Logo

সারাদেশ

৬৮ বছর ধরে বঞ্চিত পূর্ব সিলেট

Icon

রেজাউল হক ডালিম, সিলেট

প্রকাশ: ২০ এপ্রিল ২০২৫, ১১:১৪

৬৮ বছর ধরে বঞ্চিত পূর্ব সিলেট

১৯৫৫ সালে হরিপুরে আবিষ্কৃত দেশের প্রথম গ্যাসক্ষেত্র | ছবি : সংগৃহীত

  • নিজেদের গ্যাসে জ্বলে না জৈন্তাপুর, গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজারবাসীর উনুন
  • বার বার হয় আন্দোলন, দেওয়া হয় আল্টিমেটাম, পূরণ হয় না দাবি
  • পরিবর্তিত সময়ে জেগেছে নতুন আশা
  • এবার দাবি পূরণ না হলে কঠোর আন্দোলন

প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর পূর্ব সিলেট। এ অঞ্চলের কয়েকটি উপজেলার মাটির নিচ থেকে উত্তোলিত গ্যাস দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে বড় ভূমিকা পালন করছে। পাশাপাশি সমৃদ্ধ করছে গ্যাসের জাতীয় গ্রিডকে। কিন্তু দেশের অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা অঞ্চলের মানুষই অর্ধশতাধিক বছর ধরে বঞ্চিত। নিজেদের মাটির নিচের গ্যাসে জ্বলে না নিজেদের উনুন। বিশেষ করে ‘গ্যাসের রাজধানী’ খ্যাত পূর্ব সিলেটের জৈন্তাপুর, গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজারের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি ঘরে ঘরে গ্যাস সংযোগ। কিন্তু বরাবরই তাদের দাবি হচ্ছে উপেক্ষিত। এ অবস্থায় তারা যাচ্ছেন কঠোর আন্দোলনের পথে।

সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার হরিপুর গ্যাসক্ষেত্রে ১৯৫৫ সালে গ্যাসের সন্ধান মিলে। উত্তোলন শুরু হয় ১৯৫৭ সালে। ৬৮ বছর থেকে উত্তোলন হলেও এখনো বঞ্চিত গ্যাস গর্ভে ধারণ করা বৃহত্তর জৈন্তিয়া।

এই দীর্ঘ সময়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় জৈন্তাপুরের গ্যাস গেলেও এখনো বৃহত্তর জৈন্তিয়ার জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট ও কোম্পানীগঞ্জবাসী গ্যাস সুবিধা থেকে বঞ্চিত।

স্থানীয়রা জানান, সিলেট জেলার পূর্বাঞ্চল; জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার গর্ভ থেকে ১৯৫৫ সালে হরিপুরে গ্যাসের খোঁজ পাওয়া যায় এবং ১৯৫৭ সালে প্রথম গ্যাস উত্তোলন শুরু হয়। তখন হরিপুর গোয়াইনঘাট উপজেলাধীন ছিল। পরবর্তীতে জৈন্তাপুর উপজেলা গঠনের সময় হরিপুর এলাকাটি জৈন্তাপুর উপজেলার অন্তর্ভুক্ত হয়।

১৯৫৭ সাল থেকে বৃহত্তর জৈন্তিয়া এলাকার প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্র থেকে সারাদেশে গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে। অথচ এই গ্যাসের গর্ভধারিণী বৃহত্তর জৈন্তিয়া এলাকার মানুষ এখনো এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত।

জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মানুষ প্রতিনিয়ত গ্যাসের দাবিতে মানববন্ধন, মিছিল, সভা, গোলটেবিল বৈঠক, স্মারকলিপি প্রদান— এমনকি হরতাল-ধর্মঘটের মতো কঠোর কর্মসূচি পালন করেও গ্যাস ঘরে তুলতে পারেন নি।

সর্বশেষ হাসিনা সরকার পতনের পর গত বছরের ১৭ নভেম্বর গোয়াইনঘাট উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হাকিম চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ কর্পোরেশন (পেট্রোবাংলা)-এর চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকারের কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে বৃহত্তর জৈন্তিয়ার ঘরে ঘরে গ্যাস সরবরাহ ও হরিপুর গ্যাসক্ষেত্রে স্থানীয়দের বিভিন্ন পদে চাকরি দিতে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য স্মারকলিপি দেন।

কিন্তু অবস্থা সেই আগের মতোই। এ অবস্থায় শীঘ্রই কঠোর কর্মসূচির ডাক দেবেন বলে জানিয়েছেন সুবিধাবঞ্চিতরা।

