১ লাখ গাছ রোপণের স্বপ্ন শাকিরের
৩৩ হাজার গাছ লাগিয়ে ‘সবুজের মহাকাব্য’

বাংলাদেশের প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৭ মার্চ ২০২৫, ১৫:২১
-67d7e98362cb8.jpg)
ছবি : সংগৃহীত
একটি স্বপ্ন, এক মন, আর সেই মনের অক্লান্ত পরিশ্রমের গল্পই হলেন শাহ সিকান্দার আহমদ শাকির।সিলেটের এই তরুণ একাই রচনা করেছেন ‘সবুজের মহাকাব্য’। গত ১১ বছরে তিনি নিজ হাতে রোপণ করেছেন ৩৩ হাজারেরও বেশি গাছ। তার রোপিত প্রতিটি গাছ যেন এক একটি ভালোবাসার গল্প। এই ভালোবাসা পৃথিবীর প্রতি, মানুষের প্রতি। যার শিকড় মাটির গভীরে, আর ডালপালা ছড়িয়ে পড়েছে সিলেটের আকাশে।
শাহ সিকান্দার আহমদ শাকিরের বৃক্ষরোপণের গল্প যেন প্রকৃতির সঙ্গে একান্ত প্রেমের গল্প। তার জীবন যেন সবুজের সঙ্গে মিশে থাকা এক অবিচ্ছেদ্য সুর। তিনি শুধু গাছ লাগান না, তিনি আমাদের ভবিষ্যতের শ্বাসবায়ু রচনা করেন। তার লাগানো প্রতিটি গাছ যেন একটি নতুন জীবনের প্রতীক, একটি সবুজ পৃথিবীর প্রতিশ্রুতি।
শাকিরের সবুজ অভিযাত্রার শুরুটা হয়েছিল ছোটবেলাতেই। পঞ্চম শ্রেণিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বলাই’ গল্পটি পড়েই তার হৃদয়ে জন্ম নেয় গাছের প্রতি গভীর প্রেম। ২০১৩ সালের ১৩ নভেম্বর হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিনে সিলেটের মানিকপীর টিলার কবরস্থানে কৃষ্ণচূড়া গাছ লাগানোর মাধ্যমে শুরু হয় তার বৃক্ষরোপণের যাত্রা। সেই প্রথম গাছ থেকে শুরু, আর থামার কোনো নাম নেই। শাকির প্রতিদিন গাছ লাগান, যেন প্রকৃতির সঙ্গে তার এক নিবিড় বন্ধন গড়ে উঠেছে। বৃক্ষের সাথে তার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
শাকিরের লাগানো গাছের তালিকা বিশাল—কৃষ্ণচূড়া, নিম, হরিতকী, বহেরা, রাধাচূড়া, কড়ই, শিমুল, নাগেশ্বর, বকুল থেকে শুরু করে আম, জাম, কাঠবাদাম, পেয়ারা, জামরুল, কাঁঠাল, তেঁতুলসহ অসংখ্য প্রজাতির গাছ। সিলেটের শহীদ মিনার, রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মন্দির কিংবা খালি জায়গা—সবখানে তার রোপিত গাছগুলো যেন দাঁড়িয়ে আছে প্রকৃতির নতুন সৈনিক হয়ে। যারা কার্বনডাই অক্সাইড রোধ করে মানুষকে এনে দেবে জীবন বাঁচানো অক্সিজেন।
শাকিরের শিক্ষাজীবন শুরু হয় সিলেটের মুরারি চাঁদ কলেজ (এমসি কলেজ) থেকে। যেখানে তিনি ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করেন। বর্তমানে সিলেট ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের হিসাব শাখায় সহকারী হিসাবরক্ষক হিসেবে কর্মরত তিনি। দিনভর অফিসের কাজের পরও বাড়তি আয়ের জন্য তিনি টিউশনি পড়ান। তবে কাজের ব্যস্ততা সবুজ ভালোবাসা থেকে তাকে বিরত করতে পারেনি। প্রতিদিনের মতো গাছ লাগানোর কাজও তার জীবনের অংশ হয়ে পড়েছে।
