
জানা যায়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাস নিয়ন্ত্রণে নেয় ছাত্রলীগ। আবাসিক হলের সিট থেকে শুরু করে ক্যাম্পাসের দোকান—সবই ছিল তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) কিংবা হল সংসদের কোনো প্রতিনিধি না হয়েও সকল কর্মকাণ্ডে তাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেখা যেত। আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও তাদের সহায়তা করেছে বলে অভিযোগ আছে। এমনকি অভিযোগ আছে যে, কোনো শিক্ষার্থী অপকর্মের প্রতিবাদ করলেই করা হতো মারধর-নির্যাতন। দেশের অন্যতম বৃহৎ ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলও ক্যাম্পাসে প্রবেশের সুযোগ পায়নি।
এমন প্রতিকূল পরিবেশেও ডাকসু নির্বাচনের দাবি জানিয়ে এসেছে একদল শিক্ষার্থী ও ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী। অনেক নাটকীয় ঘটনার পর ২০১৯ সালে দীর্ঘ ২৮ বছর পর অনুষ্ঠিত হয় ডাকসু নির্বাচন। দীর্ঘ অচলায়তন ভেঙে তখন নিয়মিত ডাকসু নির্বাচনের ঘোষণা দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
কিন্তু সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচনে ভোট কারচুপির অভিযোগসহ ছাত্র সংগঠনগুলোর নানামুখী চাপে কথা রাখতে পারেনি ঢাবি প্রশাসন। এরপর ফের বন্ধ হয়ে যায় ডাকসু নির্বাচনের প্রক্রিয়া।
ছাত্রলীগের নানা কর্মকাণ্ডের কারণে ওই নির্বাচনে ছাত্রলীগের ভরাডুবি হওয়ার কথা থাকলেও ভোট কারচুপি করে তাদের জিতিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ অন্যান্য সংগঠনের ছাত্র নেতাদের।
এ বিষয়ে ডাকসুর সাবেক জিএস প্রার্থী ও গণ অধিকার পরিষদের নেতা রাশেদ খান বলেন, ‘২০১৯ সালে একটি জঘন্যতম ডাকসু নির্বাচন হয়েছিল। আওয়ামীপন্থি সাবেক ভিসি আখতারুজ্জামান, প্রক্টর গোলাম রব্বানীর সহযোগিতায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ভোট কারচুপি করে। ডাকসু নির্বাচনে আমরা ১১টি পদ পেলেও মাত্র দুটি পদের নাম ঘোষণা করা হয়। আমি চাই না ২০১৯ সালের জঘন্যতম ঘটনা ২০২৫ সালে এসে ঘটুক।’

তিনি আরও বলেন, ‘ডাকসু নিয়ে আমি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সাথে কথা বলেছি। কিন্তু প্রশাসন এখনো ডাকসু নির্বাচন দিতে পারেনি। আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের নিয়ে ডাকসু নির্বাচন করা সম্ভব নয়। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচিত আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের বাদ দিয়ে একটি সুষ্ঠু ডাকসু নির্বাচনের ব্যবস্থা করা।’
এদিকে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন করে ডাকসু নির্বাচন ও ক্যাম্পাসে লেজুড়ভিত্তিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি ওঠে। হলে হলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আয়োজনে ব্যাচভিত্তিক ছায়া সংসদ নির্বাচনও করা হয়। এক পর্যায়ে ডাকসু নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে কয়েক দফায় ডাকসুর সাবেক নেতা, সাংবাদিক ও শিক্ষকদের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তবুও আগামী ডাকসু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, ডাকসু নির্বাচন একটি বড় আয়োজন। এটি শিক্ষার্থীদের নির্বাচন হলেও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকে সরকারের সর্বোচ্চ মহল। এ নির্বাচন করতে হলে সকলের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দরকার।
কিন্তু ক্যাম্পাসের অন্যতম বড় ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল চায় না এ মুহূর্তে ডাকসু নির্বাচন হোক। এছাড়া বিএনপিসহ অনেক দলও এখন ডাকসু নির্বাচন বিষয়ে নারাজ বলে জানা গেছে।
দীর্ঘদিন ধরে এ নির্বাচন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভেতরে নানা গুঞ্জন থাকলেও সম্প্রতি সেটি অনেকটা স্পষ্ট হয়েছে। চলতি বছরের মার্চ মাসে ডাকসু নির্বাচনের ঘোষণা দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দিন। কিন্তু, মার্চ মাস শেষ হয়ে গেলেও এখনো কোনো পদক্ষেপ নেয়নি ঢাবি প্রশাসন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মার্চের শুরুতে ডাকসু হওয়ার কথা বললেও তা আদৌ হবে কিনা, সে বিষয়ে সন্দিহান সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
জানা যায়, রাজনৈতিকভাবেও ডাকসু নিয়ে চাপ রয়েছে। বিএনপির অঙ্গ সংগঠন ছাত্রদল চায় না এই মুহূর্তে ডাকসু নির্বাচন হোক। যেহেতু বর্তমান পরিস্থিতিতে এটি বড় একটি বিষয়, ছাত্রদল চাচ্ছে জাতীয় নির্বাচনের আগে যেন ডাকসু নির্বাচন না হয়। ছাত্রদল যেহেতু একটি বড় রাজনৈতিক সংগঠন, তাদের অনুপস্থিতিতে বা তারা না চাইলে ডাকসু হবে কিনা—এটি নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্য সেন হলের শিক্ষার্থী মিনহাজুর রহমান বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘ঐতিহাসিক ৫ আগস্টের পর ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’ নামে যে আশার বাণী রাজনৈতিক প্রাঙ্গণে ঝড় তুলছে, তা কি আদৌ বাস্তবে দৃশ্যমান? স্বৈরাচার পতনের ১ দফা সম্পন্ন হলো ঠিকই, কিন্তু ৯ দফার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত একটি দফা—বহুল আকাঙ্ক্ষিত ছাত্রসংসদ নির্বাচনের দাবি—যেন সময়ের সাথে বিলীন হয়ে যাচ্ছে! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বড় দাবি এই ডাকসু নির্বাচন।’
তিনি আরও বলেন, ‘ডাকসু নির্বাচন হচ্ছে না কেন? এটা কি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনীহা, নাকি দলীয় ছাত্র সংগঠনগুলোর ঐক্যমত্যের অভাব? সকল রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনই চায় ডাকসু নির্বাচন, কিছু সংগঠন চায় সংস্কারের পর। কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবি দ্রুত ডাকসু নির্বাচন।’
জিয়াউর রহমান হলের শিক্ষার্থী ওয়াকার রহমান বলেন, ‘এখন এই সময়ে ডাকসু নির্বাচন খুবই জরুরি। কারণ, জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর ক্যাম্পাসে প্রকাশ্য রাজনীতি সেভাবে না থাকলেও সবসময়ই একটা স্নায়ুযুদ্ধ চলছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। এ সময় ডাকসু নির্বাচন যত দেরি হবে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ ও মারামারির সম্ভাবনা তত প্রবল থাকবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস বলেন, ‘ডাকসুর ব্যাপারে আমাদের অবস্থান আগের চেয়ে বদলায়নি, বরং আরো শক্ত হয়েছে বলা যায়। ডাকসু নির্বাচনের আগে অবশ্যই জাতীয় ও ক্যাম্পাসের আভ্যন্তরীণ প্রেক্ষাপট বিবেচনা করা জরুরি। সে প্রেক্ষিতে আমরা কখনোই ডাকসু নির্বাচন নিয়ে অতিরিক্ত তাড়াহুড়া বা অতিরিক্ত বিলম্বের পক্ষপাতী ছিলাম না, এখনো নই।’

