সমুদ্রে ১৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে বিপাকে আড়ৎদাররা

চরফ্যাশন (ভোলা) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২২ মার্চ ২০২৫, ১৬:৪৫

লাভের আশায় সমুদ্রে ১৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার সামরাজ মৎস্যঘাটের ৯৮ জন আড়ৎদার। চলতি মৌসুমে তারা মুনাফা তো দূরের কথা, দশ-শতাংশ চালানও তুলতে পারেননি। এরই মধ্যে সমুদ্রে মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা চলমান থাকায় আড়ৎদার ও জেলেরা পুরোপুরি হাত গুটিয়ে বসে আছেন। এ ছাড়াও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি পর্যায়ে এই খাতে প্রায় ২০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে বলে জানা গেছে।
শনিবার (২২ মার্চ) সকালে সামরাজ মৎস্যঘাটের আড়ৎদার ও জেলেদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়।
সামরাজ মৎস্যঘাট জেলে সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান বলেন, ‘অধিক ঝুঁকি জেনেও আমরা মাছের ব্যবসা করছি। অনেক বছর ধরে এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। চরফ্যাশন উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বড় মৎস্যঘাট হলো সামরাজ ঘাট। ইলিশের ভরা মৌসুমে এ ঘাটে দৈনিক ৮ থেকে ১০ কোটি টাকার মাছ বিক্রি হয়। কিন্তু এ বছরের মতো খারাপ অবস্থা গত ৯-১০ বছরে দেখা যায়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘নদী ও সাগরে মাছ নেই বললেই চলে। মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা জারির আগের দিনও জেলেরা তেলের খরচ উঠাতে পারেননি। আড়ৎদারদের কী দেবে? নিষেধাজ্ঞা শেষে জেলেদের জালে মাছ ধরা পড়বে কি না, তা আল্লাহই ভালো জানেন।’
তিনি জানান, সামরাজ মৎস্যঘাটে ১৯৮ জন মৎস্য আড়ৎদার রয়েছেন। তারা প্রায় ১৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। কিন্তু তারা দশ-শতাংশ চালানও তুলতে পারেননি।
এদিকে, সামরাজ মৎস্যঘাটের বেড়িবাঁধের ঢালে ইলিশ জাল সেলাইয়ের কাজ করছিলেন দাদনভুক্ত কয়েকজন জেলে। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিষেধাজ্ঞার সময় জেলেরা জাল সেলাই ও ট্রলার মেরামত করছেন। কেউবা কৃষিকাজ করে সংসার চালানোর চেষ্টা করছেন।
জেলে নুরনবী (৩২) বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞার ১০ দিন আগে ২১ জন মাঝিমাল্লা নিয়ে সমুদ্রে গিয়েছিলাম। সামান্য পরিমাণ মাছ পেয়েছিলাম, তাতে বাজার খরচও উঠাতে পারিনি। এখন সংসার চালানোর মতো সামর্থ্য নেই। সমুদ্রে আগের মতো মাছ নেই। দেনা করে পরিবারের জন্য চাল-ডাল কিনতে হয়েছে। ধার-কর্জ করে কতদিন চলতে পারব?’
নুরনবীর মতো একই সমস্যার কথা জানান রফিক মাঝি (৪২), ইদ্রিস (৩৭), আব্বাস উদ্দিন (২৩) ও রত্তন মাঝি (৪৪)।
সামরাজ মৎস্যঘাটের আড়তদার হেলাল উদ্দিন টিপু বলেন, ‘নদী ও সমুদ্রে মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন জেলেদের দুর্বিষহ জীবন পার করতে হয়। বিশেষ করে সংসারের খোরাক জোগাতে হিমশিম খেতে হয় জেলেদের। এমনকি বাড়তি সুদের ঋণে জড়িয়ে যান তারা।’
চরফ্যাশন উপজেলার সর্ববৃহৎ সামরাজ মৎস্যঘাটের মতো এ অঞ্চলের অন্য ঘাটগুলোতেও সুনসান নীরবতা দেখা গেছে। বিশেষ করে বেতুয়া, নতুন ব্লুইসগেট, পাঁচকপাট, খেজুরগাছিয়া, ঢালচর, বকসীরঘাট, ঘোষেরহাট, চরকচ্ছপিয়া ও কুকরি-মুকরি ঘাটে কোনো কর্মব্যস্ততা নেই।
জেলেরা জানান, নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার আগপর্যন্ত মৎস্যঘাটগুলোতে কোলাহল থাকে না। শুধু নোঙর করা ট্রলার পাহারা দেওয়ার জন্য জেলেরা থাকেন।
চরফ্যাশন উপজেলা মৎস্য কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এই উপজেলায় প্রায় ৯০ হাজার জেলে রয়েছেন। এর মধ্যে নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ৪৪ হাজার ৩৭৫ জন এবং অনিবন্ধিত জেলে রয়েছেন প্রায় ৪৬ হাজার। এসব জেলে নদী ও সাগরে মাছ শিকার করেন।
চরফ্যাশন উপজেলা মেরিন ফিশারিজ কর্মকর্তা তানভীর আহমেদ বলেন, ‘এ বছর নদী ও সমুদ্রে মাছ খুবই কম। জেলেদের ওপর নির্ভর করে আড়ৎদাররা কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। আড়ৎদারদের এ বিনিয়োগের মুনাফা তুলতেই কয়েক বছর লেগে যাবে। মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা চলমান থাকায় ইতোমধ্যে অনেক জেলে বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরি করছেন।’
উল্লেখ্য, মাছের বংশবিস্তার, বেড়ে ওঠা ও টেকসই আহরণের জন্য বঙ্গোপসাগরে ভারত ও বাংলাদেশ সরকার বছরের নির্দিষ্ট একটি সময়ে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা দেয়। প্রতিবছর বাংলাদেশের জলসীমায় এই নিষেধাজ্ঞা থাকে ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিন। আর ভারতের জলসীমায় তা থাকে ১৫ এপ্রিল থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত ৬১ দিন। তবে সম্প্রতি সরকার মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা পুনর্বিন্যাস করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে, তাতে প্রতিবছর ১৫ এপ্রিল থেকে ১১ জুন পর্যন্ত ৫৮ দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। একই সময়ে নিষেধাজ্ঞা থাকবে বঙ্গোপসাগরের ভারতের জলসীমায়ও।
- এম ফাহিম/এমজে