শাকিরের একক প্রচেষ্টায় আজ পর্যন্ত ৩৩ হাজারের বেশি গাছ রোপিত হয়েছে। এ যেন এক অরণ্যের স্বপ্ন, যা কেবল তার হাত ধরেই বাস্তবে রূপ নিয়েছে। স্থানীয় মানুষ তাকে ভালোবেসে ডাকেন ‘বৃক্ষমানব’। তার রোপিত গাছগুলোতে এখন সিলেটের আকাশে সবুজের হাতছানি, মাটির গভীরে শিকড়ের শক্ত মেলবন্ধন।
শাকির মনে করেন, ‘গাছ লাগানো মানে একটি নতুন জীবন দান করা।’ তার এই উদ্যোগ শুধুমাত্র গাছ লাগানোই নয়, প্রতিটি গাছের সঠিক যত্ন নেওয়ার ব্যাপারেও তিনি যত্নবান।
শাকির শুধুমাত্র গাছ লাগিয়ে থেমে যাননি, তিনি তরুণদের কাছে ছড়িয়ে দিয়েছেন সবুজের বার্তা। বিভিন্ন স্কুল, কলেজে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন, তাদের গাছের গুরুত্ব বোঝান। তার এই উদ্যোগে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেক তরুণই এখন তার পথ অনুসরণ করছেন।
শাকিরের কথায়, ‘আমাদের প্রজন্ম যদি গাছের গুরুত্ব বুঝে এবং সেই অনুযায়ী কাজ করে, তবে পৃথিবী আবার সবুজে ভরে উঠবে।’
শাকিরের মতে, পরিবেশ সংরক্ষণে ইসলাম ধর্মও বিশেষ গুরুত্বারোপ করে। তিনি মনে করেন, ‘ইসলামের এই শিক্ষাকে সঠিকভাবে প্রচার করতে পারলে, পরিবেশ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ইসলামি প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারবে।’
তিনি বলেন, ‘মসজিদ থেকে গাছ লাগানোর ফজিলত প্রচার করলে মানুষ এতে আরও অনুপ্রাণিত হবে।’
শাকির মনে করেন, ‘ইসলামি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও পরিবেশ সংরক্ষণে ভূমিকা রাখতে হবে, যাতে ধর্মের মাধ্যমেও সমাজে সবুজায়নের প্রসার ঘটে।’
শাকিরের স্বপ্ন এখানেই থেমে নেই। তিনি চান তার রোপণ করা গাছের সংখ্যা একদিন লাখ ছাড়িয়ে যাবে। শুধু নিজেই নয়, তরুণ প্রজন্মকেও তিনি এই অভিযাত্রায় শামিল করতে চান। তার লক্ষ্য হলো, দেশের প্রতিটি অঞ্চলে স্কুল, কলেজ, মসজিদ ও মন্দিরের আশেপাশে গাছ রোপণ করা এবং সমাজকে সবুজে রূপান্তরিত করা।
শাহ সিকান্দার আহমদ শাকির বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘পৃথিবী আমাদের সকলের, কিন্তু তার যত্ন আমরা কজনই বা নিই? গাছ লাগানো শুধু পরিবেশ রক্ষার জন্য নয়, এটা জীবনের প্রতি ভালোবাসার প্রতীক। আমি বিশ্বাস করি, প্রতিটি গাছ মানে একটি নতুন জীবন। আমার লক্ষ্য শুধু গাছ রোপণ নয়, মানুষকে এ কথাও বোঝানো যে, প্রকৃতি আমাদের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ।’
তিনি আরও বলেন, ‘যতদিন বাঁচব, আমি গাছ লাগিয়ে যাব। মানুষকে এ অভিযানে অংশ নিতে অনুপ্রাণিত করব। একদিন যদি সবাই এই কাজকে ভালোবেসে গ্রহণ করে, তবে আমরা একটি সবুজময় পৃথিবী পেতে পারি।’
- ডিআর/এমজে