তিনি বলেন, ‘বিদ্যমান আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে মাথায় রেখে সব অংশীদারের মতামতের ভিত্তিতে ডাকসু ও হল সংসদসমূহের গঠনতন্ত্রটিকে সংস্কার করে গণতান্ত্রিক ও কার্যকরী রূপ দেওয়ার পরে সঠিক সময় নির্ধারণ করে ডাকসু নির্বাচন সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে আয়োজন করা সকলের প্রাণের দাবি। কিন্তু তার আগে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাবিধান করাটা বর্তমানে সর্বোচ্চ জরুরি বলে মনে করি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সভাপতি এস এম ফরহাদ বলেন, ‘শিবিরের সাংগঠনিক অবস্থান হচ্ছে যতদ্রুত সম্ভব ডাকসুর আয়োজন করার পক্ষে। ক্যাম্পাসের স্থিতিশীলতা, প্রশাসনের নিরপেক্ষতা হল ও অ্যাকাডেমিক এরিয়ায় সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতে এই মুহূর্তে ডাকসু সবচেয়ে বেশি দরকার। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আহ্বান জানাই যেন মার্চের মধ্যেই ডাকসুর তফসিল ঘোষণা করে এবং এপ্রিলের মধ্যেই ডাকসু নির্বাচন সম্পন্ন করে।’

জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)’র যুগ্ম সদস্য সচিব রিফাত রশিদ বলেন, আমি মনে করি খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে ডাকসু নির্বাচন দেওয়া উচিত। প্রশাসন অনেক বেশি কালক্ষেপণ করছে, যা করা একদমই উচিত নয়। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের সংস্কার প্রস্তাবনাও রয়েছে, সেগুলো যাতে মূল্যায়ন করা হয় এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি কমিটি গঠন করা হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সভাপতি পদ রানিং স্টুডেন্ট থেকে নিয়ে আসা। এগুলো নিয়ে আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ডিবেট দেখতে চাই। আমি মনে করি ঈদের পরপরই ডাকসু নির্বাচন দিয়ে দেওয়া উচিত।

তিনি আরও বলেন, সকল স্টেক হোল্ডারদের সাথে কথা বলে ডাকসু নিশ্চিত করতে হবে। কেননা ডাকসুকে কেন্দ্র করে ক্যাম্পাস আবার অস্থিতিশীল হয়ে উঠুক এটা আমরা চাই না। স্টেক হোল্ডারদের সাথে পরামর্শ করেই ডাকসু নির্বাচন দেওয়া উচিত।
ডাকসু কবে হবে—এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, ‘এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া মুশকিল। আমাদের কমিটিগুলো পুরোদমে কাজ করছে। আমরা প্রভোস্টদের নিয়ে মিটিং করেছি। অন্য দুইটা কমিটি ডাকসুর গঠনতন্ত্র নিয়ে বেশকিছু কাজ করছে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে গঠনতন্ত্রগুলোর কিছু ফিডব্যাক নেওয়া হবে। তারপর বিষয়গুলো সিন্ডিকেটে পাশ করানো হবে। তারপর সময়টা আমরা বুঝতে পারবো ‘

তিনি বলেন, ‘আমাদের যেটা পরিকল্পনা, প্রসেস স্লো করবো না, সকল ডকুমেন্টেশন হাতে পেলেই আমরা বুঝবো কোন সময় ডাকসু নির্বাচন করলে ভালো হয়।’
এমএইচএস