গোয়াইনঘাট প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি সাংবাদিক এম এ মতিন বাংলাদেশের খবরকে বলেন, আমরা ৬৮ বছর ধরে বঞ্চনার শিকার। নিজেদের এলাকার গ্যাসে জ্বলে না নিজেদের চুলা। আর কত অপেক্ষা করতে হবে! আমরা মনে করি, আমাদের বিগত জনপ্রতিনিধিরা কার্যত উদ্যোগ নেন নি আমাদের ঘরে ঘরে গ্যাস নিয়ে আসার। তা না হলে আমাদের এতদিন বঞ্চিত থাকতে হত না। বর্তমান বৈষম্যহীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে নতুন করে দাবি জানাচ্ছি, শীঘ্রই এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হোক। অন্যথায় আমরা দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে বাধ্য হব।

গোয়াইনঘাট উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হাকিম চৌধুরী বাংলাদেশের খবরকে বলেন, আমরা গত বছরের ১৭ নভেম্বর পেট্রোবাংলার তৎকালীন চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকারের সঙ্গে দেখা করে স্মারকলিপির মাধ্যমে আমাদের বঞ্চনার কথা তুলে ধরে দ্রুত বৃহত্তর জৈন্তিয়ার ঘরে ঘরে গ্যাস প্রদানের দাবি জানিয়েছিলাম। তিনি এ সময় এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের আশ্বাস প্রদান করেছিলেন। তবে এরপর জনেন্দ্র নাথ সরকার বদলি হয়ে গেছেন বলে জানতে পেরেছি। কিন্তু আমাদের স্মারকলিপি বা লিখিত দাবি তো নিশ্চয় ফাইলে আছে। আমরা নতুন সরকারের কাছে আমাদের দাবি দ্রুত পূরণের জোর দাবি জানাচ্ছি। তা না হলে আমরা আবারও আন্দোলনের পথ বেছে নেব।

অন্যদিকে, গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজারে গ্যাস উত্তোলন হচ্ছে প্রায় অর্ধশত বছর ধরে। বর্তমানে গোলাপগঞ্জের কৈলাশটিলা ক্ষেত্রে ৮টি কূপ থেকে তেল-গ্যাস উত্তোলন হচ্ছে। এ উপজেলার বুকচিরে গ্যাসভর্তি গাড়ি দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়লে এলাকার মানুষের ঘরে ঘরে এখনো গ্যাস সংযোগ হয়নি। বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে বার বার শান্তিপূর্ণ আন্দোলন হলেও এখনো এই দুই উপজেলার বেশিভাগ মানুষ গ্যাসবঞ্চিত।

সর্বশেষ গত বছরের ৯ অক্টোবর ঘরে ঘরে গ্যাস সংযোগের দাবিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেন গোলাপগঞ্জ জাতীয় তেল, গ্যাস রক্ষা অধিকার বাস্তবায়ন সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ।

স্মারকলিপিতে তারা বলেন, গোলাপগঞ্জের কূপগুলো থেকে প্রতিদিন ৪১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে। কিন্তু যে উপজেলার মাটির নিচ থেকে গ্যাস উত্তোলন করে সরবরাহ করা হচ্ছে সারাদেশে, সেই উপজেলার শতকরা ৯০ ভাগ বাড়ি-ঘরই গ্যাসবঞ্চিত।

গোলাপগঞ্জ জাতীয় তেল, গ্যাস রক্ষা অধিকার বাস্তবায়ন সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ফারুক আলী বলেন, আমরা স্মারকলিপি দেওয়ার পরও কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় নি। এর আগে বছরের পর বছর ধরে আমরা সংবাদ সম্মেলন, মানবন্ধন, সভা, বৈঠক ও মতবিনিময়সহ নানা আয়োজনের মাধ্যমে আমাদের দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু কোনো সরকারই আমাদের দাবিকে মূল্যায়ন করে নি। সর্বশেষ আমরা বর্তমান বৈষম্যহীন সরকারের কাছেও দাবি জানিয়েছি। আমাদের দাবি পূরণ না হলে এবার আমরা কঠোর আন্দোলনের পথে যাব।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ কর্পোরেশন (পেট্রোবাংলা)-এর কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে পেট্রোবাংলা’র পরিচালক (পরিকল্পনা) মো. আব্দুল মান্নান পাটওয়ারী বলেন, এভাবে বক্তব্য দিতে আমাদের অফিসিয়াল বাধ্যবাধকতা আছে। নির্দিষ্ট তথ্যফরমে লিখে দিলে তথ্য জানাতে বা বক্তব্য দিতে পারব।

  • এটিআর
Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর